ইসলামী অর্থনীতি ও প্রচলিত অর্থনীতির মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা
ভূমিকা:
ইসলামী অর্থব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। যা মানুষকে সৎ পথে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পথনির্দেশ করে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে সম্পদের আমানতদার। এক্ষেত্রে সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগে হারাম ও হালালের ব্যবধান নিশ্চিত করা হয়। এ অর্থনীতি সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য যাকাত, ওশর, জিযিয়া ও ছাদাকাতুল ফিৎর ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, কালোবাজারী, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, চুরি, ডাকাতি, শোষণ, মজুদদারী, যুলুম প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রচলিত অর্থব্যবস্থা মানব রচিত। সময়ের আবর্তনে এ অর্থব্যবস্থা সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়েছে। এমনকি এ তাত্ত্বিক বিবরণ (তথ্য-উপাত্তসমূহ) নির্দিষ্ট সময়ান্তে সনাতনী বা দ্রুপদী (Classical) হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কোন বিধি-বিধান না থাকায় সমাজে আর্থিক সমতার স্থলে হত-দরিদ্র, নিমণমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং ধনী ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। যা কোন দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে অক্ষম। সকল অর্থ ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য হ’ল সমাজের দারিদ্র্য বিমোচন করা। এ লক্ষ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত অর্থব্যবস্থা সর্বদাই দারিদ্রে্যর দুষ্টচক্রে (Vicious Circle of Poverty) বদ্ধাবস্থায় থাকে। বর্তমানে প্রচলিত অর্থনীতিকে বিজ্ঞানরূপে কেবল তার তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক আলোচনা করে, নৈতিক দিক এক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকে। এ অর্থনীতিতে নিঃস্ব, ফকীর ও অসহায় মানুষের ভোগের প্রাধান্য প্রসঙ্গ হিসাবে আসে না। সম্পদ কুক্ষিগত করার যাবতীয় কৌশলের কথা বিশ্লেষিত হয়। কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধ, সদাচরণ, বিত্তহীনদের কথা অলোচনায় আসে না। এতে সম্পদই মুখ্য, মানুষ নয়।
ইসলাম সমষ্টিগত কল্যাণ চায়, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি-গোষ্ঠীর নয়। আধুনিক অর্থনীতির দর্শনে মূল্যবোধ বিবেচিত হয় না এবং ইহজগত ও পরজগতের দৃষ্টিকোণ থেকে সামগ্রিক কল্যাণের মূল লক্ষ্যও বিবেচিত হয় না। প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আকাঙক্ষা ক্রেতাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কিছু লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে সমাজে আয় বৈষম্য (Income inequality) সৃষ্টি করে, যা ইসলামী অর্থনীতি সমর্থন করে না। ইসলামী অর্থনীতি প্রীতি, সাম্য, মৈত্রী এবং আধ্যাত্মিকতার সাথে অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত করে এক সর্বোত্তম মানবীয় রূপ দান করেছে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন দেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলী যেমন: উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, বিনিয়োগ, বিনিময়, বাণিজ্যের ধরন প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে আর্থ-সামাজিক ও আইনগত রীতিনীতি গড়ে ওঠে। বর্তমান বিশ্বে যেসব অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার ছোট-খাট পার্থক্য বাদ দিলে বলা চলে, মোট তিন প্রকার অর্থব্যবস্থা বিশ্বে চালু আছে। আর তা হ’ল- (১) ইসলামী অর্থব্যবস্থা (২) ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা (৩) সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা।[1] ইসলামী অর্থব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয়। এখানে ন্যায়বিচার এবং ইনছাফপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থার অনুসরণ করা হয়। ধনীদের থেকে যাকাতের অর্থ গরীব, অসহায় ও দরিদ্রদের মাঝে বণ্টনের মধ্যে দিয়ে সমাজের সাম্য অর্জন করা হয়। প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় এরূপ কোন ধরনের উদ্যোগ নেই। বরং এতে ধনীরা আরো ধনী হয় এবং গরীবেরা আরো গরীব হয়। ফলে গরীব লোকেরা মৌলিক চাহিদার প্রথম ধাপ- অন্ন (খাদ্য) দরিদ্রতার জন্য পরিমিতভাবে ভোগ করতে পারে না। এতে বিশ্বে ক্ষুধা নামক নীরব ঘাতকের হাতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাযার লোক মারা যাচ্ছে। ৮৫২ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার্ত থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BDRI) তথ্য অনুযায়ী দেশের ৫০ শতাংশ পরিবার বছরের কোন না কোন সময় খাদ্য সংকটে থাকে, ২৫ শতাংশ নিয়মিতভাবে সারা বছর খাদ্য পায় না, ১৫ শতাংশ পরিবার সবসময় পরবর্তী খাবার নিয়ে চিন্তিত থাকে এবং ৭ শতাংশ মানুষ কখনোই তিন বেলা খেতে পায় না।
বর্তমানে দেশের ৪০% মানুষ অতিদরিদ্র। প্রায় ২৮% মানুষ এক ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করছে। বিশ্বে প্রতিদিন না খেয়ে থাকে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ। অথচ উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্য অপচয় হয় ২২ কোটি টন।[2] প্রচলিত অর্থনীতি এরূপ মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা সমগ্র বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে এসবের স্থান নেই। যাদের পণ্য ভোগ করার সামর্থ্য নেই ইসলাম তাদের মাঝে যাকাতের অর্থ ন্যায্য বণ্টনের মধ্যে দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করছে। অর্থ-সম্পদ উপার্জনে হারাম-হালাল বিবেচনা, হালাল উৎপাদন, কর্মে নিযুক্ত থাকার নির্দেশ, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি, যাকাত ও ওশর ব্যবস্থার প্রবর্তন, কাপর্ণ্য ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা, সুষম বণ্টন, অপচয় ও অপব্যয় পরিহার, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা, সূদ-ঘুষ ও দুর্নীতি নিষিদ্ধ করা, শ্রমনীতি ও শ্রমের মর্যাদা, শোষণমুক্ত সমাজ, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সমাজকল্যাণ, উত্তরাধিকার আইনের বাস্তবায়ন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রভৃতি পন্থা বাস্তবায়নে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে বর্তমান বিশ্বে ইসলামী অর্থনীতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হচ্ছে।
