তাওহীদের ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্য চাই
মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং নিজেদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম একটি মৌলিক ফরয বিধান। আর এই ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি হল তাওহীদ। মসজিদ হল তাওহীদ বা আল্লাহ্র একাত্মবাদ প্রচার , প্রসারের মূলকেন্দ্র। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির অন্যতম পরিচায়ক এই মসজিদ। প্রত্যেক মুসলমানের সাথে মসজিদের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
মসজিদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন: “নিশ্চয়ই সকল মসজিদ আল্লাহর” (সুরা জীন, আয়াত-১৮)।
আয়াতটি থেকে স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, মসজিদ আল্লাহ্ তালার ঘর। সুতরাং পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বা দিগন্তেই হোক যখন কোন মুসলিম কোন মসজিদ তৈরি করবে সেটি আল্লাহ্র ঘর হিসাবেই বিবেচিত হবে।
তাই কোনভাবেই ফেরকা বা গুষ্ঠিগত কোন বিবাদ-বিতর্ক উস্কে দিয়ে মসজিদ বন্ধের দাবী তোলা একেবারেই অমূলক, অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর। এমন দাবী কোন মুসলিম করতে পারে না। মসজিদে দিরারের প্রসঙ্গও এখানে অবান্তর। মানহাজ, মাসলাক, মাসায়েল নিয়ে আহলে হাদীসের সঙে আপনার হাজারো মতপার্থক্য থাকতে পারে, থাকতে পারে আপনার প্রতি আহলে হাদীসের হাজারো আপত্তি। এটি নিতান্তই একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাতে দোষের কিছু নেই। কেয়ামত পর্যন্ত এই মতানৈক্য থাকবে। আপনি কখনোই মতানৈক্যের এই প্রাচীরকে ভেঙে দিতে পারবেন না। তবে এই মতভেদ বা ইখতেলাফ যেন আমাদের একের অন্যের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করতে না পারে সেটিও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। উম্মাহর ঐক্য ধরে রাখা ফরয। বিনষ্ট করা হারাম।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন,
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার”। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-103)।
ঐক্য ও সম্প্রীতির অপরিহার্যতা ও কলহ-বিবাদের বর্জনীয়তা সম্পর্কে সহীহ হাদীসে এসেছে,
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কারণধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা আঁড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়েনিও না, দাম-দস্ত্তরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হে আল্লাহরবান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩)
নুমান ইবনে বাশীর রা. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারের বয়ানে বলেছেন, জামাআ হল রহমত আরবিচ্ছিন্নতা হচ্ছে আযাব। (যাওয়াইদুল মুসনাদ, হাদীস: ১৮৪৪৯, ১৯৩৫০; কিতাবুস সুন্নাহ, ইবনু আবী আসিম, হাদীস: ৯৩)
মসজিদ ইবাদতের স্থান, সকল মুসলিমের প্রাণ কেন্দ্র। ঈদগাহের পর এখানেই মুসলিমরা একত্রে মিলিত হন। মসজিদকে কেন্দ্র করে সমাজে সম্প্রীতি বন্ধন মৈত্রী মজবুত হয়, মুমিনদের পরস্পরে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এভাবেই একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। জুমআর সালাত, পাঁচ ওয়াক্ত ফরযের সালাতও আমাদের এই শিক্ষা দেয়। তাই মসজিদ নিয়ে দলাদলি, মারামারি, কাটাকাটি, খুনোখুনি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মতো ন্যাক্কার জনক ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়। মসজিদে সকল মুসলিমের সালাত ও সহীহ ইসলামী কর্মকান্ড পরিচালনার হক রয়েছে, অতঃএব কোন নির্দিষ্ট এক পক্ষের পক্ষে মসজিদকে কুক্ষিগত করে রাখাও অনুচিত। আরেকটি বিষয় সকলের মনে রাখা অত্যাবশ্যক, আমাদের দেশ হানাফী মুসলিম অধ্যুষিত, সঙ্গত কারণেই এখানকার মুসলিমরা রফউল ইয়াদাইন, আমিন বিল জেহেরের উপর আমল করেন না। শতশত বছর ধরে এখানে তারাবীহ ২০ রাকাতই আদায় করে আসছে মানুষ। এটাই এদেশের সাভাবিক চিত্র। তবে এর বিপরীতে কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত অন্য কোন আমল কেউ করতে চাইলে তাকেও সুযোগ দিতে হবে, কারণ এটা তার শরয়ী অধিকার। নিষেধ করা অন্যায় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
ফেতনার আশঙ্কা হলে যেখানে তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া হয় আপনিও সেখানে বিশ রাকাতই পড়ুন, যেখানে আট রাকাত পড়া হয় সেখানে আট রাকাতই পড়ুন। কোন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ সমর্থিত কোন আমলেরে বিপরীত আমল করতে চাইলে আপনি ঘরেই আপনার ইচ্ছানুযায়ী আমল করুন না, কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহূ আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তো সরাসরি তারাবীর কোন রাকাত সংখ্য পাওয়া যায়না, আর তিনি মাত্র তিনদিন মসজিদে নববীতে এ সালাত আদায় করেছেন, বাকী সারা মাস তো ঘরেই আদায় করেছেন, তাহলে এটিই কি উত্তম নয়? প্লীজ! সময়ের বিবেচনাবোধ থেকে একটু চিন্তা করে দেখুন। তবুও মুসলিম সমাজে বিভেদ বিসম্বাদ সৃষ্টি করবেন না। মুসলিমদের হৃদয়গুলোকে ভেঙে আর খান খান করে দিবেন না। অনুরোধ কাউকে জোরে আমীন বলার কারণে কেউ মসজিদ থেকে বের করে দিবেন না, কাউকে বের করে দেওয়া হলে তিনিও হুট করে আরেকটি মসজিদ করে ফেলবেন না। এতে উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট হয়। সামাজিক অশান্তি ও বিশৃংখলা বৃদ্ধি পায়। ওয়াহদাতুল উম্মাহর শিক্ষা ও ধারণা ব্যাহত হয়।
আল্লাহ্ তাআলাবলেন,
“যে ব্যাক্তি আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় যালেম আর কে? এদের পক্ষে মসজিদসমূহে প্রবেশ করা বিধেয় নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। ওদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে”। (সূরা আল বাকারা, আয়াত-১১৪)।
পরিশেষে সবার প্রতি উদাত্ত আহবান করে বলব, মসজিদগুলোকে দলীয় স্বার্থে নয় ইসলামের শক্তিশালী দুর্গ হিসাবে গড়ে তুলুন। তাকওয়া ও ঈমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আল্লাহ্র এই পবিত্র ঘরগুলোকে বিশেষ কোন ব্যক্তি, দল-গোষ্ঠির নামে নামকরণ করে মুসলিম জাতিকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো আত্বঘাতিমূলক কাজ করবেন না। হানাফী, সালাফী, মাযহাবী লা মাযহাবী, মুকাল্লিদ, গাইরে মুকাল্লিদ, আহলে হক, আহলে হাদীস ইত্যাকার নামে মসজিদগগুলো বিভক্ত করে মুসলিমদের মাঝে বিভেদ বিসম্বাদ ছড়ানোর মতো আত্মঘাতীমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকুন। না হয় আমাদের সামনের দিনগুলো আরও অনেক ভয়াবহ হবে, যার মাশুল গুনতে হবে গোটা জাতিকে। যুগের পর যুগ কিংবা শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আসুন আমরা আরেকটু সহনশীল হই। সকল প্রান্তিক চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে থেকে, কট্টরপন্থা, আত্মম্ভরিতা, হটকারীতা ও ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ পরিহার করে তাওহীদের ভিত্তিতে একটি সামগ্রিক কল্যাণকর ইসলামী সমাজ ববস্থার ভীত রচনা করি। আল্লাহ্ আমাদের তাওফিক দিন।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]