আল কুরআনের পরিচয় ও সংরক্ষণ ইতিহাস
মানব অন্তর কালিমাযুক্ত হয়ে কঠিন হয়ে যায়। দুনিয়ার প্রাচুর্যের মোহ ও প্রবৃত্তির চাহিদা নফসকে দুর্বল ও অসাড় করে ফেলে। মানুষকে এ পৃথিবীতে নফস, প্রবৃত্তি ও শয়তানের সাথে যুদ্ধ ও সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। একজন যোদ্ধাকে যদি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকার অস্ত্রের মুখাপেক্ষী হতে হয় তাহলে চিরন্তন সফলতা যে যুদ্ধে বিজয় লাভের উপর নির্ভরশীল এমন যুদ্ধের যোদ্ধাকে অবশ্যই সক্রিয় ও কার্যকর অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে। আর তা হচ্ছে স্বীয় নফসকে সংশোধন ও পবিত্রকরণ। এ ক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ আল কোরআন ভিন্ন অন্য কোন পথ ও পদ্ধতি নেই।
শুধু তিলাওয়াতই কুরআনের হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তিলাওয়াতের পাশাপাশি একে বুঝতে হবে- বুঝার চেষ্টা করতে হবে, হিফয করতে হবে, বর্ণিত বিষয়াদিতে চিন্তা গবেষণা করতে হবে, তদনুযায়ী আমল করতে হবে, শাসন, বিচার ও বিরোধ-মীমাংসার জন্য তার শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার হল লোকেরা এর তিলাওয়াতকেই যথাযথ মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করছে। এর চেয়েও দু:খজনক হচ্ছে- যারা তিলাওয়াতকে যথেষ্ট মনে করছে তাদের অধিকাংশই এ তিলাওয়াতের ব্যাপারে অবহেলা-উপেক্ষা করছে। বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে যায় অথচ পূর্ণ বৎসরে একবারও কোরআন খতম করতে পারে না। একটিমাত্র সূরাও মুখস্থ করে না।
পার্থিব সাধারণ বই-পুস্তক এমনকি আসমানী কিতাবও সংরক্ষণজনিত অসুবিধার কারণে বিনষ্ট হয়ে যায়। যেমন- তাওরাত, ইঞ্জিল ও অন্যান্য আসমানী সহীফাগুলো এভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু কুরআনুল কারীমকে এভাবে বক্ষাভন্তরে সংরক্ষণের জন্য মুখস্থ করার প্রতি বেশী গুরুত্ব দেয়া হত। প্রথম প্রথম যখনই ওহী নাযিল হত, তখনই রাসুল (স.) কুরআনের শব্দগুলোকে বার বার উচ্চারণ করতেন, যাতে তা ভালোভাবে স্মৃতিস্থ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়- তাড়াতাড়ি শিখে নেওয়ার জন্য আপনি ওহী আবৃত্তি করবেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমরই দায়িত্বে, (সূরা কিয়ামাহ, ১৬-১৭)। এ আয়াতে সুস্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় কুরআনুল কারীমকে মুখস্থ করার জন্য কুরআনের শব্দগুলো রাসূলের (সা.) বারবার উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। রাসূলের (সা.) মাঝে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এমন তীক্ষ স্মৃতিশক্তি সৃষ্টি করে দিবেন যে, একবার ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি সেটাকে আর ভুলবেন না। এমনকি অবস্থা এমন শক্ত হয়ে দাঁড়ালো যে, একদিকে তার উপর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হচ্ছে, অন্যদিকে তা তাঁর স্মৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে রাসুলের (সা.) পবিত্র বক্ষ কুরআনে কারীমের এমন সুরক্ষিত ভান্ডারে পরিণত হয় যে, তন্মধ্যে সামান্যতম সংযোগ বিয়োগ কিংবা ভুল-চুক হওয়ার কোন আশংকা ছিল না। কেননা আল্লাহ তায়ালাই এর হেফাযতকারী। এরপরও অধিকতর সাবধানতার খাতিরে প্রতিবছর রমযান মাসে অহী বহনকারী ফেরেশতা হযরত জিবরাঈলকে (আ.) কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করে শোনাতেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) থেকেও তা শুনে নিতেন। তাঁর ইন্তেকালের বছর রমযানে তিনি দুই দুবার হযরত জিবরাঈলকে (আ.) শোনান এবং জিবরাঈল (আ.) থেকেও শোনেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) সাহাবায়ে কিরাম তাদের বয়স্ক শিশু, নারী-পুরুষ কুরআনে কারীমের শুধু মর্মার্থই শিক্ষা দিতেন না। বরং তাদেরকে কুরআনের শব্দও স্মৃতিস্থ করাতেন। