সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি
আমাদের সমাজে কিছু বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে সুদবিহীন অর্থনীতির বাস্তবায়নের কথা বেশ জোরে-শোরে বলে থাকেন। তারা জেনে বুঝে এমন বলেন, না এর মধ্যে কোন কূটচাল রয়েছে তা বোঝা ভারী মুশকিল। কারণ ইসলামী অর্থনীতি প্রসঙ্গে এরা রীতিমত নির্বাক। বাস্তবে সুদবিহীন অর্থনীতি কোনক্রমেই ইসলামী অর্থনীতির বিকল্প হতে পারে না। ইসরামী জীবন বিধান সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণার কারণেই সুদবিহীন অর্থনীতির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন এসব বুদ্ধিজীবীরা। ইসলাম যে এক সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং আমর বিল মা’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার যে জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তুর বা Comer Stone, তাওহীদ, রিসালাত আর আখিরাত যার মুল দর্শন, সেই মৌলিক বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকার কারণেই প্রধানতঃ চিন্তার এই দুর্বলতা বা ভ্রান্তি দেখা দেয়। যথাযথ জ্ঞানের অভাব বিশেষতঃ মূল উৎস হতে না জানার কারণে পরের শেখানো বুলি আওড়াতে এদের সংকোচ বা আড়ষ্টতা দেখা দেয় না। বরং বাহাদুরী করে নিজেদের ‘নতুন কথা’ জাহির করার প্রবণতাই এক্ষেত্রে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়।
অনেকে মনে করেন এবং জোর গলায় বলেনও- সেক্যুলার বা প্রচলিত অর্থনীতি হতে সুদ প্রত্যাহার করে নিলে ইসলামের সঙ্গে তার দূরত্ব দূর হয়ে যাবে। সুদ বিবর্জিত এই অর্থনীতিই হবে ইসলামী অর্থনীতি। এ ধরনের কথা সবচেয়ে বেশী শোনা যেত যখন সমাজতন্ত্র বেশ কয়েকটি দেশে পেশীশতির জোরে ক্ষমতায় ছিলো। কেউ কেউ আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতি প্রায় একই রকম এমনও মত প্রকাশ করতোত। তবে এসব প্রচারণা যে এক অর্থে গভীর দুরভিসন্ধিমূলক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ যুগে যুগে মুরতাদরা ও ইহাদী-খৃস্টানদের কাছে বিবেক বিক্রি করে দেওয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা েইসলামের লেবাস ধরে ভিতর থেকেই তার শিকড় কেটে তাকে তিলে তিলে দুর্বল তথা ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।
িইসলামী অর্থনীতি বলতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সামগ্রিক এক জীবন ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতি বলতে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তাহলো, প্রচলিত অর্থনীতি হতে শুধু সুদকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। অর্থনীতির অন্যান্য প্রসঙ্গে ইসলামের যে নির্দেশ তথা শরীয়াহর বিধি-নিষেদ প্রতিপালিত হবে কিনা সে ব্যাপার কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা সেখানেই নেই। তাই সেই অর্থনীতি যে প্রকৃতই ইসলামী অর্থনীতি হয়ে উঠতে অক্ষম তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই ধরা পড়বে। এই দুইধরনের অর্থনীতিরমধ্যে রয়েছে মেরুপরিমাণ ব্যবধান। নিচে সেই ব্যবধানের কারণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।
প্রথমতঃ ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তির সাথে সুদবিহীন অর্থনতির দর্শনের কোনই মিল নেই। কারণ তওহীদ রিসালাত ও আখিরাত ইসলামী অর্থনীতির মৌল দর্শন। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তারা এ ধরনের কোন দর্শনের কথা বলেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা প্রচুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সুদকে উচ্ছেদ করাই যথেষ্ট বলে মনে করেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থনীতিতে যে ভোগবাদী দর্শন সতত কার্যকর, ব্যক্তিপূজা তথা ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থতা যার সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু তা পরিত্যাগ বা উচ্ছেদের কোন কথা তারা বলেন না। পরকালনি মুক্তি অর্জনের জন্যেই যে ইহকালীন প্রচেষ্টা চালানো অতি আবশ্যক এই সত্য সম্বন্ধে তারা রহস্যজনকভাবে নীরব। বস্তুতঃ দার্শনিক ভিত্তির ভিন্নতাই দুই অর্থনীতির মধ্যে বিশাল ব্যধান সৃষ্টি করেছে। কোনভাবই এ দুয়ের মধ্যে সাযুজ্য যা যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামী অর্থনীতির সকল কার্যক্রমের ভিত্তি হলো যুগপৎ আমর বিল মাৎ’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উচ্ছেদের সর্ববিধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। অর্থনীতির যে কোন পদক্ষেপে, কর্মমৌশলে বা নীতিমালায় এর ব্যত্যয় ঘটলে তা হবে ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যায় ও যুলুমের উচ্ছেদ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতিতে এমন বৈশিষ্ট্য আদৌ লক্ষ্য করা যায় না। শুধুমাত্র সুদ বর্জনই তার লক্ষ্য, সমাজরে সর্বস্তরে কল্যাণ ও মঙ্গলবোধের প্রতিষ্ঠা তার কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য নয়। ফলে ইসলামী অর্থনীতি যে সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলময় এবং সুবিচারপূর্ণ অর্থনীতি তথা সমাজ জীবনের পরিচয় দেয় সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও লক্ষ্য করা যায় না।
