ইসলামী ব্যাংকগুলোতে শরীয়া পরিপালন ও শরীয়া বোর্ডের সীমাবদ্ধতা: কতিপয় সুপারিশ
ইসলামী ব্যাংকসমূহের লেনদেনে শরীয়া পরিপালন হচ্ছে কিনা, শরীয়া মানদণ্ড কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে- তা তদারকি করার জন্য শরীয়া বোর্ড/শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটি রয়েছে এবং শরীয়া অডিট নামে একটি অডিট ব্যবস্থাও রয়েছে।
আমার পর্যবেক্ষণ মতে- এ দুটি বিভাগই শরীয়া পরিপালনের ক্ষেত্রে জনগণের আশানুরূপ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর প্রধান কারণ-
ক. শরীয়া অডিট বিভাগের কর্মকর্তাগণ ব্যাংকের বেতন ভোগী কর্মকর্তা। তারা কখনই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাপক শরীয়া লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করার সাহস রাখবে না- এটাই স্বাভাবিক।
খ. শরীয়া বোর্ড/শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটিগুলোর অধিকাংশ সদস্য ব্যাংকের বাস্তব ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, আবার অনেকের শরীয়া বিষয়েও প্রয়োজনীয় যোগ্যতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তদুপরি তাঁদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটিও পুরো স্বচ্ছ ও আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত নয়। ফলে নীতিনৈতিকতার দিক থেকে দুর্বল কেউ কেউ যে শরীয়া বোর্ড/সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য হয়ে যায়- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অবস্থায় তাঁদের পক্ষে ব্যাংকিং কার্যক্রমে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে শরীয়া পরিপালন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
শরীয়া প্রতিপালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কতিপয় সুপারিশ:
১. শক্তিশালী শরীয়া বোর্ড গঠন
১.১. শরীয়া বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে অভিজ্ঞ হবেন। এ জন্য তাঁদের শরীয়া বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ে বিশেষ অধ্যয়ন ও স্বীকৃত গবেষণা থাকতে হবে।
১.২. শরীয়া বোর্ডের সদস্য নিয়োগের জন্য একটি কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত কোনো সদ্স্য নিয়োগ বা বহিষ্কার করা যাবে না। এর ফলে একদিকে যেমন যথেষ্ট যোগ্যতা ব্যতীত কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ কমে যাবে, তেমনি যথাযথ কারণ ব্যতীত কোনো সদস্যকে বাদ দেয়ার সুযোগও হ্রাস পাবে।
১.৩. শরীয়া বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য সততা ও দীনদারির ক্ষেত্রে সুখ্যাত হবেন। এ কারণে সততা ও দীনদারির ব্যাপারে প্রশ্নবিদ্ধ কোনো লোককে বোর্ডের সদ্স্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।
১.৪. একজন ব্যক্তি একই সাথে একাধিক ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডের সদস্য হতে পারবে না। এর ফলে নির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির ওপর শরীয়া বিষয়ক নির্ভরতা এড়ানো সম্ভব হবে।
১.৫. শরীয়া বোর্ডের কোনো সিদ্ধান্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অবহেলা করতে পারবে না বা অনুমতি ছাড়া পরিবর্তন করতে পারবে না।
১.৬. ব্যাংকের মূল পর্ষদের মধ্যে শরীয়া বোর্ডের অন্তত একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা। এর ফলে শরীয়া বোর্ড ও ব্যাংকের মূল পর্ষদের মধ্যে দূরত্ব অনেকখানি কমে যাবে।
১.৭. শরীয়া বোর্ডের সদস্যদের কর্মক্ষমতা ও পরিধি বৃদ্ধি করা। তাঁরা যে কোনো সময় ব্যাংকের যে কোনো শাখায় গিয়ে তার কার্যক্রম তদারক করতে পারবেন এবং কোথাও কোনো শরীয়া লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা- তা যাচাই করতে পারবেন।
১.৮. (ইসলামী ব্যাংক যেহেতু একটি আইডিওলজিক্যাল ব্যাংক, তাই অভীষ্ট আইডিওলজির যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে) ব্যাংকে বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে শরীয়া বোর্ডের সুপারিশের ব্যবস্থা রাখা। এতে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী নয় কিংবা ইসলামী জীবনাদর্শ মেনে চলে না- এরূপ কেউ ব্যাংকে অনুপ্রবেশের সুযোগ হ্রাস পাবে।
১.৯. শরীয়া বোর্ডগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে একটি কেন্দ্রীয় শরীয়া বোর্ড থাকবে এবং এ কেন্দ্রীয় বোর্ড ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ে শরীয়াভিত্তিক সিদ্ধান্ত প্রদান করবে, যা ইসলামী ব্যাংকগুলো অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে।
১.১০. কেন্দ্রীয় বোর্ডের সদস্যদের প্রত্যেকেই শরীয়া, অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ে যথেষ্ট সুখ্যাতির অধিকারী হবেন এবং সৎ ও সাহসী হিসেবেও সুপরিচিত হবেন। ব্যাংকগুলোর শরীয়া বোর্ডের কোনো সদস্য কেন্দ্রীয় শরীয়া বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন না।
১.১১. ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ শরীয়া অডিটের পাশাপাশি বৎসরে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক/কেন্দ্রীয় শরীয়া বোর্ডের অধীনে স্বাধীন বহিঃশরীয়া অডিট (External Shariah Audit)-এর ব্যবস্থা করা। পেশাদার হিসেবে বিষেশজ্ঞ ও শরীয়া বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এ স্বাধীন অডিট কমিটি গঠন করা। এ কমিটি ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন, চুক্তি ও সামগ্রিক কার্যক্রমে শরীয়া বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা মানা হয়েছে কিনা তার পরীক্ষা করবে এবং মূল্যায়ন করবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ওমান, পাকিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন প্রভৃতি দেশগুলোর ইসলামী ব্যাংকগুলোতে অভ্যন্তরীণ শরীয়া অডিটের পাশাপাশি বহিঃশরীয়া অডিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ড. আহমদ আলী
অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।