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও কুরআনে কারীম মুখস্থ করা এবং তাফসীর অনুধাবন করার এমন প্রবল আগ্রহ ছিল যে, প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন। এমনকি মহিলারা পর্যন্ত বিবাহের মোহরানার বিনিময়ে কুরআনের তালীম দেওয়ার দাবী পেশ করতেন। শত শত সাহাবী সব কিছু ছেড়ে শুধুমাত্র কুরআনে কারীমের তালীম গ্রহণ করার সাধনাতেই আহলুস সুফফাদের সঙ্গে তাদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তারা কুরআনুল কারীম শুধুমাত্র মুখস্থই করতেন না, নিয়মিত রাত জেগে, নফল নামাজে তিলাওয়াতও করতেন, বাস্তব জীবনে আমলও করতেন। হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বর্ণনা করেন যে, মক্কা থেকে কেউ হিজরত করে মদীনা এলেই তাঁকে কুরআনে কারীমের তা’লীম গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কোন একজন আনসার সাহাবীর সাথে যুক্ত করে দেওয়া হত। মসজিদে নববীতে সর্বক্ষণ কুরআন শিক্ষাদান ও তিলাওয়াতের শব্দ এমনভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত হুযুর (সা.) নির্দেশ দিলেন যে, সবাই যেন আরো ধীরে ধীরে এবং নি:স্বরে কুরআন পাঠ করেন, যাতে পরস্পরের তিলাওয়াতের মাঝে দ্বন্দ্ব না হয়।
পূর্ব থেকেই অসাধারণ মেধাশক্তির জন্যে আরব জাতি সারা বিশ্বে সম্মানী ছিল। দীর্ঘ এক শতাব্দিকাল পর্যন্ত গুমরাহির অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকার কুরআনুল কারীমের ঐ নির্দেশনার মহান সম্পদ ভাগ্যে জুটেছিল, যা তাদের জীবনের সবচেয়ে বেশী প্রিয় মূলধন হিসেবে বিবেচ্য ছিল। তাঁরা তা আয়ত্ব করার জন্য কতটুকু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শ্রম-সাধনা ব্যয় করেছিলেন, তাদের মিজায ও স্বভাব সম্বন্ধে অবগত ব্যক্তিরাই কেবল তা অনুধাবন করতে পারেন। এমনকি সামান্য কয়েক দিনে সাহাবায়ে কিরামের বিশাল সংখ্যার একটি হাফেয দল তৈরি হয়ে গেলেন। বিভিন্ন বর্ণনামতে জানা যায় যে, হাফেযদের এ বিশাল দলে হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর (রা.), হযরত ওসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত সাআদ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.), হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আমর ইবনুল আস (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.), হযরত মুয়াবিয়া (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়িব (রা.), হযরত আয়েশা (রা.), হযরত উম্মে সালমা (রা.), হযরত হাফসা (রা.), হযরত উম্মে সালমা (রা.), হযরত উম্মে ওরাকাহ (রা.), হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.), হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.), হযরত আবু হালীমা মাআযা (রা.), হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.), মুসলিমা ইবনে মুখাল্লাদা (রা.) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.), হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.), হযরত তামীম আদ্ দারী (রা.), হযরত আবু মূসা আশআরী (রা.) ও হযরত আবু যায়েদের (রা.) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
এগুলো শুধুমাত্র ঐ সমস্ত সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র নাম, যাদের নাম রেওয়ায়েতে হাফেযে কুরআন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। অন্যথায় সমগ্র কুরআন মুখস্থকারী এমন অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম রয়েছেন, যাঁদের নাম রেওয়ায়েতে ঠাঁই পায়নি। হযরত রাসূল (সা.) কখনো কখনো কুরআনে কারীমের তালীম দেওয়ার জন্য সত্তরজন করে মুয়াল্লিম ক্বারী সাহাবা শহীদ হওয়ার উল্লেখ রেওয়ায়েতে বিদ্যমান। রাসূলের (সা.) ইন্তিকালের পর ইয়ামামার যুদ্ধে সাত শত সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন।
