ডা. জাকির নায়েক ও সমকালীন প্রসঙ্গ
ডা. জাকির আবদুল করীম নায়েক একজন ইসলাম প্রচারক। সারা বিশ্বেই সমাদৃত ও স্বনামধন্য সম্মানিত একজন দাঈ। এতে সন্দেহ সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। একেবারে নিরেট ও নির্জলা প্রতিষ্ঠিত সত্য এটিই। বিশেষ করে সেকুলার মেন্টালিটির আধুনিক শিক্ষিত নাস্তিক-মুরতাদ, ব্লগার ও বিধর্মীরা একের পর এক ইসলামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ নানা রকম ভিত্তিহীন প্রশ্ন ও অভিযোগ দায়ের করে যখন ইসলামকে একটি নড়বড়ে ধর্মরূপে কলুষিত প্রমাণ করার ব্যর্থ কসরত করে আসছিলো, তখন সেই মুহূর্তে তাদের মতো করেই ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও এর একটি শক্তিশালী দালিলিক ভিত্তি উপস্থাপন এবং এর সাম্য-মৈত্রী ও নিষ্কলুষ নির্মল আদর্শ তুলে ধরা ছিল সময়ের অপরিহার্য দাবী। প্রয়োজন ছিল ডা. জাকির নায়েকের মতো তুখোড় মেধাবী একজন কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন পার্সনের। আল্লাহ্ তাআলা তার মাধ্যমে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন। বস্তুত এ ছিল বিশ্বের সকল তাওহীদবাদী মুসলিমের পক্ষ থেকে কূফফারদের গালে একটি সজোরে শক্ত চপেটাঘাত। আমরা এর ফলও প্রত্যক্ষ করছি। বড় বড় নাস্তিক, রাম, বাম ও বহু সাধারণ মানুষ চেঞ্জ হয়ে গেছে, জেনারেল পাড়ার লোকেরা ইসলামের সত্য গ্রহণে উজ্জীবিত হচ্ছে, যাদেরকে আমাদের ইসলামী পাড়ার ট্রেডিশনাল ওয়াজ ও বক্তব্য টানতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আমি ডা. জাকির নায়েকের পক্ষে একচেটিয়া সাফাই গাইছিনা। বলছিনা যে, তার কোন ভুল নেই। তিনি নিষ্পাপ! সত্যকে অকপটে স্বীকার করতে আমি কখনো হীনমান্যতায় ভুগিনা। সুতরাং ডা. নায়েক ভুলের উর্ধে কেউ নন। যেমন অন্যরাও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। বস্তুত আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। সঙ্গত কারণেই আমি তার কিছু মতের সাথে একমত নই। তাই বলে তাকে আমি কখনও শত্রু মনে করিনা। বরং তাকে আমি ইসলামের একজন বড় দায়ী, বন্ধু ও সম্পদ মনে করি। মুসলিমদের জন্য একটি রহমত ও নেয়ামত মনে করি। আপনি হয়তো বলবেন, ডা. নায়েক বিতর্কিত কিছু মাসআলা আলোচনা না করলেও পারতেন। হয়তোবা আপনি সঠিকই বলছেন। তথাপিও সামগ্রিক বিবেচনায় তার ভুলের সংখ্যা ৪/৫ পার্সেণ্টের বেশী দেখা যায়না। বিপরীতে দেখা যায় আমাদের মুনাযেরে যামান, শাইখুল ফুকাহা, মুফতিয়ে আযম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক অমুক তমুকের ভুলের ফিরিস্তি ডা. নায়েক থেকেও দীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর। কুফর ও শিরকে সয়লাব থাকে তাদের বয়ান। অথচ এসব নিয়ে কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনা। ইমানী চেতনার জোশের নারা এখানে জাগ্রত হয়না! দেখিনা বজ্রকন্ঠের তীব্র কঠিন হুশিয়ারী! একি জ্ঞানপাপ না অন্ধভক্তি কে বলবে? আমার কাছে মনে হয়, সমাজে বাহিত বিবেকহীন বিবেক, মেধাহীন মেধা, অযোগ্য অপরিপক্ব বিদ্যার পরনির্ভরশীলতা, কথিত আঁকাবেরমোহ ও বড়ভক্তির যে দুর্দশা চলছে এ কেবলই তার নিষ্ঠুর নাযরানা।
