ইমাম যদি দাঁড়িয়ে সালাত পড়াতে অক্ষম হন
অসুস্থতা, শারীরিক দুর্বলতা বা অন্য কোনো কারণে ইমাম যদি দাঁড়িয়ে সালাত পড়াতে অক্ষম হন তাহলে তার জন্য বসে ইমামতি করা বৈধ। এ ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে কোন দ্বিমত নাই। তবে এ ক্ষেত্রে মুক্তাদিগণ দাঁড়িয়ে তার অনুসরণ করবে না কি বসে অনুসরণ করবে ইমামের অবস্থার আলোকে তা নির্ধারিত হবে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। ইমামের দু ধরণের অবস্থা হতে পারে। যথা:
প্রথম অবস্থা:
ইমাম যদি দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করেন তারপর অসুস্থতা বা কোন সমস্যার কারণে তাকে বসতে হয় তাহলে পেছনের মুক্তাদিগণ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়েই সালাত আদায় করবে এবং যথা নিয়মে ইমামের অনুসরণের সালাত শেষ করবে।
☑ এর দলীল হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের পূর্বে অসুস্থ অবস্থায় সালাত আদায়ের ঘটনা।
ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ:
উবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবা (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়িশা (রা.) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর (অন্তিম কালের) অসুস্থতা সম্পর্কে কি আপনি আমাকে কিছু শোনাবেন? তিনি বললেন, অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন: লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা আপনার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বললেন: আমার জন্য গসলের পাত্রে পানি দাও। আয়িশা (রা.) বলেন আমরা তাই করলাম। তিনি গোসল করলেন। তারপর একটু উঠতে চাইলেন। কিন্তু বেহুঁশ পয়ে পড়লেন। কিছুক্ষন পর একটু হুঁশ ফিরে পেলে আবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম: না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা আপনার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বললেন: আমার জন্য গোসলের পাত্রে পানি নিয়ে রাখ। আয়িশা (রা.) বলেন, আমরা তাই করলাম। তিনি গোসল করলেন। আবার উঠতে চাইলেন, কিন্তু বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষন পর আবার হুঁশ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে: লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা আপনার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বললেন: আমার জন্য গোসলের পাত্রে পানি নিয়ে রাখ। তারপর তিনি উঠে বসলেন, এবং গোসল করলেন এবং উঠতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর আবার হুঁশ ফিরে পেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন: লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম: না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা আপনার অপেক্ষায় আছেন। ওদিকে সাহাবীগণ ইশার সালাত -এর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অপেক্ষায় মসজিদে বসে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকরের নিকট এ মর্মে লোক পাঠান যে, তিনি যেন লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করে নেন। সংবাদ বাহক আবূ বকর (রা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবূ বকর (রা.) অত্যন্ত কোমল মনের লোক ছিলেন, তাই তিনি উমর (রা.) কে বললেন, হে উমর! আপনি সাহাবীগণকে নিয়ে সালাত আদায় করে নিন। উমর (রা.) বললেন, আপনই এর জন্য বেশি হকদার। তাই আবূ বকর সে কদিন সালাত আদায় করলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটু নিজে হালকাবোধ করলেন এবং দু’জন লোকের কাঁধে ভর করে যোহরের সালাত -এর জন্য বের হলেন। সে দু’জনের একজন ছিলেন আব্বাস রা. (অপরজন ছিলেন, আলী রা.)। আবূ বকর (রা.) তখন সাহাবীগণকে নিয়ে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখতে পেলেন, পিছনে সরে আসতে চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে পিছিয়ে না আসার জন্য ইশারা করলেন এবং বললেন: “তোমরা আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে দাও।” তারা তাঁকে আবূ বকর (রা.) এর পাশে বসিয়ে দিলেন। বর্ননাকারী বলেন, তারপর আবূ বকর (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাত -এর ইকতিদা করে সালাত আদায় করতে লাগলেন। আর সাহাবীগণ আবূ বকর (রা.) এর সালাত -এর ইকতিদা করতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উপবিষ্ট ছিলেন (সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বরঃ [653], অধ্যায়: ১০/ আযান (كتاب الأذان), ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