ক. উৎপত্তি :
ইসলামী অর্থব্যবস্থা :
ইসলাম একটি শাশ্বত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যা প্রচলিত অর্থব্যবস্থার মারাত্মক সংকট উত্তরণে একটি সর্বোত্তম অর্থব্যবস্থা হিসাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নীতির সমন্বয় সাধন করে আদর্শ অর্থনীতির প্রবর্তন করে।
‘I originated during the Golden Age of Islam, 622-661 CE, when the Prophet Muhammad and the Rashidun practiced “brotherly cooperation[3] in economics. The ummah operated under the same codes of conduct, and resources were allocated efficiently to ensure a high standard of living.[4] It is believed that as ties to Islam weakened, so did global economic growth in Islamic institutions.[5] ইসলামী স্বর্ণযুগে ৬২২-৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল, যখন মহানবী (ছাঃ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীন অর্থনীতিতে ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহযোগিতা’ চর্চা করেছিলেন। উম্মাহ একই আচরণবিধির আওতায় পরিচালিত হয়েছিল এবং উচ্চ মানের জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য সম্পদ দক্ষতার সাথে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এটা বিশ্বাস করা হয় যখন ইসলামের সূচনা ঘটে, তখন ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা :
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে আধুনিক পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্রবাদের (Capitalism) উৎপত্তি হয়। ইংল্যান্ডে ১৭৬০-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শিল্প বিপ্লবের বিকাশ হ’লেও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের পর এর দ্রুত বিকাশ ঘটে। ফ্রান্স ও জার্মানী প্রভৃতি দেশে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে শিল্প বিপ্লবের দ্রুত বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। শিল্প বিপ্লবের ফলে যে বিরাট সম্পদের ও মূলধনের সৃষ্টি হয়, তা মুষ্টিমেয় মালিক শ্রেণীর হাতে থাকার ফলে ধনতন্ত্রের উৎপত্তি হয়। শিল্প বিপ্লবের আগে আধুনিক কলকারখানা না থাকায় উৎপাদন ব্যবস্থা কুটির শিল্পের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। কুটির শিল্পে যে ব্যক্তি উৎপাদক সেই ব্যক্তি শিল্প দ্রব্যের মালিক হওয়ায় শোষণের সম্ভাবনা ছিল না। বিক্রিত মালের মূল্য উৎপাদকই পেত। শিল্প বিপ্লবের ফলে কল-কারখানা স্থাপিত হ’লে কুটির শিল্প ধ্বংস হয়। শিল্প উৎপাদন কারখানাগুলোতে কেন্দ্রীভূত হয়। যাদের হাতে মূলধন ছিল তারা কারখানা স্থাপন করে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের মুনাফায় ফেঁপে উঠে। এভাবে এক পুঁজিবাদী শ্রেণীর উদ্ভব হয়।[6] ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে সংঘটিত শিল্প-বিপ্লবই আধুনিক ধনতান্ত্রিক ধারণার জননী। বৃটেনের শিল্প বিপ্লবের পূর্বে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার তেমন পরিচিতি ছিল না।[7] পুঁজিবাদের ইতিহাস বৈচিত্র্যময় এবং এর বহু বিতর্কিত বিষয় রয়েছে, তবে সাধারণত সম্পূর্ণরূপে পুঁজিবাদ উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত নিমণ দেশগুলোতে (বর্তমানে ফ্ল্যান্ডারস এবং নেদারল্যান্ড) এবং গ্রেট ব্রিটেনে, ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে উত্থিত বলে মনে করা হয়।[8]
সর্বোপরি অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হ’তে থাকে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমগ্র ইউরোপে ধনতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। একই সময়ে অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ ও তাঁর অনুসারীরা এ অর্থনীতির দৃঢ় প্রবক্তা ও সমর্থক হিসাবে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানী, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালী, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা :
‘সোস্যলিজম’ শব্দটি ১৮২৭ সালে ইংল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) কো-অপারেটিভ ম্যাগাজিনে প্রথম ব্যবহার করেন।[9] জার্মান বংশোদ্ভূত কার্ল মার্কস ও ইংল্যান্ডের অধিবাসী এঙ্গেলস্-এর যুগান্তকারী লেখা ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমাজতন্ত্রের বিপ্লব জেগে উঠতে শুরু করে। এরই ফলে বিশ্বে সর্বপ্রথম রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে জারতন্ত্রের পতন ও লেলিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের উত্থান হয়। পরবর্তীতে বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ ‘মাও-সে-তুং’ এর নেতৃত্বে চীনেও এ অর্থব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটে।[10] উদ্ভবের পর থেকে সমাজতন্ত্র বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করেছে। যেমন উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে,
…সমাজতন্ত্র চারটি সময়কাল পেরিয়েছে : প্রথমটি হয়েছিল ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় দর্শন (১৭৮০-১৮৫০)। তারপরে ঊনিশ শতকে কর্পোরেশন এবং শিল্পায়ন উত্থানের প্রাথমিক বিরোধী হিসাবে (১৮৩০-১৯১৬) বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থান ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের চতুর্দিকে সমাজতন্ত্রের উৎস এবং সমাজতান্ত্রিক বা সামাজিক গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া (১৯১৬-১৯৮৯); নয়া-উদার যুগে সমাজতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া (১৯৯০-)। সমাজতন্ত্রের বিকাশ যেমন হয়েছিল, তেমনি অর্থনীতিতেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল।[11]
সর্বোপরি পুঁজিবাদের শোষণ, সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টি, অপরিকল্পিত উৎপাদন এবং শ্রমিক-মালিক বিরোধ এবং সূদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিকারের উদ্দেশ্যে কার্ল মার্কস-এর যুগান্তকারী গ্রন্থ Das Kapital (Capital) প্রকাশিত হওয়ার পর এবং তাঁর তত্ত্বের আলোকে ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মতবাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে রাশিয়া, চীন, কিউবা, জার্মানী, পোল্যান্ড, উত্তর কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বিদ্যামান।
খ. পরিচিতি :
ইসলামী অর্থব্যবস্থা :
মানুষের সমগ্র জীবনের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি ব্যবস্থা হ’ল ইসলাম। সমগ্র জীবন অর্থ তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, আর্থিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন- সবকিছুই।[12] ইসলামী অর্থশাস্ত্র প্রচলিত অর্থশাস্ত্র থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। যা দ্বারা এ বিশ্ব অর্থনীতির ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক উভয়ই কল্যাণকর কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। যে অর্থব্যবস্থায় কুরআন ও সুন্না্হর আলোকে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে আয়, উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, মূলধন ও বিনিয়োগ প্রভৃতি পরিচালিত হয়, তাই ইসলামী অর্থব্যবস্থা। ড. এস.এম. হাসানুয্যামান বলেন, “Islamic economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of meterail resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.”[13] ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরী‘আতের বিধিনির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ, যা বস্ত্তগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ, যেন এর ফলে মানবমন্ডলীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।
অতএব ইসলামী শরী‘আতের বিধিনির্দেশ অনুযায়ী মানুষের প্রয়োজন অনুসারে উপার্জন, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, মানবীয় কল্যাণ সাধন, ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন, ভোগ, সামাজিক নিরাপত্তা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সকলের জীবিকার নিশ্চিয়তার বিধান প্রণালীকে ইসলামী অর্থনীতি বলে।
ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা :
ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানা (Private ownership) নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর সরকারী হস্তক্ষেপ থাকে না। যে অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ বা সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা বিদ্যমান এবং সরকারী হস্তক্ষেপ ব্যতীত অবাধ মূল্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজার পরিচালিত হয়, তা ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনরূপ হস্তক্ষেপ থাকে না। Capitalism is an economic system where private entities own the factors of production.[14] পুঁজিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাগুলো উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়।
অর্থনীতিবিদ জে. এফ. র্যাগান ও এল. বি. থমাস বলেন, ‘Pure Capitalism is characterized by Private ownership of resources and by reliance on market, in which buyers and sellers come together and determine what quantities of goods and resources are sold and at what price’.[15] বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র হচ্ছে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং বাজারের উপর আস্থা যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা একত্রে নির্ধারণ করে কি দামে ও কি পরিমাণে দ্রব্য ও সম্পদ বিক্রি হবে।
অতএব পুঁজিবাদী অর্থনীতি সম্পদের ব্যক্তিমালকানার উপর নির্ভরশীল। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলোকে ব্যক্তিগত মালিকানায় যেকোন পরিমাণ অর্থের যোগান দিয়ে শিল্প কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারে। শিল্প কারখানার মালিক সর্বাধিক মুনাফা লাভের আশায় তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন ও বৃদ্ধি করাই মানুষের সকল প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা :
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ন্যায় ব্যক্তিমালিকানায় অর্থনৈতিক কোনরূপ সম্পদ থাকে না। এ অর্থব্যবস্থায় সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত থাকে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ (Central Planning Authority) কর্তৃক দেশের উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পদিত হয়। অর্থনীতিবিদ জে. এফ. র্যাগান ও এল. বি. থমাস বলেন, ‘Socialistic Economy: an economic system in which property is publicly owned and central authorities co-ordinate economic decisions’.[16] সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হ’ল এরূপ একটি অর্থব্যবস্থা যেখানে সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পল এ. স্যামুয়েলসনের মতে, ‘Socialism refers to the government ownership of the means of production, planning by the government and income distribution.[17] সমাজতন্ত্র বলতে বুঝায় উৎপাদনের সরকারী মালিকানা, সরকারী পরিকল্পনা এবং আয় বণ্টন। কেউ কেউ বলেন, Socialism is a populist economic and political system based on public ownership (also known as collective or common ownership) of the means of production.[18] সমাজতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় (যদিও সমষ্টিগত বা সাধারণ মালিকানা হিসাবে পরিচিত) উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে একটি জনবহুল অর্থনৈতিক ও রাজনেতিক ব্যবস্থা।
