কবর যিয়ারতের সুন্নাহ সম্মত নিয়ম
◼ মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্বরণ করার নিয়তে করব যিয়ারত করা।
ইসলামের শুরুতে কবর যিয়ারত করা নিষেধ ছিল। কারণ তখন মানুষ সবেমাত্র মূর্তিপূজা ত্যাগ করে মুসলিম হয়েছে, অতঃপর তা রহিত করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«كنتُ نهيتكم عن زيارة القبور، فزوروها فإنها تذكركم الآخرة»
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত থেকে নিষেধ করেছিলাম, তোমরা তা যিয়ারত কর। কারণ, কবর আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়”।
(সহীহ মুসলিম, ৯৭৭; আবু দাউদ, ৩২৩৫; তিরমিযী, ১০৫৪; নাসাঈ (৪/৮৯); আহমদ (৫/৩৫৬)। এ ছাড়া অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
◼ কবর যিয়ারতের দুআ পাঠ করা:
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ.
উচ্চারণ: ‘আসসলামু আলাইকুম আহলাদ দিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুসলিমিন, ওয়া ইন্না ইন শা আল্লাহু বিকুম লা লাহিকুন, নাসআলুল্লাহু লানা ওয়া লাকুমুল আ’ফিয়াহ।’ (সহীহ মুসলিম, মিশকাত)
অর্থ: ‘মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহর ইচ্ছায়, নিশ্চয়ই আমরাও শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো। আমরা তোমাদের জন্য এবং আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।’ (সহীহ মুসলিম: ১৬২০)
◼ মৃতদের গুনাহ-খাতা ও ভুলত্রুটি মোচনের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করা।
কুরআনে আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে মৃতদের জন্য দু’আ শিখিয়েছেন,
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
“হে আমাদের পালনকর্তা আমাদেরকে এবং আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করে দাও, যারা ঈমানের সাথে আমাদের আগে (দুনিয়া) থেকে চলে গেছে।1” (সূরা হাশর: ১০)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ
“সুতরাং জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই; ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার এবং মু’মিন নর নারীদের ত্রুটির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন। ” (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাফন ক্রিয়া শেষ করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেন:
اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ
“তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও। দু’আ কর যেন সে স্থির থাকতে পারে। কারণ, তাকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।” (সুনান আবূ দাঊদ: ২৮০৪)
মোটকথা, মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন-হাদিসে বর্ণিত দু’আসমূহ পাঠ করার পাশাপাশি নিজের ভাষায় যতখুশি দু’আ করতে হবে। বিশেষ করে মাতা-পিতার জন্য সন্তানের দু’আ সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তাই এ ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিৎ।
মৃতদের জন্য হাত তুলে দুআ করা:
দুআ করার ক্ষেত্রে হাত তুলে দুয়া করা জায়েয রয়েছে। যেমন উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أَنَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَارَ القُبُوْرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا لِأَهْلِهَا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকী গোরস্থান যিয়ারতে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দুহাত তুলে দুআ করলেন।” (সহীহ মুসলিম: ৯৭৪)
মৃতদের জন্য সম্মিলিতভাবে দুআ করার বিধান:
