ব্যবসায় ইচ্ছে মত কি লাভ করা জায়েয?
প্রশ্ন: ব্যবসায় ইচ্ছে মত কি লাভ করা জায়েয? যেমন ক্রয় মূল্যের ডাবল মূল্যে বা তার চেয়ে দিগুন/তিনগুণ/আরোও অধিক মূল্যে বিক্রি করলে জায়েয হবে কি?
উত্তর: ইসলাম ব্যবসায় লাভের নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নির্ধারিত করে দেয়নি। কোন পণ্যে কত লাভ করতে হবে এরূপ কোনো নির্দেশনাও কুরআন-হাদিসে পাওয়া যায় না। ইসলামে বিষয়টিকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কারণ লাভ নির্ণয়ের বিষয়টি নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবেশ, পরিস্থিতি, সাধারণ বাজারদর/ক্রেতা বিক্রেতার সন্তুষ্টির উপর। ক্রেতা-বিক্রেতা যে মূল্যের উপর সন্তুষ্টচিত্তে রাজি হবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍْ ﻻَ ﺗَﺄْﻛُﻠُﻮﺍْ ﺃَﻣْﻮَﺍﻟَﻜُﻢْ ﺑَﻴْﻨَﻜُﻢْ ﺑِﺎﻟْﺒَﺎﻃِﻞِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﺗَﻜُﻮﻥَ ﺗِﺠَﺎﺭَﺓً ﻋَﻦ ﺗَﺮَﺍﺽٍ ﻣِّﻨﻜُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﻘْﺘُﻠُﻮﺍْ ﺃَﻧﻔُﺴَﻜُﻢْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠّﻪَ ﻛَﺎﻥَ ﺑِﻜُﻢْ ﺭَﺣِﻴﻤًﺎ
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত’ (সূরা নিসা, আয়াত: ২৯)
হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
عن ابن عباس قال;قال رسول اللّٰه صلى اللّٰه عليه و سلم
“ﻻ ﻳﺤﻞ ﻣﺎﻝ ﺍﻣﺮﺉ ﻣﺴﻠﻢ ﺇﻻ ﺑﻄﻴﺐ ﻧﻔﺲ ﻣﻨﻪ”
নবী (সা.) বলেন: “কোন মুসলমানের জন্য অন্য কোনো মুসলমানের মাল তার অন্তরের সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল হবে না। (তালখিসুল হাবীর: ১২৪৯)
অন্য হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত,
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻈﻠﻢ ﻇﻠﻤﺎﺕ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ
নবী (সা.) বলেন: ‘তোমরা যুলুম থেকে বেঁচে থাক। কেননা যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে’ (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস: ১৮৬৫)।
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেল যে, যেকোনো ধরণের লেনদেনে উভয়ের সন্তুষ্টি অত্যাবশ্যক। এতএব ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টিতে যেকোনো মূল্যে লেনদেন করা যাবে, এতে মৌলিকভাবে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কোনো এক পক্ষের সন্তুষ্টি না থাকলে জোর করে বা তাকে বাধ্য করে তার সাথে লেনদেন করা বৈধ নয়। এটি জুলুম। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জুলুম হলেও যেহেতু ক্রয়-বিক্রয়ের নির্ধারিত শর্ত ইজাব-কবুল(বিক্রেতার প্রস্তাব ও ক্রেতার সম্মতি)পাওয়া যাচ্ছে, তাই এই বিক্রি/লেনদেন জায়েয হবে, সেই সাথে জুলুমের কারণে গুনাহ হবে।
তবে লাভের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা হাদিস থেকে লাভ করতে পারি। উরওয়া ইবনে আবিল জাদ আল-বারেকী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَرَضَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم جَلَبٌ فَأَعْطَانِى دِيْنَاراً وَقَالَ أَىْ عُرْوَةُ ائْتِ الْجَلَبَ فَاشْتَرِ لَنَا شَاةً. فَأَتَيْتُ الْجَلَبَ فَسَاوَمْتُ صَاحِبَهُ فَاشْتَرَيْتُ مِنْهُ شَاتَيْنِ بِدِيْنَارٍ فَجِئْتُ أَسُوْقُهُمَا أَوْ قَالَ أَقُوْدُهُمَا فَلَقِيَنِىْ رَجُلٌ فَسَاوَمَنِىْ فَأَبِيْعُهُ شَاةً بِدِيْنَارٍ فَجِئْتُ بِالدِّيْنَارِ وَجِئْتُ بِالشَّاةِ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذَا دِيْنَارُكُمْ وَهَذِهِ شَاتُكُمْ. قَالَ وَصَنَعْتَ كَيْفَ. قَالَ فَحَدَّثْتُهُ الْحَدِيْثَ فَقَالَ اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُ فِىْ صَفْقَةِ يَمِيْنِهِ.
‘নবী (সা.)-এর নিকট পশুর একটি চালানের সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দীনার দিয়ে বললেন, উরওয়া! তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের সাথে দরদাম করে এক দীনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক লোকের সাথে দেখা হয়। লোকটি আমার থেকে বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সাথে দরদাম করল। তখন আমি তার নিকট এক দীনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও একটি দীনার নিয়ে চলে এলাম। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! এই হচ্ছে আপনার দীনার এবং এই হচ্ছে আপনার বকরী। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এটা করলে কিভাবে? উরওয়া বলেন, আমি তখন তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার হাতের লেন-দেনে বরকত দিন’। (বুখারী, হাদিস: ৩৬৪২; আবূ দাঊদ, হাদিস: ৩৩৮৪; তিরমিযী হাদিস: ১২৫৮)
উল্লেখ্য, উক্ত সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষে ১০০% লাভ করা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) তার জন্য বরকতের দু‘আ করেছেন এবং এ দো‘আর ফলে উক্ত সাহাবী জীবনে প্রচুর বরকত লাভে ধন্য হয়েছেন। বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, উক্ত ছাহাবী মাটি ক্রয় করলেও তাতে লাভ হ’ত। সুতরাং মজুতদারী না করে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ক্রেতার স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছা সম্মতির ভিত্তিতে কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতা ১০০% লাভ করলেও শরী‘আতে কোন বাধা নেই। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতা বা ভোক্তা যেন যুলুমের শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরী।
লাভের সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন, সম্পদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে এতটুকু লাভ করা যায় যাতে ব্যবসায়ীর পরিবারের ভরণ-পোষণ, ব্যবসার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান ও ২.৫% যাকাত দেয়ার পর মূলধন অক্ষত থাকে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে দয়ার্দ্র, নম্র ও সদ্ব্যবহার পূর্বক ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করা অত্যন্ত নেক কাজ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى
‘আল্লাহ ঐ মহানুভব মানুষের প্রতি দয়া করেন, যে ক্রয়-বিক্রয়ে এবং নিজের পাওনা আদায়ে নম্রতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে’। (বুখারী, হাদিস: ২০৭৬, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ, হাদিস: ২২০৩; মিশকাত, হাদিস: ২৭৯০)
الثمن المسمى: هو الثمن الذى يسميه ويعينه العاقدان وقت البيع بالتراضى سواء كان مطابقا لقيمته الحقيقة أو ناقصا عنها أو زائدا عليها (شرح المجلة رستم باز-1/73، رقم المادة-153)
المرابحة بيع بمثل الثمن الأول وزيادة ربح… والكل جائز (الفتاوى الهندية-3/156 جديد، 3/160 قديم، المبسوط للسرخسى-22/78، 5/360، 4/357
মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।