অতএব যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীনে সকল প্রকার অর্থনৈতিক কার্যাবলী পরিচালিত হয় তা হ’ল সমাজতন্ত্র। এ অর্থব্যবস্থা মনে করে, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণ করে। সমতাভিত্তিক বণ্টন এবং শোষণ নির্মূল করার জন্য সমাজতন্ত্র মতবাদটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
গ. তুলনামূলক পর্যালোচনা
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানায় সীমাহীন অধিকারের ভিত্তিতে অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইচ্ছামত সম্পদ উপার্জন ও ভোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার তুলনায় অধিকতর সুষ্ঠু উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ জনগণের যথাযথ আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে পলিসি অবলম্বন করে। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি প্রচলিত অর্থনীতি থেকে যথেষ্ট পৃথক ও ভিন্ন। ইসলামী অর্থব্যবস্থা এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে শুধু মানুষের বস্ত্তগত জীবনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণজনিত ইতিবাচক অর্থনীতিকে (Positive Economics) ব্যাখ্যা করে না, বরং ইহকাল ও পরকালের সমন্বিত কল্যাণ লাভের জন্যই মানবিক ন্যায়নীতিকেও বিশ্লেষণ করে।
উৎস :
প্রচলিত অর্থব্যবস্থা (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র) মানব কর্তৃক সৃষ্ট নিয়ম-কানূন। তাই এক্ষেত্রে ভুল ও সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। এসব নিয়ম-কানূনের কোনরূপ স্থিতি নেই, বরং সর্বদা পরিবর্তন ঘটে। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রচিত। তাই এতে কোন ধরনের ভুল বা সন্দেহের অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ ২/২)।
নিয়ম-কানূন :
প্রচলিত অর্থব্যবস্থা (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র¿) মানব সৃষ্ট নিয়ম-কানূন দ্বারা পরিচালিত হয়। এ অর্থব্যবস্থা স্থির নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়ে থাকে। আর নির্দিষ্ট সময়ান্তে ঘরানার তথা সনাতনী বিধি হিসাবে পরিগণিত হয়। তাই নয়া ক্লাসিক্যাল (Neo-Classical) অর্থনীতিবিদের জনক অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) বলেন, ‘Economic laws are to be compared with the laws of tides rather than with the simple and exact laws of gravitation.[19] অর্থনীতির নিয়মগুলো মাধ্যাকর্ষণের সাধারণ ও যথাযথ নিয়মের তুলনায় জোয়ার-ভাটার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থার নিয়ম-কানূন চিরন্তন সত্য এবং স্থির, যা স্বয়ং আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত।
সম্পদের মালিকানা :
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের সর্বময় সিদ্ধান্ত ব্যক্তিমালিকানায় বিদ্যমান। এখানে দরিদ্র, অসহায়, ফকীর শ্রেণীর লোকের কোনরূপ কল্যাণকর দিক নির্দেশ করে না। বরং ধনীরা আরো ধনী হয় এবং গরীবেরা আরো গরীব হয়। সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। উপকরণের মালিকানা কোন ব্যক্তির হাতে থাকে না। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অর্থনৈতিক সব সিদ্ধান্তের কার্যক্রম গৃহীত হয়। তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তির মেধা, প্রজ্ঞা ও দক্ষতা রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের নিকট দলিত-মথিত হয়। পক্ষান্তরে বিশ্বজগতের একক ও নিরঙ্কুশ মালিকানা মহান আল্লাহর। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষ পার্থিব সম্পদের উপর সাময়িক ও শর্তসাপেক্ষে অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামের এই নীতি বাস্তবায়ন হ’লে সম্পদের সুষম ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে। আল্লাহ্ বলেন, ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)।
জীবন পদ্ধতি :
পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হওয়ায় সমাজে শ্রেণী সংঘাত উপস্থিত হয়। ধনী-গরীবের ব্যবধান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সমাজের সার্বজনীন কল্যাণ সম্ভব হয় না। সমাজতন্ত্রেও তথাকথিত সর্বহারার একনায়কত্ব দেখা দেয়। তাই এ অর্থব্যবস্থায়ও শ্রেণী সংঘাত বিদ্যমান। অন্যদিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মানুষ শুধু সম্পদের আমানতদার হিসাবে সর্বক্ষেত্রে মানবিক সৎ গুণাবলীর চর্চা করে। তাই এখানে শ্রেণী সংঘাত দেখা দেয় না।
স্বাধীনতা :
পুঁজিবাদে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা নেই। আর সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি থাকলেও রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা থাকে না। অপরপক্ষে ইসলামী অর্থনীতিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তি ও স্বাধীনতা আছে।
উৎপাদনের লক্ষ্য :
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনের লক্ষ্য থাকে মুনাফা অর্জন করা। আর সমাজতন্ত্রে সামাজিক কল্যাণ ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি সাধন করার লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন করা হয় সমস্ত মানুষের মেŠলিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘আর তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক ছিল’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। এজন্য ইসলাম গরীব, অসহায় ও নিঃস্ব, যাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করে থাকে।
