আল কুরআনের পরিচয়
কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহর কিতাব ও বাণী। মানবজাতির জন্য হেদায়েতের পথপ্রদর্শক। ইসলামের সর্বোচ্চ সংবিধান। এ বিধান অনুসরণেই মানজাতির মুক্তি ও সফলতা। আর এর অস্বীকারকারীরাই মহান আল্লাহর শত্রু ও কাফের। যাদের ঠিকানা চিরস্থায়ী জাহান্নাম। চলুন জেনে নিই পবিত্র কুরআনের পরিচয় বা পবিত্র আল কোরআন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনেই কি বলা হয়েছে।
কুরআন শব্দের অর্থ:
‘কুরআন’ শব্দটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে। যেমন-
(ক) ইমাম শাফেঈ এর মতে কুরআন শব্দটি বিশেষ্য, যার কোনো অর্থ নেই। এই মতামতটি অধিকাংশ উলামার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
(খ) অনেকের মতে কুরআন শব্দটি এসেছে ‘কারানা’ থেকে যার অর্থ একত্রিত করা। যেহেতু আয়াত ও সূরাকে একত্রে নিয়েই কোরআন গঠিত, তাই এই মতামত অনুসারে কোরআন শব্দের অর্থ ‘একত্রিত গ্রন্থ’। এই মতামতটিও অপেক্ষাকৃত কম উলামার কাছে গ্রহণযাগ্য।
(গ) সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামতটি এরকম: কুরআন শব্দটি এসেছে ‘কারাআ’ শব্দ থেকে। ‘কারাআ’ শব্দের অর্থ হলো পাঠ করা। কাজেই কুরআন শব্দের অর্থ হল ‘যাকে পাঠ করা হয়’।
পারিভাষিক অর্থ:
কুরআন পারিভাষিক অর্থ নির্ণয় একটি কঠিন বিষয়। কেননা তা মহান আল্লাহ তায়ালার কালাম, যা সংজ্ঞায়ন প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে। সে হিসেবে সংজ্ঞা নির্ধারণের তর্কশাস্ত্রিক নীতিমালা অনুসরণ করে পবিত্র আল কুরআনের সংজ্ঞা নির্ধারণ আদৌ কোনো সহজ ব্যাপার নয়।
তবে আলেমগণ পবিত্র আল কোরআনকে অন্যান্য পুস্তক থেকে আলাদা করার জন্য সাধ্যমত এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত মহান আল্লাহর বাণী, যার তিলাওয়াত ইবাদত হিসেবে গণ্য।
কেউ কেউ বলেছেন, মহান আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম ‘আল কোরআন’। (আল মুজামুল ওয়াসিত ও মায়ারিফুল কোরআন, বাংলা, মূল- মুফতি শফী (রহ), বাংলা অনুবাদ: মাওলানা মুহীউদ্দীন আহমেদ)
কোরআনের কিছু বৈশিষ্ট্য:
(১) পবিত্র কুরআন অন্যান্য কিতাবের মত এক সঙ্গে লিখিত আকারে পাঠানো হয়নি। নবীজির ২৩ বছরে জীবনে বিভিন্ন অবস্থাকে সামনে রেখে কিছু কিছু করে বক্তৃতার আকারে নাযিল হয়েছে।
(২) গোটা পবিত্র কুরআনের বিষয় ভিত্তিক কোনো নাম নেই। এর সব কয়টি নামই গুণবাচক। যেমন: কোরআন (যা পাঠ করা হয়, যা পড়া কর্তব্য)। ফুরকান (যা হক ও বাতিলের পার্তক্য দেখিয়ে দেয়)। নূর (যা সঠিক জ্ঞান অর্জনের যোগ্য আলো দান করে)। যিকর (যা নির্ভুল উপদেশ দান করে, যা ভুলে যাওয়া শিক্ষা মনে করিয়ে দেয়)। আল কিতাব (একমাত্র কিতাব যা ‘লাওহি মাহফুযে’ হেফাজত করা আছে)।
(৩) ১১৪টি সূরার মধ্যে ৯টি সূরা ছাড়া ১০৫টি সূরার বিষয়ভিত্তিক নাম নেই। শুধু পরিচয়ের জন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। সূরার কোনো একটি শব্দ বা অক্ষর থেকেই নামকরণ করা হয়েছে।
(৪) নিম্নের নয়টি সূরার নাম ও আলোচ্য বিষয় দেয়া হলো- (১) আর রাহমান (২) আল মুনাফেকুন (৩) আত তালাক (৪) নূহ (৫) জ্বিন (৬) আল কিয়ামাহ্ (৭) আল কাদর (৮) আল কারিয়াহ (৯) আল ইখলাস।
শেষ সূরাটির নাম সূরার মধ্যে নেই। এ নামটি গুণবাচক। অন্যন্য সূরার নাম যে শব্দে রাখা হয়েছে তা সূরা থেকেই নেয়া হয়েছে।