তৃতীয়তঃ বর্তমান কালের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি যে ব্যাংক ব্যবস্থা তা থেকে শুধু সুদ প্রত্যাহার করে নিলেই কাঙ্খিত কল্যাণ লাভ আদৌ সম্ভব নয়। কারণ ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারী হওয়ার কারণেই ইসলামীব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো হারাম ও সমাজবিধ্বংসী কোন কাজে অংশ নেবে না বা সে ধরনের কোন কাজে বিনিয়োগও করবে না। কিন্তু সুদবিহীন অর্থব্যবস্থায় এ ধরনর কোন নিশ্চয়তার সুযোগ নেই। ব্যাংক বা ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সুদ না নিয়েও মুনাফার অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে সিনা হল তৈরী বা মদের কারখানা পরিচালনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করলে তাতে বাধা দেবার কেউ নেই। এখানে ইসলামী অর্থনীতির সাথে সুদবিহীন অর্থনীতিরি মৌলিক তফাৎ।
চতুর্থতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে সকল ক্ষেত্রেই হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলার প্রতি দৃঢ় লক্ষ্য রাখা যায়। হালাল বা বৈধ উপায়ে উপার্জন এবং বৈধ উপায়েই তা ব্যয়ের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়ে থাকে এই অর্থনীতিতে। এই অর্থনীততে হারাম উপায়ে উপার্জন তো পরিত্যাজ্যই, সেই সঙ্গে বৈধ উপায়ের উপার্জনও হারাম পথে ব্যয়ের কোন সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতিতে সুদের উচ্ছেদই একমাত্র বিবেচ্যে বিষয়, অন্য কিছু নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ভোগ বন্টন উপার্জন বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন নীতি-নৈতিকতা বা শেষ সীমার প্রশ্ন নেই। ভোগবাদী এই ব্যবস্থায় যেসব পন্থায় উৎপাদন বা যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজরে জন্য ক্ষতিকর ও শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং যেসব পন্থায় ব্যয় বা ভোগ সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকরী সেসবও ভাববার কোন কারণ নেই। এ বিষয়ে সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের নীরবতা এক কথায় রহস্যজনক।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, অবৈধ বা হারাম উপায়ে উপার্জন বন্টন বিনিয়োগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম ইসলামী অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ প্রধানঃ তিনটি। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের উদ্দেশে জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা পদ্ধতিতে যুলুম চালানো হয়। দ্বিতীয়তঃ চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকরী ও সমাজবিধ্বংসী কার্যক্রমসমূহ মূলতঃ এ ধরনের অবৈধ বা হারাম অর্থনৈতিক কার্যক্রমেরই ফসল। তৃতীয়তঃ অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়েই ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ধন-সম্পদ ব্যবহারের অর্থই হলো সামাজিক অবিচার ও পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। পরিণামে সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে হারাম উপায়ে উপার্জন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন- হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ। তিনি আরো বলেন- হারাম রুজী হতে উৎপন্ন রক্ত ও মাংস দোজখের আগুনের খোরাক।
পঞ্চমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও দাবী হলো যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের অন্যতম। এটি যথাযথভাবে পালিত না হলে ইসলামের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্যে রাসূলে আকরামের (স) মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যখন ভণ্ড নবীদের চাপের মুখে হযরত উমার (রা) পর্যন্ত সাময়িকভাবে যাকাত আদায় রহিত করার প্রস্তাব করেছিলেন সে সময় মুসলিম উম্মাহর প্রতম আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়তার সাথে যাকাত আদায়ের অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। যাকাতের মাধ্যমে যেমন সমাজে ধনবৈষম্য হ্রাস পায় তেমনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত জনগণ সামাজিক নিরাপত্তা লাভের সুযোগ পায়। সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থার প্রবক্তরা যাকাত আদায় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোনই মন্তব্য করেননি। এর প্রবক্তারা যেন ধরেই নিয়েছেন সুদ উচ্ছেদ হলেই গোটা অর্থনীতি ইসলামী হয়ে যাবে।
ষষ্ঠতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে কৃষিনীতি, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, বর্গাচাষ ও উশর আদায় সম্বন্ধে যে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ও তাগিদ রয়েছে সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও নেই। অথচ সমাজের বৃহত্তম অংশ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যাকাতের মত উশর আদায়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ধনবৈষম্য দূরীকরণ ও দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের কল্যাণ ও আর্থিক বুনিয়াদের নিশ্চয়তা না থাকলে শুধু গ্রাম অঞ্চলে নয়, সমগ্র সমাজ কাঠামোতেই বিপত্তি নেমে আসে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তীব্রতর হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় ভারসাম্যহীন। এর উপযুক্ত প্রতিবিধান করতে হলে কৃষি জমির মালিকানা, বর্গাচাষ, ভূমি রাজস্ব এবং উশর আদায় বিষয়ে ইসলামের নীতি-নির্দেশনা মানতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে কোন প্রকার মধ্যস্বত্বের অবকাশ নেই। জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি-সে জমি রাষ্ট্রেরই হোক বা ব্যক্তিরই হোক। উন্নত কষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ইসলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুদবিহীন অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ।