এখানে লক্ষণীয় দিক হল, আবু বকর (রা.) প্রথমে দাঁড়িয়ে সাহাবীদেরকে নিয়ে নামায শুরু করেছেন। কিছুক্ষণ পর নবী দু জন সাহাবীর কাঁধে ভর করে মসজিদে এসে আবু বকর রা. যতদূর নামায পড়িয়েছিলেন সেখান থেকে বসে বসে নামাযের ইমামতী করেছেন। কিন্তু তার পেছনে আবু বকর রা. সহ অন্যান্য সাহাবীগণ সকলে দাঁড়িয়েই নামায পড়েছেন।
দ্বিতীয় অবস্থা:
যদি এমন হয় যে, ইমাম প্রথম থেকেই বসে সালাত শুরু করেছে তাহল পেছনে মুক্তাদিগণও তার অনুসরণে প্রথম থেকে বসে সালাত আদায় করবে।
☑ এর দলীল হল:
عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ، أَنَّهَا قَالَتْ صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي بَيْتِهِ وَهْوَ شَاكٍ، فَصَلَّى جَالِسًا وَصَلَّى وَرَاءَهُ قَوْمٌ قِيَامًا، فَأَشَارَ إِلَيْهِمْ أَنِ اجْلِسُوا، فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ “ إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ، فَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا، وَإِذَا رَفَعَ فَارْفَعُوا، وَإِذَا صَلَّى جَالِسًا فَصَلُّوا جُلُوسًا
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা অসুস্থতার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ গৃহে সালাত আদায় করেন এবং বসে সালাত আদায় করেছিলেন, একদল সাহাবী তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে লাগলেন। তিনি তাদের প্রতি ইশারা করলেন যে, বসে যাও। সালাত শেষ করার পর তিনি বললেন, “ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাঁর ইকতিদা বা অনুসরণ করার জন্য। কাজেই সে যখন রুকু করে তোমরা ও তখন রুকু করবে, এবং সে যখন রুকু থেকে মাথা উঠায় তখন তোমরাও মাথা উঠাবে, *আর সে যখন বসে সালাত আদায় করে, তখন তোমরা সকলেই বসে সালাত আদায় করবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বরঃ [654], অধ্যায়ঃ ১০/ আযান (كتاب الأذان), ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
☑ আরেকটি হাদীস:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَكِبَ فَرَسًا فَصُرِعَ عَنْهُ فَجُحِشَ شِقُّهُ الأَيْمَنُ فَصَلَّى صَلاَةً مِنَ الصَّلَوَاتِ وَهُوَ قَاعِدٌ وَصَلَّيْنَا وَرَاءَهُ قُعُودًا فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ “ إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا صَلَّى قَائِمًا فَصَلُّوا قِيَامًا وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا وَإِذَا رَفَعَ فَارْفَعُوا وَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَقُولُوا رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ وَإِذَا
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোড়ায় অরোহণ করেন। তিনি তার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ায় তার দেহের ডান পার্শ্বে ব্যথা পান। এমতাবস্থায় বসে নামাযে ইমামতি করেন এবং আমরাও তার পিছনে বসে নামায আদায় করি। নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ইমামকে এজন্যই করা হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হয়। অতএব ইমাম যখন দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে তখন তোমরাও দণ্ডয়মান হবে। অতঃপর ইমাম যখন রুকু করবে তখন তোমরাও রুকু করবে এবং ইমাম যখন মস্তক উত্তোলন করবে তোমরাও মস্তক উঠাবে। অতঃপর ইমাম যখন “সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলবে, তখন তোমরা বলবে -রব্বানা ওয়া লাকাল হামদ।” ইমাম যখন বসে নামায আদায় করবে, তখন তোমরাও বসে নামায আদায় করবে।” (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, তিরমিযী)।
মোটকথা, ইমাম যদি ১ম থেকে বসে সালাত আদায় করে তাহলে তাহলে মুক্তাদিগণও তার অনুসরণে বসে সালাত আদায় করবে। ইমাম চেয়ারে বসুক অথবা মাটিতে বসুক পেছনে মুক্তাদিগণ বসে সালাত আদায় করবে। আর ইমাম যদি প্রথমে দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করে কিন্তু তারপরে কোন ওযর বশত: বসে যায় তাহলে মুক্তাদিগণ দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে যেমনটি উপরোক্ত দলীল প্রমানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহু আলাম।