(৫) পবিত্র কুরআনের ভাষা সংক্ষিপ্ত। যিনি পাঠিয়েছেন তিনিই এর সঠিক অর্থ জানেন। যার কাছে পাঠানো হয়েছে তাঁকেই সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তাঁর শেখানো অর্থই একমাত্র নির্ভরযোগ্য।
কুরআনের গড়ন:
পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ১১৪টি সূরা রয়েছে। সকল সূরা মিলিয়ে মোট আয়াতের (আয়াত আরবি শব্দ, এর অর্থ নিদর্শন) সংখ্যা প্রায় ৬২৩৬ (মতান্তরে ৬৩৪৮টি অথবা ৬৬৬৬টি)। প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে মোট ৩০টি পারা বা অধ্যায় রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরাগুলো বিভিন্ন আকারের হলেও পারাগুলো প্রায় সমান আকারের। পবিত্র কুরআন মুখস্থকরণের ক্ষেত্রে সাধারণতম পারা অনুযায়ী শিক্ষা দেয়া হয়। যে সকল স্থানে সমগ্র পবিত্র কুরআন পাঠের আয়োজন করা হয় সেখানেও এই পারা অনুযায়ী করা হয়।
কুরআন মহান আল্লাহর কিতাব:
মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানবতার হেদায়াতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলা হয়। পবিত্র আল কোরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা বিশ্বমানবতার জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় এ কোরআন বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা আশ-শু‘আরা-১৯২)
কুরআনের ভাষা:
পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণই আরবি ভাষায় নাযিলকৃত। এটি সম্পূর্ন আরবি এবং এতে কোনো বিদেশি শব্দ নেই। ইমাম শাফী’ তার আর-রিসালাহ গ্রন্থে বলেন, ‘আল কুরআন এই দিক নির্দেশনা দেয় যে, আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশই আরবি ভাষার বাইরে নয়। যারা এ ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন যে, কুরআনে অনারব শব্দ বিদ্যমান, তারা হয়তো কিছু শব্দ পেয়েছেন যা কিছু আরবের কাছে অপরিচিত। কিন্তু যেহেতু শব্দগুলো কুরআনে এসেছে, তাই সেসব শব্দ আরবি শব্দ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
অসংখ্য আয়াত এ নির্দেশনা দেয় যে পবিত্র কুরআন সম্পূর্ন আরবি ভাষায় নাযিলকৃত। যেমন: ‘বিশ্বস্ত রুহ একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার হৃদয়ে যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হন। সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।’ (সূরা শু’আরা: ১৯৩-১৯৫)
‘এমনিভাবে আমি এ কুরআনকে আরবি ভাষায় নির্দেশরুপে নাযিল করেছি।’ (সূরা রাদ: ৩৭)
‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি।’ (সূরা শুরা: ৭)
‘আরবি ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে।’ (সূরা যুমার: ২৮)
‘আমরা তো ভালোভাবেই জানি যে, তারা বলে: তাকে জনৈক ব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত দেয় তার ভাষাতো আরবি নয়, এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায়। (সূরা নাহল: ১০৩)
আল কুরআনের নাম:
পবিত্র আল কুরানের নাম সর্বমোট কয়টি এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। যারকাশি তার ‘আল বুরহান ফি উলুমিল কুরআন’ গ্রন্থে আল হাররালির বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, তিনি আল কুরআনের ৯০ এর অধিক নাম উল্লেখ করেছেন। (যারকাশি, আল বুরহান ফি উলুমিল কোরআন, ১/২৭৩)
