বিশ্বায়ন: মুসলিম সভ্যতা বিধ্বংসী সাম্রাজ্যবাদীদের এক নয়া কৌশল ও ইসলামের সার্বজনীন বিশ্বজনীনতা
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে ইঙ্গ মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীরা পুরো বিশ্বকে তাদের করতলগত করার জন্য গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের নামে বুদ্ধিভিত্তিক নতুন একটি তাত্ত্বিক আন্দোলনের সূচনা করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বানিজ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী আমেরিকার একক ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারই যার প্রকৃত লক্ষ্য। তবে এ লক্ষ্যের অন্তরালে তাদের মূল লক্ষ্য হলো দুনিয়া থেকে ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম অগ্রযাত্রাকে সমূলে ধ্বংস ও প্রতিহত করা। অন্যভাবে বললে বিশ্বায়ন হলো, ইয়াহুদী ও মার্কিনীদের বিশ্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ বা গ্লোবালাইজেশনের অন্তরালে মার্কিনাইজেশন। যার অর্থ হলো, রাষ্ট্র যার যার হুকুমত আমেরিকার!
ইসলামী বিশ্বের স্ট্রং ও পাওয়ার ফুল এবং কার্যকর নেতৃত্বকে হটিয়ে মেরুদণ্ডহীন, অযোগ্য, অপদার্থ ও দুর্বল, আমেরিকার গোলাম বা তাবেদার নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আসীন করাও এই পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বহুবিদ লক্ষ্যের একটি লক্ষ্য। যার ফলে মুসলিম দেশগুলো নামে মাত্র স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র থাকলেও কার্যত তা হবে আমেরিকারই অনুগত দাস রাষ্ট্র। কিন্তু আশ্চর্য সত্য হলো, পৃথিবীর সকল সরকারগুলোই আজ এই কায়েমী স্বার্থবাদীদের নিরঙ্কুশ অন্ধ সমর্থক। মাথা মোটা তোষামোদি অন্ধ মুসলিম শাসকরা তো এক্ষেত্রে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। আর ঠিক এভাবেই পাশ্চাত্যের চাটুকার মুসলিম আমীর ওমরা ও নেতাদের ক্ষমতার লালসা, নারী লিপসা, অর্থবিত্তের লোভ, বিলাসী জীবন ও সর্বোপরি আমাদের অসতর্কতার কারণে ধীরে ধীরে কল্পিত ও কথিত এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার অন্তরালে আমরা বিশ্বায়নের নামে ইয়াহুদী কল্পনা প্রসূত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ভয়ঙ্কর এক নব স্ট্রাটেজির নিষ্ঠুর কবলে নিপতিত হচ্ছি। ইয়াহুদী ও মার্কিনী জায়নবাদীরা আমাদেরকে এমন এক সংকীর্ণ পল্লীতে আবদ্ধ করে ফেলছে যেখান থেকে উঠে আসা হবে অত্যন্ত কঠিন ও দূরূহ ব্যাপার।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তাগুতের পদলেহনকারী মুসলিম সরকারগুলো ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যাই হোক আজ এ বিষয়টি অনুধাবন করছেনা বা করলেও ক্ষমতার সাদ আস্বাদনে বিভোর এই অপাংতেয়রা গদি রক্ষার মানসে তাদের মার্কিনী প্রভূদের তারা কোনভাবেই রুষ্ট করতে চায়না। যার ফলে ইসলামী বিশ্বের দিকে দিকে আজ ধ্বংসের দাবানল জ্বলছে। কোথাও শান্তি নেই। সস্তি নেই। নিরাপত্তা নেই। শুধুই গগনবিদারী হাহাকার আর আর হাহাকার!
ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানে ধ্বংসলীলা, নৈরাজ্য, ত্রাস ও জবর দখল, ২০১০ সালে তিউনিশিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্ত বা আরবের গণবিপ্লব, পরবর্তীতে মিশরে গণবিক্ষোভ ও হুসনি মোবারকের পতন, এরপর লিবিয়ায় বিক্ষোভ ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির ক্ষমতার অবসান, পরে ইয়েমেনে গণআন্দোলন এবং সর্বশেষ হালের আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের কাতার ট্রাজেডি এই সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিরই নির্মম আগ্রাসনের ফসল।
এভাবেই ইয়াহুদী ও মার্কিনী মোড়লরা তাদের বিশ্বায়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে একের পর এক মুসলিম সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আর চৈতন্যহীন মুসলিম শাসকরা নাকে তেল দিয়ে শরাব ও সুন্দরী ললনাদের বগলদাবা করে ঘুমুচ্ছে।
ইসলামের বিশ্বায়ন ও সার্বজনীনতা:
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নকে সমসাময়িক কালের ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় “আল-আওলামাহ”। আর ইসলামী বিশ্বায়নকে বলা হয় “আল আওলামাতুল ইসলামিয়্যাহ”
ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। আজকের ইয়াহুদী খৃস্টান ও সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের বিশ্বায়নের এই নতুন পরিভাষা ও স্লোগান চালু হওয়ার প্রায় চৌদ্দ শত বছর আগেই ইসলাম গোটা বিশ্বমানবতাকে ইসলামী বিশ্বজনীনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্বমানবতার মুক্তির মহান দূত রাসূলে আরাবি সা. জগতের সকল মানুষ ও মানবতার সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, সফলতা ও কল্যাণমুখী বাস্তবসম্মত ইসলামী বিশ্বায়ন বা বিশ্বজনীনতার প্রকৃত প্রবর্তক। বস্তুত আজ প্রকৃত সত্য হলো, ইসলামের পক্ষেই কেবল বিশ্বায়ন ও বিশ্বজনীনতার কথা মানায়। কেননা ইসলামের বিশ্বজনীনতায় রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েত, কল্যাণ ও রহমত। অন্যদিকে পাশ্চাত্তের পুঁজিবাদীদের বিশ্বায়ন হলো কর্তৃত্ববাদীদের ধোঁকা, প্রতারণা, জুলুম, নির্যাতন, অপশাসন ও শোষণের কালো হাতিয়ার। যা মূলত বিশ্ববাসীর জন্য একটি অভিশাপ। ইসলাম, ইসলামের নবী, কুরআন, ক্বিবলাসহ সবই বিশ্বজনীন। সার্বজনীন। মহাপ্রলয় পূর্বপর্যন্ত এর বিকল্প কোন থিউরি, নতুন কোন কনসেপ্ট, ভিন্ন কোন আদর্শের আইডিয়ার কোন সুযোগ নেই।
ইসলামের সার্বজনীনতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয়ই (কেয়ামত পর্যন্ত) ইসলামই হলো আল্লাহ্র নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা”। (আল ইমরান-১৯)।
বিশ্ব নবীর বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আর আমি তো আপনাকে (বিশ্বের) সমগ্র মানুষের জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি”। (সাবা-২৮)।
অন্যত্র বলেন, “বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার জন্য সেই আল্লাহর রাসুল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী”। (আল আরাফ-১৫৮)।
কুরআনের বিশ্বজনীনতা ও তার হিদায়াত সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “এটা তো (কুরআন) বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র”। (সা’দ-৮৭)।
পবিত্র কাবা শরীফের বিশ্বজনীন বরকত ও হিদায়াত সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা তো মক্কায়। তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের জন্য হিদায়াত”। (আলে ইমরান-৯৬)।
আর এভাবেই আল্লাহ্ তাআলা ইসলাম ও তার নবী, কুরআন ও কাবাকে সমগ্র মানবতার জন্য সার্বজনীন করেছেন। কোন আঞ্চলিকতা, জাতি, ধর্ম বর্ণ ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা, অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার, নীচতা, দীনতা, হীনতা ও কোন প্রকার বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার স্থান এখানে নেই। ইসলাম সর্বদায়ই পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি , ভালোবাসা, ঐক্য, সংহতি ও সাম্যের শিক্ষা দেয়। নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শিক চেতনার দীক্ষা দেয়। ইসলাম দ্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকিরের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। দুর্বলের ওপর সবলের, দরিদ্রের ওপর ধনীর, কালোর ওপর সাদার কোনো সম্মান ও আধিপত্য নেই। পৃথিবীর সকল মানুষই এখানে সমান। তাই ইসলাম মানুষকে কখনো ভাষা-বর্ণ, অঞ্চল ও জাতীয়তার ভিত্তিতে বিচার করেনা। এক্ষেত্রে তাকওয়া, আল্লাহ্ভীতি ও পরহেযগারিতাই একমাত্র মানদণ্ড। আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক খোদাভীরু”। (সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩)
পরিশেষে, বিশ্বায়ন ইসলামবিরোধী মতবাদ ও মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও ঈমানী শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসহ ব্যাপক পরিকল্পনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সকল জাগতিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি একটি নতুন বিপ্লব ও গণজাগরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। নবায়ন করতে হবে শিরক ও কুফুরি মুক্ত তাওহীদভিত্তিক নির্ভীক অনুপম আদর্শ ও প্রদীপ্ত চেতনার। ফিরে আসতে হবে আমাদের কুরআনের কাছে। রাসূ্ল সা. এর আদর্শের কাছে। তবেই একটি শক্তিশালী, কার্যকর, বাস্তবসম্মত ও বহুমুখী কল্যাণমূলক বিশ্বজনীন ইসলামের বিশ্বায়ন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]