নাওয়াকিদুল ঈমান বা ঈমান ভঙ্গের কারণসমূহ
ঈমান ভঙ্গের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে মৌলিক ও প্রধান দশটি কারণ হলো নিম্নরূপ:
(১) ‘ইবাদতে আল্লাহ্র সাথে শরীক বা অংশীদার নির্ধারণ করা।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ.
এবং তারা উপাসনা করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর,যা না তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে না লাভ এবং বলে- “এরা তো আল্লাহ্র কাছে আমাদের সুপারিশকারী”। আপনি বলুন! তোমরা কি আসমান ও যমীনের এমন বিষয়ে আল্লাহ্কে অবহিত করছ,যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন? তিনি পুতঃপবিত্র ও মহান সে সমস্ত থেকে,যা তোমরা শরীক করছো। (সূরা ইউনুস-১৮)
সুতরাং যে ব্যক্তি ‘ইবাদতে আল্লাহ্র সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করবে, তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং সে ইসলাম বহির্ভূত; কাফের মুশরিক বলে গণ্য হবে।
(২) নিজের ও আল্লাহ্র মধ্যে কাউকে মাধ্যম নির্ধারণ করা, তার নিকট সুপারিশ প্রার্থনা করা, তাকে আহবান করা, তার উপর ভরসা করা ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ.
জেনে রাখুন,নিষ্ঠাপূর্ণ ‘ইবাদাত আল্লাহ্রই জন্যে। যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে এবং বলে যে,আমরা তাদের ‘ইবাদত এ জন্যেই করি,যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেয়,নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদের মধ্যে তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করছে সে ব্যাপারে ফায়সালা করে দেবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা যুমার-৩)
(৩) ধর্মত্যাগী মুরতাদ ও মুশরিকদেরকে কাফের মুশরিক বলে মনে না করা, কিংবা তারা যে কাফের মুশরিক, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা অথবা তাদের পথ ও মতকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা। এমনিভাবে এ ধরনের কোন কথা বলা যে, ইহুদী, খ্রিষ্ট ইসলাম, সব ধর্মই সঠিক ও সত্য এবং এসকল প্রতিটি ধর্মই তার অনুসারীকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায়। তাই যার যে ধর্ম ইচ্ছা ও পছন্দ হয়, সে তা গ্রহণ করতে পারে, তাতে কোন অসুবিধা নেই”।
এ ধরনের কথাবার্তা ও ‘আক্বীদাহ-বিশ্বাস হলো ইসলাম বিনষ্টকারী ও ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী সুস্পষ্ট কুফ্র ও শির্ক।
(৪) এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশিত হিদায়াত তথা শরী‘য়ত থেকে অন্য পথ বা ধর্ম অধিক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ, কিংবা রাসূলের অনুসৃত ও নির্দেশিত বিধান থেকে অন্য কারো বিধান অধিক উত্তম।
(৫) শরী‘য়তে ইসলামিয়ার কোন বিষয়ের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ করা, ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টের অন্যতম কারণ। যে ব্যক্তি মুহাম্মদ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত শরী‘য়তের এবং তাঁর নির্দেশিত হিদায়াতের কোন কিছুর প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ করবে, তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে এবং সে কাফের হয়ে যাবে, যদিও সে অসন্তুষ্টচিত্তে রাসূলের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ‘আমাল করে থাকে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ.
এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবর্তীণ করেছেন তারা তা পছন্দ করে না, সুতরাং আল্লাহ তাদের কর্ম নিষ্ফল করে দেবেন। (সূরা মুহাম্মাদ-৯)
(৬) দ্বীনে ইসলামের কোন বিষয়কে নিয়ে কিংবা আল্লাহ্র ওয়াদাকৃত ‘আযাব-গযব, নেয়ামত, দান বা পুরস্কার নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টের অন্যতম কারণ। যদি কেউ আল্লাহ্কে নিয়ে, তাঁর কোন ফেরিশতাদেরকে নিয়ে, কোন নাবী-রাসূলকে নিয়ে কিংবা কুরআনে কারীমের কোন আয়াতকে নিয়ে অথবা দ্বীনে ইসলামের ফার্য তথা অবশ্য করণীয় বা বর্জনীয় কোন বিষয়কে নিয়ে, কিংবা সঠিক ও অকাট্যভাবে দ্বীন হিসাবে প্রমাণিত কোন বিষয়কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, ঠাট্রা-তামাশা করে, অথবা দ্বীনে ইসলামের কোন বিষয়কে গালী-গালাজ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা এতদসম্পর্কে মর্যাদাহানীকর কিছু বলে, তাহলে তার ঈমান ও ইসলাম বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং সে ইসলাম বহির্ভূত; কাফের বলে গণ্য হবে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ. لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ.
