ঈমান কি কখনো হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়?

মৌলিক ঈমানের ভেতরে হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। এটা ইমাম আবু হানীফা র. এর অভিমত। ইমাম শাফেয়ী র. এবং অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কিরামের মতে ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তাদের দলীল হলো কুরআন ও সুন্নাহর অনেক নসের ‘যাহেরী’ শব্দ। সেখানে সুস্পষ্টভাবেই ঈমানের ব্যাপারে ‘হ্রাস’-‘বৃদ্ধি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফার বক্তব্য হচ্ছে, ঈমান হলো জরুরি কিছু বিষয় সত্যায়ন বা স্বীকারের নাম। যেগুলো থেকে সামান্য কম করলেও কেউ মুমিন থাকবে না। আবার বেশি করারও মুমিন হওয়ার জন্য জরুরি নয়। সেসব বিষয়ে ঈমান আনার ক্ষেত্রে সকলেই সমান। তাছাড়া প্রথম যুগের সাহাবায়ে কিরামকেও মুমিন বলা হয, অথচ তখন সত্যায়ন বা স্বীরোক্তি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। অর্থাৎ তখন আমল ছিলই না। তারা কি তখন অসম্পূর্ণ মুমিন ছিলেন? হ্যা এতটুকু বলা যায়, তখন তাদের ঈমান ছিল মুজমাল। এরপর বিভিন্ন আহকাম নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর প্রতি ঈমানও তাফসীলতে থাকে। আর ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির ব্যাপারে যেসব নস এসেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হচ্ছে ওগুলো ঈমানের নূর ও ইয়াকীনের শক্তি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

তবে তাহকীকের বেলা দেখা গেছে এই মতবিরোধ কেবলই শাব্দিক। অর্থাৎ হাকীকতে মতবিরোধ নেই। কারণ যারা বলেন ঈমানের ক্ষেত্রে হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, তাদের উদ্দেশ্য হলো ‘মুতলাকুল ঈমান’ (ন্যূনতম ঈমান; আমল অন্তর্ভুক্ত নয়) অর্থাৎ যতটুকু ঈমান আনা জরুরি সেখানে কম-বেশি নেই। যারা বলেন ঈমানে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ঈমান মুতলাক’ (পূর্ণ ঈমান ও আমল) এ কম-বেশি ঘটে থাকে। আর একারণেই রাসূলের হাদীস ‘যখন কোনো ব্যক্তি ব্যাভিচার করে তখন সে মুমিন থাকে না’- এখানে ‘ঈমান মুতলাক’ (পূর্ণ ঈমান) উদ্দেশ্য; মুতলাকুল ঈমান (ন্যূনতম ঈমান) উদ্দেশ্য নয়। কারণ আহলে সুন্নাহর সকলে একমত যে, কবীরা গোনাহের মাধ্যমে ঈমান নাকচ হয় না। একইভবে য হাদীসে এসেছে, ঈমানের ৭০ টির অধিক শাখা। এর উদ্দেশ্য ঈমানের শাখাগুলোর বিভাজন মৌলিক ঈমানের নয়। কারণ সকলেই একমত যে কেউ যদি সারাজীবনেও রাস্তা থেকে ময়লা দূর না করে তবুও মুমিন থাকবে, কাফের হবে না।

এ কারণেই কোনো কোনো আলেম বলেছেন, ঈমান যদি ‘দৃঢ় বিশ্বাস (আকদুন জাযিম) এর নাম হয়ে থাকে, সেখানে স্তরভেদ হওয়ার কেনো সুযোগ নেই। হ্যা আমলের ক্ষেত্রে স্তরভেদ হওয়ার সুযোগ আছে। একারণেই আমলকে ঈমানের পরিপূর্ণতা হিসেবে গণ্য করা হয়। আর যদি আমলকে মূল ঈমানের (পরিপূর্ণতার পরিবর্তে) রোকন হিসেবে গণ্য করা হয়, তাবে খারেজী এবং মুতাযিলাদের দোষ কী?

 ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য:

মহান আল্লাহ বলেন,

الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُواْ لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ-

‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তোমাদের বিরুদ্ধে লোকজন সমবেত হয়েছে, অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় কর। এতে তাদের বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি হয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক’ (সূরা আলে ইমরান-১৭৩)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَـذِهِ إِيمَاناً فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُواْ فَزَادَتْهُمْ إِيمَاناً وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ-

‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অনন্তর যেসব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করেছে’ (সূরা তাওবা-১২৪)

হাফেয ইবনে কাছীর রহ. বলেন, এ আয়াতটিই সর্বাধিক বড় দলীল যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। আর এটিই হচ্ছে অধিকাংশ উত্তরসূরী ও পূর্বসূরী বিদ্বান এবং ওলামায়ে কেরাম ও  আইম্মায়ে কেরামর মত।

ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রমাণে হাদীসে নববী:

হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يَزْنِى الزَّانِى حِيْنَ يَزْنِى وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ حِيْنَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ.

আবু হুরায়রাহ রা. হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোন ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না এবং কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ পান করে না। কোন চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটেরা লুটতরাজ করে না মুমিন অবস্থায়, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে’।

হাদীসটি থেকে প্রমাণিত হয় যে,ঈমান কমে ও বাড়ে। কোন মুমিন ব্যক্তি যখন পাপে পতিত হয় তখন তার ঈমান কমে যায়। আবার যখন সে তওবা করে পাপ থেকে ফিরে আসে,তখন তার ঈমান বাড়ে।

মোদ্দাকথা, কোন মুমিন ব্যক্তি বড় পাপ করলে তার ঈমান কমে যায়। তবে সে কাফের হয়ে যায় না। যেমন খারেজীরা এরূপ পাপে পতিত হওয়ার কারণে (মুসলমান ব্যক্তিদের) কাফের ধারণা করে থাকে। উল্লেখ্য যে,কোন মুমিন ব্যক্তি কবীরা গুনাহ করলে (বড় শিরক ব্যতীত) এবং তওবা ছাড়া মারা গেলে সেটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে তার পাপ পরিমাণ শাস্তি দিয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

হাদীসে আরও এসেছে-

مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَف الإِيْمَانِ

‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে বাধা দেয়। এতে সমর্থ না হ’লে কথা দিয়ে, এটিতেও সক্ষম না হ’লে অন্তর দিয়ে সেটিকে ঘৃণা করবে। আর এটা হ’ল দুর্বল ঈমান’।ইমাম নববী বলেন, অন্যায় কাজে বাধা দেওয়াটা ঈমানের একটি শাখা।

ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য:

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রা. তাঁর সাথীদের বলতেন, هلموا نزداد إيمانا، ‘এসো আমরা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করি’।

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. দো‘আতে বলতেন, اللهم زدني إيمانا ويقينا ‘হে আল্লাহ! আমার ঈমান ও প্রত্যয় বৃদ্ধি করে দাও’।

মু‘আয বিন জাবাল রা. তাঁর সাথীকে বলতেন, اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنُ سَاعَةً، يَعْنِي نَذْكُرُ اللهَ. ‘আমাদের সাথে বস, আমরা আল্লাহর প্রতি কিছুক্ষণ ঈমান আনি। অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করি।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, الإيمان يَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান বাড়ে এবং কমে’।

ওমর ইবনু আব্দুল আযীয রহ. আদী ইবনু আদী রহ. এর নিকট এক পত্রে লিখেছিলেন, ঈমানের কতকগুলো হুকুম-আহকাম, বিধি-নিষেধ ফরয এবং কতকগুলো সুন্নাত রয়েছে। যে এগুলো পরিপূর্ণ রূপে আদায় করে তার ঈমান পূর্ণ হয়। আর যে এগুলো পূর্ণভাবে আদায় করে না, তার ঈমান অপূর্ণাঙ্গ হয়।

সুফিয়ান ছাওরী রহ. বলেন, الإيمان يزيد وينقص ‘ঈমান বাড়ে ও কমে’।

আব্দুর রায্যাক শায়বানী বলেন, আমি মা‘মার, সুফয়ান ছাওরী, মালেক বিন আনাস, ইবনে জুরাইজ এবং সুফয়ান বিন উয়াইনা থেকে শুনেছি সবাই বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্ম দ্বারা বাস্তবায়ন করা। সেটি বাড়ে ও কমে’।

ইমাম শাফেঈ রহ. বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, সেটি বাড়ে ও কমে’।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন,الإيمان بعضه أفضل من بعض وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ وزيادته في العمل ونقصانه في ترك العمل  ‘ঈমানের কিছু অংশ কিছু অংশ থেকে উত্তম। সেটি বাড়ে ও কমে। আমলের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি হয় এবং আমল ছেড়ে দিলে তা হ্রাস প্রায়।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button