আরো একটি বিষয় হল, আজকাল কথায় কথায় ডা. নায়েককে ভণ্ড, ইসলামের শত্রু , ইহুদী খৃস্টানদের দালাল, ইত্যাদি ট্যাগ লাগানো ডান পাড়ায় একটি ইলমী ইতরামি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যে কারণে তারা তার প্রতি ইনসাফ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ইলমী গভীরতা ও অন্তরে উম্মাহর উদারতা থাকলে এ ধরণের কথা কীভাবে বলা যায় জানিনা! জানিনা এটি ইসলামের কোন রীতিনীতির মধ্যে পড়ে! তবে হ্যাঁ এ কথাও সত্য যে, ডা. নায়েকের ইসলামী ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মুষ্টিমেয় কিছু আত্মমভরী অনুসারী নিজেদেরকেই একমাত্র হক মনে করে থাকেন, এটিও অগ্রহণযোগ্য ও চরম আপত্তিকর।
সুতরাং ডা. নায়েক ও আমাদের মাঝে প্রাকটিক্যালী বা কানুনিক্যাল বা মৌলিক কোন পার্থক্য ভুলের এই পয়েন্টটিতে নেই। তবে একটি পরিষ্কার কারেক্টারিক্যাল বা আদর্শিক ভিন্নতা অবশ্যই আছে, ডা. নায়েক আহ্লুস সুন্নাহর কোন অংশকেই ৭২ কাতারে ফেলেন না। গোমরা, ফাসেক, কাফের বলে ফাতাওয়াবাজী করেন না। পাঠান না কাউকে জাহান্নামে। বিপরীতে আমরা পারলে তাকে এখনই ধরে বেধে জাহান্নামে দিয়ে আসি অবস্থা। মনে হয় জান্নাত জাহান্নামের ঠিকাদারি বুঝি আল্লাহ্ আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন!
অতঃএব বলতে দ্বিধা নেই যে, ডা. জাকির নায়েক শুধুমাত্র একজন ভিন্নমতালম্বী আর সুটেড বুটেড হওয়ার কারণেই স্পষ্টতই তার উপর জুলুম করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। অবিচার করা হয়েছে তার প্রতি অন্যায়ভাবে।
নির্দিধায় নিসংকোচে এও বলবো যে, আমাদের দীনতা, হীনতা, নিচতা, আদর্শিক দৈন্যতা আমাদেরকে বুদ্ধির দুর্ভিক্ষে পতিত করেছে। এর ফলে আমাদের বঙীয়দের অদূরদর্শিতা, বাস্তবতা উপলব্ধির অক্ষমতা, সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনা, ও ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসহনশীলতা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দরুন সময়ের একজন সৎ শরীফ মজলুম মুসলিম দাঈর বিপক্ষে যে অশুভ অজ্ঞতা ও বাস্তবতা বিবর্জিত বলয়ের অন্যায় অসত্যের নির্মম কষাঘাত চলছে তা কখনোই আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
পরিশেষে মহান আল্লাহ্ তাআলার একটি বাণী দিয়ে শেষ করছি: “আমি অবশ্যই বহু মানুষ ও জিনকে দোযখের জন্যে নির্ধারিত করেছি ; কারণ তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তারা সত্যকে উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ থাকলেও তা দিয়ে তারা সত্যকে দেখে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা সত্য বাণী শোনে না। ওরা পশুর মতো; বরং তার চেয়েও বেশী পথভ্রষ্ট; নিশ্চয়ই তারা উদাসীন”। (আল আরাফ-১৭৯)।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]