উৎপাদন পদ্ধতি :
পুঁজিবাদে উৎপাদনকারীর সার্বভেŠমত্ব রয়েছে বিধায় তারা যে কোন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে পারে। এমনকি জনগণের জন্য ক্ষতিকর যেমন: মদ, গাঁজা, আফিম, হিরোইন, ইয়াবা প্রভৃতি উৎপাদন পুঁজিবাদে হ’তে পারে। সমাজতন্ত্রে¿ ব্যক্তিমালিকানায় কোন উৎপাদন হ’তে পারে না। তাই ব্যক্তিগত উৎপাদনের স্বাধীনতা এ অর্থব্যবস্থায় নেই। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাথে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও বজায় থাকে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন চলবে, যখন ব্যক্তিগত উদ্যোগ ক্ষতিকর প্রমাণিত না হয়। ইসলামী অর্থনীতিতে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে উৎপাদন পরিচালিত হয়।
ভোক্তার সার্বভৌমত্ব :
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ভোক্তা স্বীয় উপযোগ সর্বোচ্চকরণের জন্য যে কোন পরিমাণ দ্রব্য-সামগ্রী ও সেবা ভোগ ও ক্রয় করতে পারে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে ভোক্তা তার উপযোগ সর্বোচ্চকরণের নিমিত্তে যে কোন পরিমাণ দ্রব্য-সামগ্রী ও সেবা ভোগ ও ক্রয় করতে পারে না। কারণ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নিজের ইচ্ছাকে ভোক্তার উপর চাপিয়ে দেয়। ফলে ভোক্তার সার্বভৌমত্ব খর্ব হয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে চলতে হয়। তবে ব্যক্তি বা ভোক্তা আল্লাহর বিধান মতে পরিমিত পরিমাণ হালাল পণ্য উৎপাদন ও ভোগের স্বাধীনতা লাভ করে। আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করেনা বা কুপণতা করেনা। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)।
জীবিকা অর্জন :
প্রচলিত অর্থনীতিতে (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র) জীবিকা নির্বাহের জন্য সৎ কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়নি। তাই ব্যক্তি অপরাধ বা অন্যায়মূলক কর্মে নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু ইসলামে সৎ পথে জীবিকা নির্বাহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন, ‘অতঃপর ছালাত শেষ হ’লে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। আর তোমরা আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ কর যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (জুম‘আ ৬২/১০)। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন’।[20] তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ী সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেয়া কারো নিকট চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেউ দিতেও পারে, নাও দিতে পারে’।[21]
সম্পদের বণ্টন :
পুঁজিবাদে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত না হওয়ায় সমাজে ধনী ও গরীবদের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ফলে ধনীরা গরীবদের শ্রম শোষণ করে আরো ধনী হয় এবং গরীবেরা আরো গরীব হয়। বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০১টি দেশের মারাত্মক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিবেচনা করা হয়। এসব দেশের মধ্যে ৩১টি নিমণ আয়ের, ৬৮টি মধ্য আয়ের এবং দু’টি উচ্চ আয়ের দেশ। এসব দেশের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ বহুমাত্রিকভাবে দরিদ্র।[22] সমাজতন্ত্রে শ্রমিকের কাজের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী সম্পদ বণ্টিত (Distribution according to amount and quality of work) হয়। এর ফলে মজুরী এক হয় না। তাই এ ব্যবস্থায় শোষণ না থাকলেও আয় তথা সম্পদ বণ্টনে অসমতা আছে। পক্ষান্তরে ইসলামে ন্যায়বিচার ও ইনছাফপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ লক্ষ্যে যাকাত[23] এবং ওশর[24]-এর অর্থ দরিদ্র জনগণের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ধনী এবং গরীবের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য দূর হয়, যা অর্থব্যবস্থায় সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনে।
বিশেষ সম্প্রদায় :
প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র) কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা অমুসলিম নাগরিকের ব্যাপারে কোন বক্তব্য নেই। তাই তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ইসলাম অমুসলিম নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং জান-মালের নিরাপত্তা প্রদান করেছে।
সূদের লেনদেন :
প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র) সূদের লেনদেনকে বৈধ বিবেচনা করে এর সম্প্রসারণের প্রয়াস চালানো হয়। সূদ প্রথা সমাজে ধন বৈষম্যের জন্ম দেয়, উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না। ১৯৩০ সালের মহামন্দার মূল কারণও ছিল সূদের হার।[25] কিন্তু ইসলামে সূদকে বর্জন করে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে আর্থিক পুঁজিকে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে নিয়োগ করে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও আয় সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ সূদের সাথে শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনা প্রভৃতি অশুভ বিষয় সম্পৃক্ত থাকে। পবিত্র কুরআনে নির্দেশ আছে, আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সূদকে হারাম করেছেন (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) সূদদাতা, গ্রহীতা এবং এর লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন’।[26]
সামাজিক নিরাপত্তা :
