সুখের অসুখ
বিয়ে নামক অদ্ভুত মায়াবী যন্ত্রটার সাহায্যে তানু গ্রাম থেকে শহরে এলো। মফস্বলের কলেজ থেকে একটা পাশ দিয়েই দাড়িওয়ালা স্কুল মাস্টারের ঘরণী হলো সে। মাতৃশূন্য জীবনের মমতাহীন অধ্যায় বিদায় নিলো প্রথমবারের মতো!
একটা পুরনো বিল্ডিংয়ের নিচতলা। একটি বেডরুম, একটি ওয়াশরুম আর কিচেনের সাথে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা, যেটাকে বাড়িওয়ালা ডাইনিং স্পেস বলে দাবি করেন! যদিও সেখানে একটা আস্ত ডাইনিং টেবিল রাখার সুযোগ নেই। অবশ্য সেটা তাদের দরকারও নেই।
টোনাটুনির সংসারে একটু শোবার আর খাবার ব্যবস্থা থাকলে অধিক কিছুর দরকারই হয় না!
স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার বাসাটাকে তানুর চোখে একটা ছোটখাটো রাজপুরীই মনে হয়। যেখানে মমতার বীজ হয়, ভালোবাসার চাষ হয় সেখানে জীবনের কোন অপূর্ণতাই থাকে না।
সারাদিন বাসায় একা থাকে তানু, ইরফান ফেরে সন্ধ্যায়। ঐ সময়টা তার কাছে দিন রাতের শ্রেষ্ঠ সময়। কলিং বেল এর দরকার পড়ে না! সারাদিন একাকী হাঁপিয়ে উঠা প্রাণ আগে থেকেই চোখ কান পেতে থাকে দরজায়, নক করার আগেই দরজা উন্মুক্ত হয় প্রতিদিন।
তানুর একাকীত্ব কাটাতে জমানো টাকায় ফোন কিনে দেয় ইরফান। তারপর দেখা মেলে নতুন এক জগতের। ধীরে ধীরে মুগ্ধতা বাড়ে তানুর। পরিচয় হয় বেশকিছু দ্বীনদার বোনদের সাথে। তাদের পোস্ট, কমেন্ট এবং চ্যাটবক্স সবকিছুই কেমন প্রশান্তি এনে দেয় তানুর সরল হৃদয়ে। দ্বীনের বিশেষ জ্ঞান না থাকায় সবসময় সে তাদের সহযোগিতা পেতে থাকে।
কয়েকটা দ্বীনি সিস্টার্স গ্রুপেও যুক্ত হয় তানু।
কোথাও চলে দ্বীনি আলোচনা আর কোথাও বা একটু আড্ডা একটু গল্প।
মফস্বলের মেয়ে তানুর কাছে একসময় ধার্মিক মেয়ে মানেই গ্রামের দরিদ্র হুজুরের মেয়েদের কথাই মনে আসতো। কিন্তু এখন তার ধারণা বদলে দিয়েছে শহরের সুশিক্ষিত অভিজাত দ্বীনি বোনেরা!
আড্ডার গ্রুপ থেকে সে তাদের জীবনযাপন দেখতে পায়। মাঝে মাঝেই গেট টুগেদার হয় তাদের, সেখানকার সুসজ্জিত খাবারের ছবিগুলো অবাক হয়ে দেখে সে।
এগুলো নাকি তাদের নিজের হাতে তৈরি! ঘোর লেগে যায় একেবারে।
আপুদের বারান্দা বাগান, ছাদ বাগানের ছবিও দেখে নিয়মিত তার চোখদুটো ঝিলিক দিয়ে উঠে।
দুনিয়াতেও এতো সৌন্দর্য থাকতে পারে সেটা ও কল্পনাতেই আনতে পারে নি এতোদিন।
হাজব্যান্ড এর থেকে পাওয়া সারপ্রাইজ গিফটগুলো যখন সবাই শেয়ার করে তখন তানুর চোখদুটো বড় বড় হয়৷
নীল সাদার দুনিয়া বন্ধ করে যখন নিজের চারপাশে তাকায় তখন এক হীনমন্যতা চেপে ধরে তাকে।
না আছে তার উচ্চশিক্ষা, না পারে ভালো আইটেম বানাতে, আর ঘোর দোর আসবাব সেসবের কথা নাইবা হলো।
সন্ধ্যার ইরফান আসে বাজারের ব্যাগ হাতে। ফেসবুক বন্ধ করে দরজা খোলে সে।
বাইরে থেকেই উচ্চ কণ্ঠে আওয়াজ আসে,
– জিনিসপত্রের যা দাম! বাজারে আগুন একেবারে। এটুকু বাজার করতেই বেতনের অর্ধেক শেষ। মাসের বাকীটা যে কীভাবে যাবে!
