ঈদ শপিং একটি অপসাংস্কৃতিক দাসত্ব
ঈদ মার্কেটিং, ঈদের শপিং, ঈদের বাজার ইত্যাদি ধারণা প্রচলিত মুসলিম সভ্যতায় নতুন অনুপ্রবেশকারী ভোগবাদী গোষ্ঠীর সৃজিত সার্থান্বেষী সংস্কৃতি। প্রচলিত ঈদ শপিংয়ের এই ধারণা মূলত স্বার্থবাদী বণিক ও পুঁজিবাদী অসাধু মিডিয়া যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে সৃষ্টি করেছে। নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য এভাবে কায়েমী ও স্বার্থবাদী মিডিয়া এবং ব্যবসায়ীরা ঈদ শপিংয়ের নামে মুসলিম সমাজে একটি নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। আমরাও মিডিয়ার এই অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে ইসলামী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অবাধে জীবনে ধারণ করে চলেছি। সুতরাং যে করেই হোক, যেভাবেই হোক ‘ঈদ মার্কেটিং’ তো করতেই হবে! দামী কাপড়-চোপড়, অলংকার, আসবাব না হলে যে ঈদ-ই হবে না! অন্তত একটি জামা, এক জোড়া জুতো, বা একটি শাড়ী বা থ্রি পিস না হলে কি হয়!
চর্চিত এই ঈদ শপিংয়ের ইসলামী সংস্কৃতিতে কোনো স্থান নেই। ঈদ উপলক্ষে নতুন কেনাকাটা করতে হবে, এমন কোনো কথা ইসলামে নেই। আবার প্রয়োজনে কেনাকাটা করতেও নিষেধ নেই। মূলত ঈদ শপিং বা ঈদের কেনাকাটা সম্পর্কে কোনকিছু রাসূল (সা.) ও তার সাহাবীদের থেকে পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাহল-
রাসূল (সা.) বলেন, ঈদের দিনে তোমার নিজের পোষাকগুলো থেকে উত্তম একটি পোষাক পরো। এখানে নিজের পরিধানের যে কাপড়গুলো রয়েছে তা থেকে একটি উত্তম পোশাক পরিধানের কথা বলা হয়েছে। নতুন পোশাক নয়। (বাইহাকি দ্রষ্টব্য)
আবূল ইয়ামান (রহ.) … আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এমন একটি রেশমী জুব্বা নিয়ে উমর (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এটি কিনে নিন। ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সংগে সাক্ষাতকালে এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, এটি তো তার পোষাক, যার (আখিরাতে) কল্যাণের কোন অংশ নেই। এ ঘটনার পর উমর (রা.) আল্লাহর যত দিন ইচ্ছা ততদিন অতিবহিত করলেন।
তারপর নবী (সা.) তার নিকট একটি রেশমী জুব্বা পাঠালেন, উমর (রা.) তা গ্রহণ করেন এবং সেটি নিয়ে নবী (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো বলেছিলেন, এটা তার পোষাক যার (আখিরাতে) কল্যাণের কোন অংশ নেই। অথচ আপনি এ জু্ব্বা আমার নিকট পাঠিয়েছেন। তখন নবী (সা.) তাকে বললেন, তুমি এটি বিক্রি করে দাও এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থে তোমার প্রয়োজন মিটাও। (সহিহ বুখারি, ইফা, নাম্বার, ৯০১, আন্তর্জাতিক নাম্বার, ৯৪৮)
এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, রাসূল (সা.) রেশম- যা পুরুষের জন্য হারাম, তা থেকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু নতুন পোশাক কেনাকে নিষেধ করেননি। তবে তিনি ঈদের দিন নতুন পোষাক পরেছেন বলে কোনো বিবরণও পাওয়া যায় না। নতুন কাপড় কেনার কোনো কথা সাহাবি যুগেও পাওয়া যায় না।
তাহলে কি ঈদে নতুন কাপড় কেনা যাবে না?
অবশ্যই নতুন জামা-কাপড় কেনার অনুমতি রয়েছে। ইসলামে এতে কোনো বাধা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় নতুন কাপড় কিনতে পারে। ঈদের সময়ও কিনতে পারে। তবে এটাকে এটাকে সুন্নত মনে করা যাবে না। অনেককেই বলতে দেখা যায় যে, ঈদে নতুন জামা-কাপড় পরিধান করা সুন্নত। এটি ঠিক নয়।
মনে রাখতে হবে, কেনাকাটার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হল, ইসরাফ বা অপচয় না করা। অর্থাৎ পোষাক-আশাক সংগ্রহ করতে খুব বাড়াবাড়ি না করা। অপচয় বা অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, হে বনি আদম, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করো, পানাহার করো কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
সুতরাং কেনাকাটায় অবশ্যই সংযত হওয়া আবশ্যক। শুধু প্রয়োজনমাফিক ব্যয়কেই ইসলাম অনুমোদন করে। কেননা প্রয়োজন ব্যতীত সম্পদ ব্যয় মানুষকে অবৈধ উপার্জনের দিকে ধাবিত করে। হিসেব ছাড়া কেনাকাটা ও লাগামহীন উৎসব আনন্দ রমযানের ত্যাগের শিক্ষাবিরোধীও বটে।
পরিতাপের বিষয় হল, আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজে ঈদ শপিংয়ের যে রেওয়াজ চলে আসছে বহু দিন ধরে, তা মনগড়া ও নিতান্তই বাড়াবাড়ি। বহু লোককে দেখা যায়, তাদের জন্য দেশের মার্কেট যথেষ্ট হয় না, তারা ঈদ শপিংয়ের জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। তার বিপরীতে মধ্য ও নিম্ন মধ্য বিত্তের এমন বহু লোক রয়েছেন যারা ঈদ শপিংয়ের বেড়াজালে বাধ্য হয়ে ঋণ করে ঈদের শপিং করেন। এ দুটোই আমাদের অজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক দাসত্বের প্রমাণ। সুতরাং ঈদ শপিংয়ের অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল:
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ইফতা ও দাওরায়ে হাদীস: যাত্রাবাড়ী ও লালবাগ জামেয়া, ঢাকা
প্রিন্সিপাল, মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।