মৃতদের জন্য সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার ব্যাপারে বিশুদ্ধ কোনো দলীল নেই। তাই অনেক আলেম এটিকে বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সউদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির ফাতওয়াটি হল, “দুআ একটি ইবাদত। আর ইবাদত দলীলের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আল্লাহর বিধানের বাইরে কারও জন্য ইবাদত করা জায়েয নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটি প্রমাণিত নয় যে, তিনি জানাযা শেষ করে সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে সম্মিলিতভাবে দুআ করেছেন। এ ক্ষেত্রে যে জিনিসটি প্রমাণিত তা হল, মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া সম্পন্ন হলে তিনি সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন, “তোমাদের ভাইকে এখনই প্রশ্ন করা হবে। অত:এব দুআ কর যেন সে (প্রশ্নোত্তরের সময়) দৃঢ় থাকতে পারে।” তাহলে এ থেকে প্রমাণিত হল যে, জানাযার সালাত শেষ করে সম্মিলিতভাবে দুআ করা জায়েয নয়, বরং এটি একটি বিদআত কর্ম। (সউদী আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি)
উল্লেখ্য যে, কবর যিয়ারতের দু’আ হিসেবে আমাদের সমাজে একটি দু’আ ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। সেটি হল,
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ
“হে কবরবাসীগণ! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের আগে চলে গেছ। আমরা তোমাদের অনুগামী।” (তিরমিযী) কিন্তু এ হাদীসটি সনদগতভাবে দূর্বল-যেমনটি শায়খ আলবানী (রাহ.) জঈফ তিরমিযীতে উল্লেখ করেছেন। তাই সেটি না পড়ে পূর্বোল্লিখিত সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে যে দু’আগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পড়াই উচিৎ।
যে সকল কাজে মাইয়্যেত উপকৃত হয়:
দু’আ করা: “হে আমাদের রব! তুমি আমাদের মাফ করে দাও, আমাদের আগে আমাদের যে ভাইয়রো ঈমান এনেছে তুমি তাদেরকেও মাফ করে দাও এবং আমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না, হে আমাদের রব!, তুমি অতিশয় মেহেরবান ও পরম দয়ালু।” (সূরা হাশর: ১০)
মান্নাত রোযা আদায় করে দেওয়া: মাইয়্যেত যদি এমন কোনো রোযার মান্নত করে থাকে যা পালন করার আগেই সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে জীবিত আত্মীয়রা মাইয়্যতেরে পক্ষ থেকে ঐ রোযাগুলো রেখে দিলে মাইয়্যেত দায়মুক্ত হয় এবং উপকৃত হয়। (সুনান আবূ দাঊদ: ৩৩০৮, ২৪০১)।
ঋণ পরিশোধ: মাইয়্যেতের কোন ঋণ থেকে থাকলে আপনজন বা অন্য কেউ মাইয়্যেতের পক্ষ থেকে তা পরশিোধ করে দিলে মাইয়্যেত এ পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। (সহীহ বুখারী: ৬৬৯৯)
হজ্জ ও ওমরাহ আদায়: মাইয়্যেতের উপর হজ ফরয থাকলে আর কোনো কারণে তা আদায় করা ছাড়া মারা গেলে নিজের সন্তান বা আপনজনদের কেউ তার পক্ষ থেকে বদলী হজ আদায় করলে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। (সহীহ মুসলমি: ১৩৩৪-১৩৩৫, মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা: ১২০৮৫) এতে মাইয়্যেত হজের সাওয়াবও পেয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।
দান-সদকা: মাইয়্যেতের জন্য দান-সদকা করার কথা বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। এতে তারা উপকৃত হন। (মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা: ১২০৮৪)
মাইয়্যেতের জন্য নফল নামায ও নফল রোযা রাখা: এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, এবং সাহাবায়ে কেরাম তাদের মৃত আত্মীয় স্বজনের জন্য নফল নামায, নফল রোযা রাখতেন। হজ ও ওমরাহ আদায় করতেন। (মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা: ১২০৮৪, ১২০৮৫)
নেক সন্তানের দু’আ ও আমল: সন্তান যেসব ভালো কাজ করে তার সমপরিমাণ সওয়াব মাতা-পিতাও পান, এমনকি কবরে থেকেও। যদি সওয়াব মাতা-পিতা তার সন্তানকে ভালো পথে পরিচালিত হওয়ার শিক্ষাদান করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সন্তান হলো নিজের উপার্জিত ধন-সম্পদের মতো।” (সহীহ মুসলমি: ১৬৩১, সুনান আবূ দাঊদ: ৩৫২৮) সন্তান যত বেশি ভালো কাজ করবে মাতা-পিতা ততবেশি সওয়াব পেতে থাকবেন।
সদকায়ে জারিয়াহ: জীবদ্দশায় করে যাওয়া আমল ও দান-খয়রাত, কল্যাণমূলক কাজ যা সদকায়ে জারিয়াহ হিসেবে চলমান থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তিন প্রকারের আমল ছাড়া তার সকল আমলই বন্ধ হয়ে যায়। (ক) সদকাহ জারিয়াহ, (খ) মানুষ উপকৃত হয় এমন ইলম, ও(গ) নেক সন্তান, যে তার তার জন্য দু’আ করে।” (সহীহ মুসলিম: ১৬৩১)
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।