এইতো সেদিন এক বোন পোস্ট দিলেন,
‘জামাই এর জন্য নিজ হাতে গরুর কালাভুনা তৈরি করলাম, বেচারা একেবারে হাত চেটেপুটে খেয়েছে, আমার পরিশ্রম সার্থক।’ সেই সাথে কমেন্ট বক্সে দিলেন কালাভুনা রেসিপি লিঙ্ক। বারবার যত্ন করে দেখে নিলো তানু। বলতে গেলে মুখস্থ করে নিলো সব! এরপর কল্পনায় পরিবেশন করে ইরফানের তৃপ্তিমাখা প্রশংসা উপভোগ করলো।
সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে বললো,
– হ্যাঁ গো, তুমি গরুর কালাভুনা খেয়েছো কখনো?
সে হেসে বলে,
– না, তবে ছোটবেলায় কুরবানির পরে কয়েকদিন ধরে গোশত জ্বাল করে রাখার পর কালো হয়ে যেতো, ওইটা খুব মজা করে খেয়েছি।
তানু উৎসাহিত হয়ে বলেল…
-তুমি আমাকে দু কেজি মাংস এনে দিও, দেখো কালাভুনা খেতে তার থেকেও মজা।
সজোরে হেসে উঠে ইরফান।
– আরে বোকা, দু কেজি মাংস কেনার সামর্থ্য কি আমার আছে? ওসব বড়লোকি আমাদের কপালে এখন নেই, ঘুমাও তো আজেবাজে না বকে।
আশাহত হয় তানু, কী এমন হাতি ঘোড়া চেয়েছিলো সে?
পাশ ফিরে চোখে হাত দিয়ে অশ্রু আড়াল করে। ইরফান সবই বোঝে কিন্তু তানুর মনকে শান্ত করতে উদ্যমী হতে পারে না, তার অক্ষমতা তাকে আঘাত করে আরও গভীরভাবে।
নীরবতা দিয়েই নতুন সকাল শুরু হয়। রেডি থাকা নাশতা খেয়ে নীরবেই বেরিয়ে যায় ইরফান। এদিকে তানুর মন ভীষণ অনুতপ্ত, অকারণেই এভাবে কষ্ট দেয়া ঠিক হয় নি তার। সত্যিই এসব সখ করার মতো সামর্থ্য হয় নি তাদের। মনে মনে ভাবে…ইরফান এলে ক্ষমা চেয়ে নিবে সে।
অস্থির মন নিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতেই সামনে আসে ডাইনিং ভর্তি খাবারের ছবি, এতসব খাবারের নামও কখনো শোনে নি তানু। ক্যাপশনটার দিকে চেয়ে থাকে কিছু সময়, ” হঠাৎ মেহমান চলে আসায় গরিবী হালের আপ্যায়ন।”
মনে মনে বেশ খানিকটা হেসে নেয় তানু।
শান্তি আসে না মনে, এরই মাঝে মেসেঞ্জারে রিহানা আপুর ডাক।
মাঝবয়সী রিহানা কবির ছোটবোনের মতই স্নেহ করেন তাকে, থাকেনও আশেপাশে কোথাও যদিও দেখা হয় নি কখনো।
রিহানা আপু তানুর মোবাইল নম্বর চাইলেন, যে কোন দিন ওকে সারপ্রাইজ দিয়ে চলে আসার জন্য।
তাঁর আসার সংবাদে অতি উচ্ছ্বসিত কয়েকটা রিপ্লাই লিখলেও তার মুখ জুড়ে নেমে আসে বৈশাখের কালো মেঘ!