তবে যারকাশি নিজে তার গ্রন্থে কেবল ৫৫টি নাম উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ফায়রুয আবাদি বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনের একশত নাম উল্লেখ করেছেন। (ফায়রুয আবাদি, বাসায়ের যুবিত তাময়ীয, ১/৮৮) তবে তিনিও কেবল ৯৩টি নাম উল্লেখ করেছেন।
ড. খামসাবি ৭২টি মূল শব্দ থেকে রূপান্তরিত ৯৯টি নাম উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে সালেহ আল বালিহি (রহ.) মাত্র ৪৬টি নাম উল্লেখ করেছেন। তার বিশ্বাস যে, আল কুরআনের অধিকাংশ নাম প্রকৃত অর্থে আল কুরআনের বিশেষণমাত্র। তা আল কুরআনের নাম হিসেবে আসেনি। (সালেহ আল বালিহি, আল হুদা ওয়াল বায়ান ফি আসমাইল কোরআন, পৃ ৪৪, ফাহদ আররুমি থেকে সংগৃহীত, পৃ ২৬)
আলোর পথ দেখায় কুরআন:
অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য পবিত্র আল কুরআন হলো আলো বা নূর। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।’ (সূরা মায়িদাহ-১৫,১৬)
কুরআনের হেফাজতকারী কে?
কুরআন সংরক্ষণ করার দায়িত্ব মহান আল্লাহ তায়ালার। এটি যাবতীয় বিকৃতি থেকে মুক্ত। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা এর সংরক্ষণ করবেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয় আমি উপদেশ বাণী তথা কোরআন নাজিল করেছি এবং নি:সন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই’। (সূরা আল-হিজর-৯)।
মানবজাতির জন্য হেদায়াত:
আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার প্রতিটি বিষয় পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমার নিকট কিতাবটি নাযিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ’। (সূরা আন নাহল: ৮৯)
কখন নাজিল হয়?
কুরআন রমজান মাসে লাইলাতুল ক্বদরে অবতীর্ণ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: ‘রমজান এমন মাস যাতে নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যা বিশ্ব মানবতার জন্য হেদায়াত ও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য বিধান কারী’। (সূরা আল বাকারাহ:১৮৫)
মুমিনদের জন্য রহমত:
কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে নাযিল করা হয়েছে। যারা এ কোরআন পড়বে, তা অনুযায়ী আমল করবে তারা মহান আল্লাহর রহমাতপ্রাপ্ত হবে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়’ (সূরা বনি ঈসরাইল:৮২)।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস:
কুরআন মাজীদ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। এবং কুরআন যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নির্ভুল ও বাস্তবভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘ইয়াসীন। বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ’। (সূরা ইয়াছিন:১-২)
বিশ্ববাসীর জন্য চ্যালেঞ্জ:
পবিত্র কুরআনের মতো কোনো কিতাব মানুষ বা কারো পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। প্রায় চৌদ্দশত বছর আগের চ্যলেঞ্জ এ পর্যন্ত কেউ মুকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি। আর কিয়ামত পর্যন্ত তা সম্ভবও হবে না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘বল, যদি মানব ও জ্বীন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআন অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’। (সূরা বনি ঈসরাইল: ৮৮)