আপনিহীন দুনিয়া

পশ্চিমাকাশে বেলা ডুবে যাচ্ছে। একটু পরই অন্ধকারে ছেয়ে যাবে সবদিক। বেলা থাকতেই সব ঝটপট করে নিতে হবে। সময় খুবই কম। শুধু আজকের দিনটই আছে। ওদিকে কাজ অনেক বেশি। ব্যবসায় বিনিয়োগের শেষ সময় যাচ্ছে। আখেরাতের বিনিয়োগ। সর্বস্ব নিয়োগ করতে হবে এতে। কী বিনিয়োগ করবেন ভাবছেন তাইতো? আপনার এই জীবনকে পরকালের সেই জীবনের জন্য বিনিয়োগ করুন। এই একদিনের বিনিয়োগেই অনন্তকালের প্রফিট ঘরে তুলে আনতে হবে। কুড়িয়ে নিতে হবে চির সুখের জান্নাত। হেলায় খেলায় অবহেলায় এ সময় নষ্ট করা যাবে না। শেষমুহুর্তের শেষ সুযোগ মনে করে উদ্যোমী আত্মত্যাগী হোন। ঝিমিয়ে পড়বেন না। নেতিয়ে যাবেন না। সফল আপনি হবেনই ইন শা আল্লাহ্। মান জাদ্দা ওয়াজাদা, যে চেষ্টা করে সে সফল হয়।

বলবেন এটা কি করে সম্ভব? মাত্র একদিন! শুধু আজ! শুনুন, অবশ্যই সম্ভব। হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব। কেন নয়? আপনি ‘আজ’কে আপনার এই দিনটা দিন। ‘আজ’ আপনাকে অফুরন্ত সুখের অনন্তকাল দিবে। অন্তগহীন থেকে বিশ্বাসের সবটুক নিয়ে মনের আবেগ ও মাধুরী মিশিয়ে কায়মনোবাক্যে শুধু একবার বলুন, হে মহামহিম! হে অন্তর্যামী! তুমি আমার সব পাপ ও তাপ ক্ষমা করে দাও, আমাকে তোমার আপন করে নাও, আর তোমার জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর বানিয়ে দাও।

ঠিক এভাবে ভাবুন, পৃথিবীতে আপনি আজই এসেছেন, আজই চলে যাবেন। মৃত্যু আপনাকে আলিঙ্গনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এখনই আপনার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। একটু পরই মসজিদের মাইকে ঘোষক ঘোষণা করবে, অমুকের অমুক ইন্তেকাল করেছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইথারে পাথারে আপনার মৃত্যুর সংবাদ ভেসে বেড়াবে।

আমি আপনাকে কিছু সময়ের জন্য ভিন্ন একটি জগতে নিয়ে যেতে চাই। সেখানে আমি আর আপনি অনেক ঘুরবো। গলপ করব। কথা বলবো। এরই মাঝে আপনাকে আমি দেখাবো অনেককিছু। সেসব দেখে আপনার অন্তর চক্ষু খুলে যাবে। জীবনের মানে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে আমি আশঙ্কা করছি, এ ভ্রমন শুরুর একটু পরই হয়তো আপনি আমাকে ভুলে যাবেন। হ্যাঁ এটাই ঠিক। সবাই এমনটাই করে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, এ সফরে নিভৃতে একান্তেই যাওয়াই উচিৎ। কি যাবেন তো? চলুন তাহলে।

কিছু সময়ের জন্য আপনি চোখ দুটো বন্ধ করুন। তার আগে রুমের লাইটগুলো অফ করে নিন। এবার অন্তগহীন থেকে ভাবুন, আপনি এখন সুন্দর এ পৃথিবীতে আর নেই। সবাইকে ছেড়ে পরকালের পথে রওয়ানা করেছেন। মালাকুল মাউত আপনার রুহটা নিয়ে গেছে। আপনি মারা গেছেন। এ মুহূর্তে লাশের খাটিয়াটা আপনার বাড়ীর সামনে। বড়ই পাতা আর গরম পানি প্রস্তুত। আপনাকে বিদায়ী গোসল দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভেবে দেখুন তো সেই দৃশ্যটা কতোটা নির্মম, কতোটা নিষ্ঠুর, কতোটা হৃদয়বিদারক, কতোটা বাস্তব!