(হে রাসূল! আপনি বলুন, তোমরা কি ঠাট্টা-তামাশা করছিলে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতগুলো এবং তাঁর রাসূল সম্বন্ধে? এখন আর ‘উয্র পেশ করো না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফ্রী করলে। (সূরা তাওবাহ-৬৫, ৬৬)
(৭) যাদু। যাদু হলো ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টকারী এবং মুছলমানকে কাফিরে পরিণতকারী কাজ।
আভিধানিক অর্থে যাদু বলা হয়- এমন প্রতিটি ক্রিয়াকলাপকে যার কারণ গোপন ও অস্পষ্ট থাকে, কিন্তু এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দেখা বা বুঝা যায়।
(৮) মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফের-মুশরিকদেরকে সাহায্য,সহযোগিতা করা ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টের অন্যতম কারণ। কেননা ঈমানদারগণকে আল্লাহ কাফের-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব না রাখার এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা না করার জন্য অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি (আল্লাহ) বলে দিয়েছেন যে,কাফের-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব পোষণকারীগণ তাদেরই দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে ক্বোরআনে কারীমে বহু আয়াত বর্ণিত রয়েছে। যেমন-
আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ.
অর্থাৎ- হে মু’মিনগণ,তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে,সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ যালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। (সূরা মায়িদাহ-৫১)
(৯) ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টের আরেকটি কারণ হলো- ব্যক্তি বিশেষের জন্য ইসলামী বিধান থেকে বের হয়ে যাওয়া বৈধ বলে মনে করা, কিংবা ব্যক্তি বিশেষকে ইসলামী বিধি-বিধানের উর্দ্ধে বলে মনে করা। إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَام. অর্থাৎ- আল্লাহ্র নিকট একমাত্র ধর্ম হলো ইসলাম। (সূরা আলে ইমরান-১৯)
(১০) ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো,ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া তথা দ্বীনে ইসলামকে উপেক্ষা ও বর্জন করা। আর তা হল:- “ইসলামের মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়াদীর জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকা। ইসলামী শরী‘য়ত অনুযায়ী ‘আমল বা অনুশীলন না করা। ইসলাম যেসব বিষয় অবশ্য পালনীয় বলে নির্দেশ দিয়েছে সেগুলো পালন না করা এবং যে সব বিষয় অবশ্য বর্জনীয় ও হারাম ঘোষণা করেছে সে সবকে বর্জন না করা। সঠিকভাবে দ্বীনে ইসলাম সম্পর্কে কিংবা ইসলামের মৌলিক বিষয়াদী সম্পর্কে জানার জন্য কোনরূপ প্রচেষ্টা না করা,কিংবা ধর্মীয় মৌলিক শিক্ষা অর্জন করার প্রতি কোনরূপ প্রয়োজন ও আগ্রহবোধ না করা। বরং ইসলামের চর্চা ও অনুশীলন থেকে দূরে থাকা এবং দ্বীন তথা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বা জাহেল হয়ে থাকাতে খুশি ও সন্তুষ্টি বোধ করা। আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন বা অমান্য করাকে কোনরূপ তোয়াক্কা বা পরওয়া না করা এবং আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ মেনে চলাকে আদৌ গুরুত্ব না দেয়া”।
এসব কার্যকলাপ স্পষ্টতো এটাই প্রমাণ করে যে,এ রকম লোক মুখে “লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, মুহাম্মাদুর্ রাছূলুল্লাহ” বললেও মনে-প্রাণে সে এ শাহাদাতাইনকে (কালিমাহ্কে) স্বীকার করছে না, বরং সে আল্লাহ্র দ্বীনকে উপেক্ষা ও বর্জন করছে এবং কার্যতঃ আল্লাহ্র দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর যারা আল্লাহ্র দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বা ধর্ম বিমুখতা অবলম্বন করে,তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنْتَقِمُونَ.
অর্থাৎ- এবং সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অনাচারীকে,যাকে তার পালনকর্তার আয়াত সমূহ স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়,অতঃপর সে উহা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়? আমি এরূপ অপরাধীদের হতে প্রতিশোধ নিব”। (সূরা ছাজদাহ-২২)