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সামাজিক নিরাপত্তা নেই। এ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদীই অর্থনৈতিক সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে জনগণের ক্রয়ের সামর্থ্য না থাকলে তাকে অভুক্ত থাকতে হয়। সমাজতন্ত্রে মানুষের মেŠলিক অধিকারের বিষয়গুলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এখানে জনকল্যাণমূলক ব্যয় বাদ দিয়ে অবশিষ্ট আয় দ্বারা মজুরী তহবিল (wage fund) এবং গণভোট তহবিল (public consumption fund) গঠন করা হয়। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামী অর্থনীতির সর্বাপেক্ষা আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)। তিনি আরো বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত’ (নিসা ৪/২৯)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান করো, তাও ভালো। আর যদি গোপনে দরিদ্রদের দাও, তবে তা অধিকতর ভালো। এমনটি করলে তোমাদের বহু পাপ মুছে দেয়া হবে। তোমরা যাই করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে যে অর্থ সম্পদ দিয়েছেন তার দ্বারা আখিরাতের আবাস (জান্নাত) অনুসন্ধান করো এবং পার্থিব জীবনে তোমার বৈধ (ভোগের) অংশও ভুলে থেকোনা। (মানুষের) কল্যাণ করো, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আর (অর্থ সম্পদ দ্বারা) দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের আল্লাহ পসন্দ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৭)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (স্রষ্টার পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হবে না’।[27] তিনি আরো বলেন, ‘বান্দা ততক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ ঐ বান্দার সাহায্যে থাকেন’।[28]
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক :
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে বৈরী মনোভাব গড়ে ওঠে। কারণ মালিকের হাতে সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকায় শ্রমিক তার পরিশ্রমের তুলনায় কত মজুরী পায়। অর্থাৎ মালিক শোষকের ভূমিকায় এবং শ্রমিক শোষিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শ্রমিকরা যাতে সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারে তার দিকে নযর দেয় না। এক্ষেত্রে মূল্য ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং মজুরী রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত হয়। তাই সমাজতন্ত্রে সামরিক কায়দায় উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। সেখানে শ্রমিককে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে ইসলামই সর্বপ্রথম শ্রমিককে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামী শ্রমনীতিতে মালিক, ব্যবস্থাপক ও শ্রমিক পরস্পর ভাই হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অর্থনীতিতে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় থাকে এবং কোন উৎপাদনশীল কর্মকান্ড হ’তে প্রাপ্ত মুনাফা মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টিত হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, মানুষ তাই (পরিশ্রম) পায় যা সে করে’ (নাজম ৫৩/৩৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন ‘শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার পূর্বে তোমরা তার মজুরী দিয়ে দাও’।[29]
মজুরী নির্ধারণ :
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মজুরী নির্ধারিত হয় বাজার শক্তি, চাহিদা ও উৎপাদনশীলতার উপর নির্ভর করে। শ্রমিকের মেŠলিক চাহিদা উপেক্ষিত হয়। সমাজতন্ত্রে¿ মজুরী নির্ধারিত হয় শাসক ও আমলা শ্রেণী কর্তৃক। যা শ্রমিককে বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে বাজার শক্তি ও জীবনযাপনের মানভিত্তিক মৌলিক চাহিদার সমন্বয়ে মজুরী নির্ধারিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও ন্যায়দন্ড। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে’ (হাদীদ ৫৭/২৫)। তাই শ্রমিকের মজুরী নির্ধারণের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যাতে শ্রমিক তার প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায়।
নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও ন্যায়দন্ড। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে
যাকাত :
প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র¿) যাকাতের কোন স্থান নেই। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি যাকাতভিত্তিক। যাকাত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি। ইসলামী বিশ্বকোষ-এর ভাষ্যমতে, পবিত্র কুরআনে ৩২ বার যাকাতের কথা এসেছে। এর মধ্যে ছালাত ও যাকাতের কথা একত্রে এসেছে ২৮ বার। ফুওয়াদ আবদুল বাকী বর্ণনা করেছেন, কুরআনে মোট ১৯টি সূরায় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়।[30] যাকাত ছাড়া ইসলামী আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা কখনো সম্ভব নয়। ব্যক্তি জীবনে যাকাত যেমন প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও তার বিকল্প নেই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও’ (বাক্বারাহ ২/৪৩, ৮৩, ১১০, ২৭৭; নিসা ৪/৭৭, ১৬২; নুর ৫৬; আহযাব ৩৩; মুজ্জাম্মিল ২০)। যাকাতের অর্থ গরীব, অসহায়, ফকীর, দরিদ্র ও নিঃস্ব লোকের মধ্যে বণ্টন করলে ধনী-গরীবেব মধ্যে সম্পদের বৈষম্য থাকে না।
রাষ্ট্রের ভূমিকা :
পুঁজিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকা যৎসামান্য। সমাজতন্ত্রে¿ রাষ্ট্রের মধ্যস্থিত সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকা একমাত্র রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয় নির্দেশে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে আল্লাহ ও রাসূল প্রদত্ত বিধান রাষ্ট্র যাতে কারো প্রতি যোর-জবরদস্তি করার বিধান নেই। বাস্তবায়ন করে।
রাজস্ব ব্যবস্থা :
প্রচলিত অর্থনীতিতে (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র¿) রাজস্ব ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এবং করই হচ্ছে এর মোক্ষম উপায়। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতির রাজস্ব ব্যবস্থারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আয়ের সুষম বণ্টন এবং গরীব, অসহায় ও নিঃস্ব লোকেদের মধ্যে মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যাকাত, ওশর, ছাদাকায়ে ফিতর[31] প্রভৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কোন অর্থব্যবস্থা সর্বোত্তম :