আপনি এরপর আর কিছু ভাবতে পারছেন? আসুন আরেকটু সামনে যাই। এরপর আপনাকে লাশের খাটিয়ায় তিন টুকরো সাদা কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। আপনার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী কিংবা স্বামী আপনার লাশের পাশে শোকে মুহ্যম্যান কিংকর্তব্য বিমুড় দাড়িয়ে ঠাই। নিথর নিস্তব্ধ পাথরের মতো হেয়ে গেছে। মনে হয় বিদ্যুতের ফোর ফোরটি লাইন তাকে শক করেছে। সবাই কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। আপনার কলিজার টুকরো সন্তানগুলো পাগলের মতো হয়ে গেছে। ওরা মা মা, বাবা বাবা বলে চিৎকার করে আকাশ বাতাস ভারি করে তুলছে। আদরের ছোট ভাই বোনগুলো দিশেহারা। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের চোখের কোনায় স্বজন হারানো জল। এলাকায় নেমে এসেছে আপনার বিয়োগে শোকের ছায়া।

এবার শেষবারের মতো এই সুন্দর পৃথিবী থেকে আপনার বিদায়ের পালা। সবাই আপনার লাশের খাটিয়া নিয়ে ধীরে ধীরে কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কবর রেডি। আপনার লাশটি দুজনে মিলে কবরে নামিয়ে রাখলো। উপরে বাঁশ বিছিয়ে মাটি চাপা দিতে শুরু করলো। একটু পূর্বে আপনি ছিলেন একজন জলজ্যান্ত জীবন্ত মানুষ। আপনার সুন্দর একটি নাম ছিল। দুনিয়ায় আপনার মান-সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি সবই ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই! লোকেরা আপনাকে এখন আর মানুষ বলছে না, বলছে মৃত লাশ! আপনি ইহকালের সফর শেষ করে পাড়ি দিলেন পরকালের অনন্ত অসীম এক অজানা গন্তব্যে। বেঁচে থাকতে আপনাকে লোকেরা বলতো, আসসালামু আলাইকুম – আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, এবার সবাই বলছে, আসসালামু আলাইকুম ইয়া দিয়াররা কওমিল মুমিনীন – হে কবরবাসী! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

কেবল একটিবার ভাবুন তো, দুনিয়ায় সবাই আছে কেবল আপনিই নেই। আপনার বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক বালেন্স, অর্থবিত্ত সবই ঠিক আছে। আপনার অফিসের ঐ খালি চেয়ারটা এখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু না, আজ আপনি সেখানে বসতে পারছেন না। প্রিয় মা, বাবা, ভালোবাসার স্ত্রী, স্বামী, কলিজার টুকরা সন্তান, আদরের ভাই বোন, আপনার সোনার সংসার, সাজানো বাগান, পরিচিত বন্ধু মহল সবই আছে। সবাই আছে। সবকিছুই ঠিক আগের মতোই চলছে। কিন্তু…, কিন্তু নেই শুধু আপনি। সবাই ভালো আছে। কিন্তু আপনি কেমন আছেন কেউ জানে না। বলুন তো এটা ভাবতে আপনার কেমন লাগছে?

এ চিন্তা কি আপানকে কখনো গ্রাস করেছে যে, আপনি একদিন মারা যাবেন? বা এটা কি আপনি কখনো ভেবেছেন যে, আপনার জীবনের এই অর্জন, মানসম্মান, বিলাসবহুল বাড়ী-গাড়ী, মূল্যবান সব আসবাবপত্র, সুসজ্জিত নয়নাভিরাম এসি রুম, দামি খাট আর তুলতুলে নরম বিছানা ছেড়ে সবকিছু রেখে সাড়ে তিন হাতের ছোট্ট একটি অন্ধকার মাটির ঘরে, মাটির বিছানায় একাকী কীভাবে থাকবেন? কেমন হবে আপনার সে ঘরটি?

অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করুন তো, আপনিহীন দুনিয়া আর দুনিয়াহীন আপনি, কোনটা কেমন?

ও আচ্ছা আরেকটা কথাও আপনাকে জিজ্ঞেস করি, যারা নিজ হাতে কবরে আপনাকে মাটি চাপা দিয়েছিলো তারা কারা আপনি কি জানেন? তারা কিন্তু আর কেউ নয় আপনারই একান্ত আপনজন। নিকট আত্মীয়স্বজন। স্বীয় প্রিয় বন্ধু-বান্ধব।

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]
১৩/০৩/২০২০, জুমাবার।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button