সপ্তমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অপর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর ঘোষণা অনুসারে উত্তরাধিকার নীতি বাস্তবায়ন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বের উত্তরাধিকার আইন ছিলে অস্বাভাবিক। পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ। খৃস্টান ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ সকল ধর্মেই মোটামুটিভাবে একই ধরনের প্রথা বিরাজমান ছিলো। এর পিছনে যে দর্শন কাজ করতো তা হলো সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থঅকবে। তা যেন বিভক্ত হয়ে অন্য মালিকানায় চলে না যায়। এভাবে পুরুষানুক্রমে সম্পত্তি একই পরিবারের দখলে থাকায় তাদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি তথা শোষণ ও পীড়নের সুযোগ থাকতো অব্যাহত ও অটুট। উপরন্তু মহিরারা ছিলো সর্বদাই বঞ্চিত। তারা যে সমাজের দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অর্ধাংশ এই সত্যটি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে স্বীকারই করা হতো না। ইসলামই সর্বপ্রথম সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি কন্যা স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সুদবিহীন অর্থনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গে কোন দিক নির্দেশনাই নেই। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে তারা পুঁজিবাদী উত্তরাধিকার পদ্ধতিরই স্বীকৃতি দিয়েছে যা যুলুমের নামান্তর।
অনুরূপভাবে অর্থনীতিতে আদল ও েইনসাফের প্রয়োগ, শ্রমিকদের অধিকার আদায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিধি ও প্রয়োগ, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ব্যাপারেও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এমনকি জনগণের মৌলিক পাঁচটি প্রয়োজন অন্ন বস্ত্র স্বাস্থ্য বাসস্থান ও শিক্ষা বিষয়েও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন পস্তুাবনা নেই, কোন কোন নীতি নির্ধারণী কৌশল। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে কঠোর তাগিদ রয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, উপায় থাকতেও যে স্বেচ্ছায় ভিক্ষা করে, কিয়ামতের দিন তার জঠর জাহান্নামের আগুনে ভরে যাবে। এরই বিপরীতে উপায়হীন ক্ষুধাতুর মানুষের দুঃসহ যাতনার কথা মনে রেখেই দয়ার নবী মুহাম্মদ (স) বলেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চাইলে আধখানা খেজুর হলও মিসকিনের হাতে তুলে দিও। নিরন্ন-বুভুক্ষ মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রখ্যাত মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, বায়তুল মালের তহবিল হতে দরিদ্র-নিরন্ন মানুষের এই প্রয়োজন মিটানো সম্ভব না হলে ধনীদের উপর আরো কর আরোপ করতে। তাতেও সংকুলান না হলে তাদের কাছ থেকে ধার নিতে। এ দরনের সুপারিশ বা নীতিমালা গ্রহণের নির্দেশনার লেশমাত্র লক্ষ্য করা যায় না সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের লেখায়-আলোচনায়।
বস্তুতঃ কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইহকালের জীবনকে পরকালের জন্যে পাথেয় উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এই নশ্বর জীবন যেন শুধু ভোড়-বিলাসেই শেষ না হয়ে যায়, বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ইহকালীন জীবন যেন শান্তি ও সমৃদ্ধির হয় এবং পরকালে জীবনে মুক্তি লাভ ও আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃত হওয়া যায় মুমিনের এই বাসনা চরিতার্থ করাই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার কোন অর্থনীতিরই –তা সে পুঁজিবাদই হেহাক বা সেক্যুলারই হোক কিংবা হোক সুদবিহীন- এই বৈশিষ্ট্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আন্দালুশিয়া হতে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী বিশাল ভূখণ্ডে দীর্ঘ নয়শত বছর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গৌরবোজ্জ্বল যুগে ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণময় স্পর্শে তখন না ছিলো শ্রেণীবৈষম্য, না ছিলো ক্ষুধাতুর মানুষের মিছিল। আজও সেই ইসলাম রয়েছে, রয়েছে মুসলমানরাও। তাদের মোট সংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু মুষ্টিমেয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বা দিলে তারা আজ পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনের দাসানুদাস। উপরন্তু মাযহাবী ভিন্নতা ও নানা ধরনের শিরক ও বিদআত আজ ইসলামের প্রাণশক্তিকে গ্রাস করেছে। ইসলাম আজ ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। তাকে শৃংখলমুক্ত করতে পারলে আবারো মুসলিম জাহাহনে ফিরে আসবে তার হৃত গৌরব, সৃষ্টি হবে নতুন এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।