নতুন অতিথি আসবে খুশির খবর, কিন্তু আপ্যায়ন হবে কী দিয়ে?
একদিকে ইরফানের মলিন মুখ আরেক দিকে নতুন দুশ্চিন্তা তীব্র অস্থিরতায় ফেলে দেয় তানুকে।
সহজ কোন উপায় বের করতেই হবে, আবারও মেহমান আপ্যায়নের পিকচার গুলো দেখতে থাকে তানু। যতই দেখে ততই হতাশা বাড়ে।
আনমনে বলে ওঠে,
– এসব কিছুই তোর কপালে নেই রে তানু!
এরপর টুংটাং, রিহানা আপুর মেসেজ, কাল বিকেলেই আসছেন তিনি!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, দরজায় কড়া নড়ে।
সচারাচরের পরিপাটি তানুকে এলোমেলো দেখে ভেতরে একটা ধাক্কা লাগে ইরফানের। বাইরের কাপড় না ছেড়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবনায় ডুবে যায়। জীবনটা কঠিন লাগে খুব। এমনটা তো সে চায় নি! তার আর্থিক দৈন্যতা সে জানতো, তবুও সাহস করে তানুকে ঘরে এনেছে তার উপরে অনেক ভরসা থেকে। সাদামাটা জীবনে তানুকে সে হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল করেই পেতে চায় সবসময় কিন্তু তানু এমন বদলে যাচ্ছে কেনো…?
ভাবনার জগতে ডুবতে ডুবতে তানুর পরশে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
– কি গো, শরীর কি বেশি খারাপ? ফ্রেশ হবে না?
তানুর উৎকন্ঠিত কন্ঠ সহজ করে তাকে।
– না, এমনিই একটু ক্লান্ত লাগছিল।
এবার তাড়া দেয় তানু,
– যাও তো তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো, আজান হবে এক্ষুণি।
– তোমার সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো, যাচ্ছি যাচ্ছি।
পরিবেশ হালকা হয় খানিকটা। তানু সিদ্ধান্ত নেয় মেহমান আসার বিষয়ে ইরফানকে কিছুই জানাবে না।
জানিয়ে কোন সমাধান তো হবেই না বরং অশান্তিই বাড়বে আরও। তারচেয়ে ভালো রিহানা আপু এলে বাসায় যা থাকে সেরকম কিছু দিয়ে আপ্যায়ন সেরে ছোট করে মাফ চেয়ে নিবে। আর অনেক আয়োজন করেই বা কী? খেতে দিবে কিসে? অতশত আর ভাবতে পারে না, ভাবনা আড়াল করে আজকের রাতটা একটু শান্তিতে কাটাতে চায় তানু, অন্তত গতরাতের মতো কিছু আর না ঘটুক!
দুপুরের রোদের তীব্রতা কমে নি তখনো, যদিও সময়ের হিসেবে একে বিকেলই বলে। পারিপাট্যহীন খাটের উপর পা গুটিয়ে বসে রিহানা আপু, মুখে মিষ্টি হাসি লেগে আছে, তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টি তানুর দিকে নিবদ্ধ। তানু একটা প্লেটে নুডলস আর আরেকটায় টোস্ট বিস্কিট সামনে রেখে অপরাধীর মত বসে আছে আর মাথা নেড়ে আপুর কথার উত্তর দিচ্ছে।
কি অদ্ভুত মিষ্টি করে কথা বলেন আপুটা! সংকোচে একবার তাঁর মুখের দিকে তাকায় তানু। আপুর মায়াবী হাসি আঘাত করে তার অন্তর্দেশ। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করে বসে,
– আর তো আসবেন না আপু তাইনা?
– আসব না মানে? বলিস কি রে? আজ থেকে তো সবে শুরু হলো।
আন্তরিকায় তানু তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে প্রথম দর্শনে।
– সবাই কত দামী দামী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে আপু, কিন্তু আমরা যে খুব গরিব।
গলা ধরে আসে তানুর।
রিহানা আপু আহত হয়ে তানুর মাথায় হাত রাখে।
– এই পাগলি মেয়ে….তুই গরিব এটা তোকে কে বললো শুনি?