ধনতন্ত্র¿ সমাজে সম্পদ বৈষম্য, শ্রম শোষণ, অতি উৎপাদন, উৎপাদন ও উপকরণের অপচয়, বেকারত্ব, বাণিজ্য চক্র, শ্রমিক পীড়ন, শ্রমিক-মালিক বিরোধ, অপরিকল্পিত উৎপাদন ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন। ফলশ্রুতিতে বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তর দু’টি ধনী ও গরীব গোষ্ঠীর সৃষ্টি হচ্ছে। তাই পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মানুষ সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়ে একটি বিপদ থেকে অন্য একটি মহা বিপদে পতিত হয়। সমাজতন্ত্র ব্যক্তি ও ভোক্তার স্বাধীনতা বিলুপ্তি, কর্মস্পৃহা লোপ, পরিচালনা দক্ষতা, আগ্রহ হ্রাস, নব আবিষ্কার ও সৃজনশীল চেতনার হ্রাস, মূল্য ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সঙ্কুচিত, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব ও ব্যাপক দুর্নীতি প্রভৃতির জন্ম দেয়। এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এককভাবে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ ব্যাহত হয়। শেষ পর্যন্ত আবার রাষ্ট্রীয় শোষণ ও বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে সমাজতন্ত্রের লোকেরা ছুটে যায়। প্রচলিত অর্থব্যবস্থার শোষণের যাতাকলে মানবসম্পদ আজ বিশ্বে নিষ্পেষিত। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশের সরকার কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে চায়। এহেন রাষ্ট্র নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দারিদ্র্য হ্রাস করা। কিন্তু প্রচলিত অর্থনীতিতে দারিদ্রে্যর সংখ্যা দিনে দিনে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ প্রচলিত অর্থনীতি মানব সৃষ্ট; যার উপর ভিত্তি করে কোন দেশের অর্থনীতি সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এ অর্থনীতিতে নিমণবিত্ত, নিমণ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও এমনকি ধনী দেশগুলোতে শ্রেণী বৈষম্য খুবই বেশী। প্রচলিত অর্থব্যবস্থার কুফল হিসাবে বিশ্বব্যাপী মহামন্দা শুরু হয় ১৯২৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে। এটা বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময়ব্যাপী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী মন্দা। একবিংশ শতাব্দীতে মহামন্দাকে বিশ্ব অর্থনীতির পতনের উদাহরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।[32] কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রবর্তিত ইনছাফভিত্তিক অর্থব্যবস্থা অনুসরণ করে আববাসীয় যুগে ইসলামী সাম্রাজ্য প্রভূত আর্থিক উন্নতি সাধন করেছিল, একথা ঐতিহাসিক সত্য। সে যুগে যে শান্তি ও প্রগতি স্থাপিত হয়েছিল তাতেই প্রমাণিত হয়, ইসলামী অর্থনীতি ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশী সমাজকল্যাণমূলক। বর্তমানে বিজ্ঞানের যুগে ইসলামী অর্থনীতির সুফল আরো ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় আধুনিক কর ব্যবস্থা যেরূপ কর ফাঁকি ও অসম বণ্টনের সম্মুখীন হচ্ছে তা ইসলামী ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কারণ এটা আল্লাহর সৃষ্ট অর্থনীতি হওয়ার কারণে এটা নির্ভুল, নিরপেক্ষ ও সর্বোৎকৃষ্ট।
উপসংহার :
আজ একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের যুগে বিশ্ব মানবকে তুলনামূলকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে, কোন অর্থব্যবস্থা সকল সময়ের জন্য সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সামগ্রিকভাবে কল্যাণকর। ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবায়নে এ বিশ্বে থাকবে না নিঃস্ব, ফকীর, দরিদ্র, অসহায়, ক্রীতদাস, বেকারত্ব, বৈষম্য, শ্রম শোষণ, অপচয়-অপব্যয়, সূদ-ঘুষ, মজুদদারী, কালোবাজারী, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, চুরি, ডাকাতি, ব্যক্তি মালিকানা, আয় বৈষম্য, তীব্র প্রতিযোগিতা, মালিক-শ্রমিক বিরোধ, অসম বণ্টন, বিশেষ সম্প্রদায় বা অমুসলিমদের নিরাপত্তাহীনতা, কার্পণ্য, অসৎ কর্ম, মৌলিক অধিকারের অনিশ্চয়তা, শ্রমের অমর্যাদা, দুর্নীতি, সম্পদের অপব্যবহার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অতি মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন, একচেটিয়া কারবারি, অর্থনীতির বন্ধাবস্থা, বাণিজ্য চক্র, শ্রমিক নিপীড়ন, অপরিকল্পিত উৎপাদন, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিলুপ্তি, কর্মস্পৃহা লোপ, সৃজনশীল চেতনা হ্রাস, ত্রুটিপূর্ণ মূল্য ব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব প্রভৃতি। কিন্তু ইসলামে উক্ত বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে নিষেধ ও বর্জনীয় যা দ্বারা প্রচলিত অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ফলে বিশ্বব্যাপী আজ প্রচলিত অর্থনীতি দারিদ্রে্যর কষাঘাতে বন্ধাবস্থায় আসীন রয়েছে। আর ইসলামী অর্থনীতি প্রচলিত অর্থব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কুরআন ও সুন্নাহর বিধি-বিধান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে বিশ্বকে এক অদ্বিতীয় অর্থ ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। Dennis Sarant তাঁর ‘History of Religion’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘ইসলাম আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে সম্পূর্ণ সক্ষম। এর মহান নীতিসমূহ সহজ ও যুক্তিপূর্ণ’।[33]
[1]. খন্দকার আবুল খায়ের, অর্থনীতিতে ইসলামের ভূমিকা, পৃ. ৫।
[2]. কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)।
[3]. Timur Kuran. 2004. Islam & Mammon: The Economic Predicaments of Islamism. Third printing, ed. Princeton: Princeton University Press, 89.