উল্লিখিত সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন সমগ্র কুরআন মুখস্থকারী। আর যে সমস্ত সাহাবায়ে কিরামকে মুখস্থ করানোর সাথে সাথে আমল করার বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। প্রাথমিক যুগের এ অবস্থায় এ পদ্ধতিটিই বেশি সংরক্ষণযোগ্য ভরসাপোযোগী ছিল। কারণ তখন শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য। বই-পুস্তক প্রকাশের উপযোগী ছাপাখানা এবং অন্য কোন উপায় উপকরণের অস্তিত্বও ছিল না। সুতরাং সে অবস্থায় যদি শুধু লেখার উপর নির্ভর করা হতো, তাহলে কুরআনে কারীমের সংরক্ষণ করা যেমন জটিল হয়ে পড়ত, তেমনি ব্যাপক প্রচারের দিকটিও নি:সন্দেহে অসম্ভব হয়ে পড়ত। তাছাড়া আরবদের স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, এক এক ব্যক্তি হাজার হাজার কাব্যগাঁথা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতে পারত। কুরআন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ঘরে ঘরে পবিত্র কুআনের বাণী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এ পদ্ধতির মাধ্যমে কত দ্রুত কুরআনে কারীমের প্রচার-প্রসার- তা একটি ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়। ঘটনাটি হচ্ছে- হযরত আমর ইবনে সালমা (রা.) নববী যুগে খুবই অল্প বয়স্ক সাহাবী ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল একটি ঝর্ণার পাশে। এখান দিয়ে মুসাফিরগণ আসা-যাওয়া করতো, বিশ্রাম করতো। তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। তখনো তিনি মুসলমান হননি। কিন্তু পার্শ্ব দিয়ে যাতায়াতকারী মুসলিম মুসাফিরদের কণ্ঠে কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও সূরা শুনে শুনে মুসলমান হওয়ার পূর্বেই কুরআনুল কারীমের বিশেষ একটি অংশ তাঁর মুখস্থ হয়েছিল।
মহান আল্লাহ হযরত আদমকে (আ.) পৃথিবীতে প্রেরণের সময় ঘোষণা করেছিলেন- সে অনুযায়ী যুগে যুগে হেদায়েতের আলো নিয়ে নবী রাসূলগণ এসেছিলেন। এ ধারার সর্বশেষ এবং চিরস্থায়ী বিধান আল-কুরআন নিয়ে রাসূলগণের নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.) আগমন করেন। যেহেতু এ কিতাবের পর আর কোন কিতাব আসবেনা, তাই আল কুরআনের সংরক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব তিনিই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর এ সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা আল কুরআন অবতারণার পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছে।
প্রথমত: সংরক্ষিত ফলক তথা লাওহে মাহফুজে একে মহান রব নিজের ইলম থেকে সংরক্ষণ করেন, (বুরুজ, ২১)। এখানে মহান রব হাজার হাজার ফিরিশতা এ কাজে নিয়োগ দিয়ে সর্বত্তোম সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন।
দ্বিতীয়ত: একইভাবে মহান রব বায়তুল মামুরেও কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন, হাজার হাজার ফিরিশতার মাধ্যমে। যাতে তার মহান মর্যাদা সংরক্ষিত হয়। এছাড়াও মহান রব কিয়ামাত পর্যন্ত এঁকে সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, (সূরা হিজর, ৯)।
তৃতীয়ত: কুরআনে কারীমে যেহেতু একসাথে অবতীর্ণ হয়নি বরং বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনমত অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে- তাই নববী যুগে কুরআনুল কারীমকে গ্রন্থাকারে একত্রে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়াও আল্লাহ তাআলা অন্যান্য আসমানী কিতাবের মুকাবিলায় কুরআনে কারীমে এ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, কাগজ কলম দ্বারা যতটুকু সংরক্ষণ করেছেন তারচেয়ে বেশি সংরক্ষণ করেছেন হাফেযে কুরআনগণের বক্ষ দ্বারা। যেমন রাসূলকে (সা.) লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা বলেন: আমি তোমার উপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছি, পানি যাকে ধুয়ে মিটিয়ে দিতে পারবে না, (মুসলিম, ৫১০৯)।
পৃথিবীতে অনেক মুসলিম আছেন- যারা তার পক্ষে যতটুকু সহজ ততটুকু শুধুমাত্র তিলাওয়াতকেই কোরআনের যথাযথ হক আদায় ও মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। তাদের সম্পর্কে ইমাম হাসান বসরী (র.) চমৎকার বলেছেন- “কুরআন তদনুযায়ী আমল করার জন্য অবতীর্ণ হল আর লোকেরা শুধু তিলাওয়াতকেই আমল বানিয়ে বসে আছে”।
লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী