ভালোবাসা দিবসের এপিঠ ওপিঠ: ইসলাম কী বলে?

ভালোবাসা কাকে বলে?

ভালোবাসা আল্লাহর তাআলার একটি বিশেষ দান ও পবিত্র নেয়ামত। মানব জীবন ও সৃষ্টিকুলে এর গুরুত্ব, আবেদন ও আহবান অপরিসীম। ভালোবাসা মহান আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং স্বহস্তে তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিওনা। তোমরা সৎকর্ম করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন”। (সূরা আল বাকারাঃ ১৯৫)।

আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের ব্যাপারে বলেন, “আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন”। সূরা আল ইমরানঃ ৭৬)।

ভালোবাসার মানদণ্ড:

ভালোবাসার মানদণ্ড হলো একমাত্র মহান আল্লাহর তাআলার সন্তুষ্টি। অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা এবং কাউকে শত্রু ভাবতে হলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভাবা।

রাসূলুল্লাহ স. বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা রাখা”। (আহমদ, হাদীস: ২০৩৪১)।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কি ও কেন?

প্রচলিত ভালোবাসা দিবস ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি বিবর্জিত ও এর সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক বিজাতীয় ও পশ্চিমা একটি নোংরা অপসংস্কৃতি। ভালোবাসা দিবস-এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়াসহ আরো বহু রেফারেন্স থেকে এ দিবসটি সম্পর্কে বিভিন্ন মুখরোচক গল্প ও ইতিহাস জানা যায়, এখানে আমি যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটি উল্লেখ করবো।

২৭০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। তখন রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। এসময় সেন্ট ভ্যালেনটাইন নামে একজন খৃষ্টধর্ম ধর্মযাজক ছিলো। সে তরুণ-তরুণীদেরকে প্রেম-ভালবাসা ও গোপন পরিণয় সম্পর্কে দীক্ষা দিত। এদিকে সম্রাট ছিলেন বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় বিশ্বাসী। সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করেন, আর অপরাধে সম্রাট তাকে কারারুদ্ধ করেন।

ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। এক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। অনেকক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত। এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালবাসা ও তার প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালবাসার কথা সম্রাটের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। আর ভ্যালেন্টাইন নাম থেকেই এ দিনটির নামকরণ করা হয় “ভ্যালেন্টাইন্স ডে” যা আজকের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।

বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব:

বাংলাদেশের তরুণ তরুণীদের সস্তা যৌন আবেগকে পুঁজি করে এ দিবসটির প্রচলন শুরু হয় ১৯৯৩ ইং সালে শফিক রেহমান ও তার চটি পত্রিকা যায়যায়দিন-এর মাধ্যমে। সাথে সাথে সুযোগ-সন্ধানী ইসলামবিদ্বেষী অতি হুজুগে ও অপরিণামদর্শী হলুদ মিডিয়া গুলোও এটিকে ব্যাপক কভারেজ দেয়া শুরু করে। আর তা লুফেও নেয় বিপথগামী আল্লাহ বিমুখ তরুণ-তরুণীরা। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। শুরু হয় ভালোবাসার  নামে প্রকাশ্য নোংরামি। চালু হয় রূপ-সৌন্দর্য ও সাদা মাংস প্রদর্শনের নির্লজ্জ কসরত। মূলত পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের এদেশীয় এজেন্ট,তথাকথিত সংস্কৃতির প্রচলনের প্রবক্তারা আল্লাহ প্রদত্ত বৈধ ভালোবাসাহীন তাদের যন্ত্রণাকাতর দগ্ধ জীবনে একটু ভালোবাসার চেতনার জন্যই বাংলার মুসলিম সমাজে তথাকথিত এই ভালোবাসা দিবসের নামে একটি ভিনদেশী নষ্ট কালচারের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এরা আসলে ভালোবাসার কাঙ্গাল ফেরিওয়ালা।