[4]. Ibid, 3.
[5]. Ibid.
[6]. https://www.rashtrakutas.com/2019/08/capitalism.html.
[7]. হাওলাদার আবদুর রাজ্জাক, অর্থশাস্ত্রের কথা, পৃ. ৩৬।
[8]. Wikipedia.
[9]. ইউকিপিডিয়া।
[10]. রণজিত কুমার নাথ, অর্থনীতি, প্রথম পত্র, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী, পৃ. ১৭।
[11]. Wikipedia.
[12]. https:// www. Pathagar.com/book/detail/241/4.
[13]. Dr. S. M. Hassanuz Zaman, Definition of Islamic Economics, Journal of Research in Islamic Economics, Jeddah, Winter, 1984, p. 52.
[14]. Federal Reserve Bank of St. Louis. “Factors of Production – The Economic Lowdown Podcast Series, Episode 2,” Accessed Nov. 18, 2019.
[15]. J. F. Ragan & L. B. Thomas, Principles of Macroeconomics, p. 41.
[16]. J. F. Ragan & L. B. Thomas, Principles of Macroeconomics, p. 41.
[17]. http://www.economicsdiscussion.net/economy/socialist-economy-meaning-and-features-of-socialist-economy/2070.
[18]. Iivestopida.
[19]. A. Marshall, Principles of Economics, Macmillan, London, 1959, p. 26.
[20]. বুখারী হা/২০৭২; মিশকাত হা/২৭৫৯।
[21]. বুখারী হা/২০৭৪, ১৪৭০; মুসলিম হা/১০৪২।
[22]. জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ১১ জুলাই ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন।
[23]. কোনো মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হ’লে বছরান্তে তার সম্পদের শতকরা ২.৫০ হারে নির্দিষ্ট খাতে সম্পদ ব্যয় করাকে যাকাত বলে। বিস্তারিত দেখুন, ড. মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থার সুফল।
[24]. ওশর ইসলামী অর্থনীতিতে আয়ের অন্যতম উৎস। ওশর শব্দের অর্থ এক দশমাংশ (১/১০)। উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ নিছাব (১৮মণ ৩০ কেজি) পরিমাণ বা তার বেশী হলে, সেচ দেওয়া জমিতে ২০ ভাগের ১ভাগ এবং সেচ বিহিন জমিতে ১০ ভাগের ১ ভাগ বের করে দরিদ্রদের দিতে হয়। একেই ওশর বলে। দ্র. মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থার সুফল।
[25]. মো. গোলাম মোস্তাফা, ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ৪।
[26]. মুসলিম, হা/৭৫৯৭।
[27]. বুখারী হা/৫৯৯৭, ৬০১৩; মুসলিম হা/১৩১৮; আবূদাঊদ হা/৫২১৮; মিশকাত হা/৪৬৭৮।
[28]. মুসলিম হা/২৬৯৯; আবূদাঊদ হা/৪৯৪৬; মিশকাত হা/২০৪।
[29]. ইবনু মাজাহ হা/২৪৪৩; ইরওয়া হা/১৪৯৮; মিশকাত হা/২৯৮৭, সনদ ছহীহ।
[30]. ফুওয়াদ আবদুল বাকী, আল-মু‘জামূল মুফহারাস লি আলফাযিল কুরআনিল কারীম (কায়রো : দারুল হাদীস, ১৯৮৮ খ্রী.), পৃ. ৪২০-৪২১।
[31]. রামাযান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের দিন প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি গরীবদের মধ্যে ফিতরা বাবদ বন্টন করে তাই ১ ছা‘ বা ২১/২ কেজি খাদ্য ছাদাকায়ে ফিৎর। ইসলামি অর্থনীতির দৃষ্টিতে একেও রাষ্ট্রীয় আয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
[32]. হেদায়েত উল্লাহ, ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং, পৃ. ৩৬।
[33]. মোহাম্মদ তানভীর আহম্মেদ ও অন্যান্য ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ১৬।
সংগৃহীত।