– কাকে বলতে হবে আবার! আমি তো নিজেই জানি। সবার মেহমান আপ্যায়নের ছবিগুলো তো দেখি। তাদের গরিবী হালের আপ্যায়নও কত শত রকমের হয়। সত্যি বলতে কি আপু, আমি সেসব সামনাসামনি কখনো দেখিও নি।
– ও, এই ব্যাপার! তুই শুধু ফেসবুকেই অতিথি আপ্যায়নের চিত্র দেখেছিস বুঝি? তুই এই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মেহমানের কথা জানিস না বুঝি? তাঁর জন্য কত আইটেম খাবার আয়োজন করা হতো তোর ধারনা আছে? বেশিরভাগ সময়ই তাঁর মেহমানদারী হতো শুধু খেজুর দিয়ে। আর যাঁরা সেটার আয়োজন করতেন তাঁরাও কতই না সম্মানিত ছিলেন। অথচ আজ আমরা আইটেমের প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি বোন।
ফেসবুকে এসব প্রকাশ করে আমরা এভাবেই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আয়োজন করি নিজের অজান্তেই। আমি আমার চেনাজানা সবার মাঝে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব, আমরা যেটাকে নিছক আনন্দের অংশ হিসেবে প্রচার করি সেটাই অনেক ক্ষেত্রে আরেকজনের আনন্দ ধ্বংসের কারণ হয়।
এবার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তানু, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
– সত্যি বলতে আপু, আমার এই অন্ধকার বাসা আর দুবেলা দুমুঠো সাদামাটা ডালভাতের জীবন নিয়ে রাজপুরীর সুখ অনুভব করেছি এতদিন। কিন্তু এখন সবার ঝলমলে জীবনের গল্প ছবি দেখতে দেখতে ছোট হয়ে গেছি নিজের কাছেই, শুধু মনে হয় না আমি তাদের কাছে যেতে পারি আর না তাদেরকে কাছে আসতে দিতে পারি। আমার দারিদ্র্য নিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, আর তার সাথেও মাঝেমধ্যেই মনোমালিন্য হয় এখন।
– না পাগলি মেয়ে, এমনটা ভুলেও করিস না! যাদের সুখ প্রাচুর্যের জীবন দেখে নিজের সংসারের সুখ নষ্ট করছিস তাদের সেসব গল্পের আড়ালেও আরও কত অপ্রকাশিত যাতনার গল্প আছে তা কি তুই জানিস?
সেসব গল্প ফেসবুকে আসে না, তা কেবল তাদের ভেতরকেই দগ্ধ করে। নিজের দৃষ্টিকে অত উঁচুতে উঠতে দিস না, জীবন থেকে সুখের ছিটেফোঁটাও হারিয়ে যাবে, তারচেয়ে তুই ওদের কথাই ভাব, যাদের তাকদিরে এমন একটা অন্ধকার বাসা জোটে নি বলে ওই যে ওই ফুটপাতে, বস্তিতে গাদগাদি করে শুয়ে বসে রাত কাটায়। রবের এত এত নিয়ামতের মাঝে ডুবে থেকে তাঁর অকৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া আমাদের মানায় না বোন।
তানুর বুক ফেটে কান্না আসে এবার,
– আমি সত্যিই অকৃতজ্ঞ হয়েছি আপু। ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর যে কঠিন মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলাম সেখান থেকে আল্লাহ আমাকে তুলে এনেছেন। তার মতো যত্নবান সৎ মানুষকে সঙ্গী করে দিয়েছেন। আর দিনশেষে আমি অকৃতজ্ঞই হলাম! আমি কি ক্ষমা পাবো আর?
– পাবি না মানে? সেই পবিত্র সত্তা তো আমাদের এই উপলব্ধিকেই পছন্দ করেন সবচেয়ে বেশি।
বলতে বলতে তানুর হাতদুটো টেনে নেন রিহানা আপু। ওর কান্না থেমে আসে ধীরে ধীরে। মাসজিদ থেকে আওয়াজ ভেসে আসে…’আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার… ‘
এক অপার্থিব প্রশান্তিতে হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে যায় তানুর!
– সুমাইয়া আফরোজ