বর্ণিত ইতিহাস আর বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের আগমন ও প্রেক্ষাপট থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তথাকথিত এই ভালবাসা দিবস কখনোই এদেশীয় বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির অংশ ছিলো না। বরং এটি পশ্চিমাদের তলপিবাহক এদেশীয় দালাল শফিক রেহমান গঙদের নিজস্ব আমদানি। নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা আর আখের গোছানোর লক্ষেই তারা এই বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার জন্ম দিয়েছে।

ভালোবাসা দিবস কেন বর্জনীয়:

প্রথমত এটি বিজাতীয় সংস্কৃতি, এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে কথিত ভালাবাসার নামে বেপর্দা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতার বিষ ভাস্প ছড়ায়, সস্তা যৌন সুড়সুড়ির মাধ্যমে ঘর-সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়, চিরন্তন মুসলিম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে অশান্তির অনল জ্বলে ওঠে, পরিণতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে যিনা-ভ্যাবিচার, চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়, ফেতনা-ফাসাদ, বিশৃঙ্খলা ও কলহ বিবাদ দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ তাআলা এসব অন্যায়, অপরাধ ও  ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তারা তো পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, আর আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না”। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৬৪)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি”। (সূরা আন নূরঃ ১৯)।

রাসূলুল্লাহ স. বলেন, “যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান, পরে তারা তারই ব্যাপক প্রচার-প্রসারেরও বাবস্থা করে, যার অনিবার্য পরিণতি সরূপ মহামারী, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দিবে যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি”। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪০০৯)। রাসূলুলুল্লাহ স. আরো বলেন, “যে জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যিনা- ভ্যাবিচার ব্যাপক হবে, তথায় মৃত্যুর আধিক্য ব্যাপক হয়ে দেখা দিবে”। (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং ৮৭০০)।

দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলার শাশ্বত দ্বীনের বিপরীতে অমুসলিমদের রীতিনীতি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমরা ইসলাম থেকেই বের হয়ে যাচ্ছি, অথচ মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য ইসলামকেই একমাত্র দীন বা জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে বাছাই করেছেন। আল্লাহ বলেন, “এবং যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন”। (সূরা আলে ইমরানঃ ৮৫)।

রাসূলুল্লাহ স. বলেন, “যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে”। (আবূ দাউদ হাদীস নং ৪০৩১)। অর্থাৎ  যারা কথিত ভালোবাসা দিবস পালন করবে তাদের হাশর-নাশর ইহুদী-নাছারা তথা বিধর্মীদের সাথেই হবে। রাসূলুল্লাহ স. আরো বলেন, “তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়বে, প্রতিটি বিঘৎ, প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্যে (তাদের তোমরা অনুসরণ করবে), এমনকি তারা সরীসৃপের গর্তে প্রবেশ করলে, তোমরা সেখানেও তাদেরকে অনুসরণ করবে” সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তারা কি ইহুদী ও খ্রীস্টান? তিনি বললেন, “এছাড়া আর কে?”। (বুখারী, মুসলিম)।

বস্তুত  হচ্ছেও তাই। আমরা যদি উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস গুলোর আলোকে নিজেদের দিকে একটু দৃষ্টি দেই তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো যে বর্তমানে  কুরআন ও সুন্নাহর এই ভাষ্য কতটা বাস্তব ও সত্য। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব কত গভীর। মুসলমানরা সর্বত্রই আজ বিধর্মীদের চালচলন, রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপক অনুসরণ করছে, যার অন্যতম ১৪ ফেব্রুয়ারি বা বিশ্ব ভালবাসা দিবস। মুসলমানদের জন্য এসব বিদস পালন কখনোই বৈধ হতে পারেনা, বরং এটি গর্হিত অপরাধ।

পরিশেষে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ তুমি আমাদের ক্ষমা করো, সব অন্যায়-অনাচার থেকে তুমি হেফাজত করো। আমাদের সকল ভালোবাসা ও প্রয়োজনে শত্রুতাসহ সব কিছুই যেন শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্যই হয়। হে আল্লাহ তুমি কবুল করো। আমীন।

শায়খ যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. (অনার্স), এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button