আল কুরআনের বৈশিষ্ট্য
বিষয় বস্তুর পরিপাট্যে, বর্ণনা রীতির মাধুর্যে, ভাষা শৈলীর স্বাতন্ত্রে কুরআন এক অনবদ্য ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান আসমানী গ্রন্থ। নিম্নে এর মাহাত্ম ও গুণ-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
অভ্রান্ত গ্রন্থ:
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এ গ্রন্থ সর্বপ্রকার সংশয়, সন্দেহ মুক্ত, ত্রুটিহীন একমাত্র অভ্রান্ত গ্রন্থ। মানব রচিত গ্রন্থের ভূমিকাতেই ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। পরবর্তী সংস্করণে ভুল-ত্রুটি দূর করার জন্য সুহৃদয় পাঠকের সহযোগীতা কামনা করে মানবিক দুর্বলতা প্রকাশ করা হয়।কিন্তু কুরআন তার ব্যতীক্রম।কিতাবের শুরুতেই স্বয়ং কুরআন দ্বর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে,
ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ
‘এটা সেই কিতাব যা মধ্যে কোন সন্দেহ নেই’। (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত নং-২)।
পূর্নাঙ্গ জীবনবিধান:
আল-কুরআন মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ বলেন, …………..’এ কিতাবে আমি কোন কিছু লিপিবদ্ধ করা বাদ রাখিনি। (সূরা আল-আনআম, আয়াত নং-৩৮)। কুরআনের মধ্যে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কোন মানব রচিত গ্রন্থ নয় :
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন যে হুবুহু আল্লাহর বাণী তাতে কোন সন্দেহ নেই। তদুপরি কুরআন নাযিলের প্রাক্কালে কিছু স্বার্থান্ধ মানুষ এটা ‘মানুষের রচনা’ বলে অপপ্রচার চালায়। এতে আল্লাহ তাদের ও তাদের অনাগত বংশধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি আমার বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি, তাতে তোমাদের যদি কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে তার অনুরূপ কোন সূরা রচনা করে আন’ (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-২৩)।
কুরআনের দুশমনরা এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে লিখতে ও বলতে বাধ্য হয়েছে-………… না, এটা কোন মানুষের বাণী নয়।
অবিকৃত গ্রন্থ :
পবিত্র কুরআনের পূর্বেকার সকল আসমানী গ্রন্থই কোন না কোন ভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু কুরআন নাযিলের প্রথম দিন থেকে আজ অবধি অবিকৃত অবস্থায় আছে এবং ক্বিয়ামাত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে ইনশাআল্লাহ। কেননা স্বয়ং আল্লাহ এর হেফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করে বলেছেন,
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ [١٥:٩]
‘আমিই কুরআন নাযিল করেছি আর আমিই তার সংরক্ষণকারী’ (হিজর ৯)
সর্বাধিক সঠিক ও সম্মানিত গ্রন্থ:
দুনিয়ার সবচেয় বেশী পঠিত গ্রন্থ হচ্ছে আল-কুরআন জগতের অন্য কোন গ্রন্থই এত বেশী মানুষ পাঠ করে না। প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ নানাভাবে এই গ্রন্থ পাঠ করছে। এটা বিশ্বের সর্বাধিক সম্মানিত গ্রন্থ। কোন গ্রন্থকে মানুষ এত সম্মান দেখায় না; যেমনভাবে দেখায় মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্স:
কুরআন কেবলমাত্র ধর্মী গ্রন্থই নয়; বরং সর্বপ্রকার জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও আবিষ্কারের মূল উত্স।দুনিয়ার সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান কুরআন হতেই উত্সারিত। আল্লাহ বলেন,
يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُم بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِي الْمُؤْمِنِينَ فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ [٥٩:٢]
‘হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ কর। (হাশর ২)
কুরআন নাযিলের সময়কাল:
কুরআন একদিনে একত্রে নাযিল হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে তা একটু একটু ও অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছে। সর্বসম্মত মত হচ্ছে- আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাদান মাসের লায়লাতুল ক্বাদরে। আল্লাহ বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ
‘ এই সেই রামাদান মাস, যার মধ্যে কুরআন নাযিল হয়েছে’ (বাক্বারাহ ১৮৫)
অন্যত্র বলা হয়েছে,
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ
‘আমি তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে’ (দুখান ৩)।
বলা হয়েছে,
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ [٩٧:١]
‘আমি এটা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে (ক্বাদর ১)।এই তিন আয়াত পরষ্পর যোগসূত্রে গ্রথিত। কুরআন রমযান মাসে লায়লাতুল ক্বাদরে নাযিল হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।তবে লায়লাতুল ক্বাদর রামাদানের কত তারিখ ছিলে তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়।
কোন কোন গবেষক বলেন, সে দিন ছিল রমাদান মাসের সতের বা সাতাশ তারিখ। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার জাবালুন নূরে নির্জন গুহায় আল্লাহর ইবাদাতে গভীরভাবে তন্ময় হয়ে থাকতেন এবং তখন তার বয়স হয়েছিল ৪১ বছর। মুসনাদে আহমাদের একটি হাদীস উদ্ধৃত করে ইবনে কাসীর বলেছেন, কুরআন রমাদান মাসের ২৪ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছে।
তাফসীর ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে, অর্ধ রামাযানে কুরআনে কারীম দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয এবং ‘বায়তুল ইযযায়’ রাখা হয়। অত:পর প্রয়োজন মত ঘটনাবলী ও প্রশ্নাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হতে থাকে এবং বিশ বছরে পূর্ণ হয়। অনেকগুলো আয়াত কাফিরদের কথার উত্তরেও অবতীর্ণ হয়।
কুরআন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। নাযিল হওয়ার উপলক্ষ বা কারণ সমূহ শানে নুযূল নামে অভিহিত।
রাসূল (সা)-এর প্রতি সর্বপ্রথম সুলা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়।এরপর প্রায় তিনবছর কোন ‘ওয়াহী’ নাযিল হয়নি। এরপর রাসূল (সা)-কে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের কাজ শুরু করার ও লোকদেরকে সতর্ক করার নির্দেশ দিয়ে আয়াত ও সূরা সমূহ ক্রমাগত নাযিল হতে থাকে এবং তা ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহাজ্জ পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সময়টির মেয়াদকাল ২২ বছর ১ মাস ২২ দিন বলে উল্লেখ আছে।