বিবেকের আদালতে আল্লামা ইকবাল ও মুহিব খান
যার খোঁজে আমি আকাশ পাতাল এতকাল চষে ফিরেছি
সে যে বসে আছে আমারই ভেতর আমি কি কখনো ভেবেছি?
এই বোকামির খবর যদিবা রটে যায় পৃথিবীতে–
তাইতো কাবার চৌকাঠে পড়ে লজ্জায় মুখ ঢেকেছি।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন উপরের এতো চমৎকার এই কবিতাটি কার? কেউ কেউ হতো ভাবছেন এতো দারুণ অর্থবোধক অসম খোদাপ্রেমে কাতর এই মরমীয় মহাবাণীর কবিতাটি বোধয় আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের। না বিষয়টি এমন নয়। বরং এটি মুসলিম জাগরণের দার্শনিক কবি, মুক্তির আশা জাগানিয়া কবি, মানবতার কবি, মহাকবি আল্লামা ইকবালের। আল্লামা ইকবাল ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এক ক্ষণজন্মা কালজয়ী কিংবদন্তী মহাপুরুষ। তিনি মুসলিম জাতিসত্তার মুক্তির কবি। আমাদের বিশ্বস্ত চিন্তার অতন্দ্র প্রহরী। জাতির কল্যানকামী মুয়াজ্জিন। চেতনায় আদর্শিক মুহাফিজ। তিনি ইসলামী রেনেসাঁর কবি। তিনি বিশ্বকবি। তিনি আল্লামা ইকবাল।
তিনি ঘুমন্ত বিবেককে, তন্দ্রাচ্ছন্ন মুসলিম জাতিকে কাব্যের চাবুক মেরে জাগিয়ে তুলেছেন। নিস্তব্ধ মুসলিম দেহে হিমশীতল রক্তের ধারায় জেগে ওঠার তীব্র প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আজীবন অন্তরে এই বিশ্বাস লালন করেছেন, বিশ্বের বুকে ইসলাম একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই।
তিনি সেই মহাবাণীর মহানায়ক “আমি ভারত ও ইসলাম দুয়েরই বৃহত্তর স্বার্থে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি”। তাই তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। ইতিহাসে মুসলিম মিল্লাতের স্বাধিকার আন্দোলনে একটি নব জাগরণ সৃষ্টির মহাপুরুষ। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দ্রোহের এই বিদ্রোহী কবি একদা গেয়েছিলেন-
ওঠো দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।
কিষাণ-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও।
আর তিনি কেনইবা এমন হবেন না! তিনি যে মনিষীদের কাছে ইলম, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিখেছেন তারাও যে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান গরিমায় ছিলেন অতুলনীয়! মাওলানা গোলাম হাসান ও সৈয়দ মীর হাসানের কাছে আল্লামা ইকবাল প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রায় দশ বছর তাদের সাহচর্যে থেকে আরবি, উর্দু, ইংলিশসহ নানা ধর্মীয় জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। তার এ দুজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর। মূলত তারাই শিশু, কিশোর ও তরুণ ইকবালের অন্তরচক্ষু খুলে দেন। অন্তরে উম্মাহর দরদ, ব্যথা ও ভালোবাসা প্রোথিত করে দেন। ফলে ইকবাল হয়ে ওঠেন একসময় জ্ঞান গরিমায় প্রস্ফুটিত বিদগ্ধ বিদ্বান আর জাতির মুক্তির দিশারী।
গত ১৪ অক্টোবর হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কয়েকটি সংগঠন এর আয়োজনে আয়োজিত হল জাগ্রত কবি মুহিব খানের ‘জাগ্রত প্রহর’ নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান ভালো মতো শেষ হলেও পরক্ষনেই শুরু হয়েছে তা নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদ বিতর্ক। ইসলামী পাড়ার বাসিন্দারাই মূলত এ সমালোচনার সূত্রপাত ঘটান। পরে তা ভাইরাল হয় অন্যান্য মহলেও। এরই ধারাবাহিকতায় তার আল্লামা লকব নিয়েও শুরু হয় অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদ বিসম্বাদ। সেই সাথে মুহিব খানের আল্লামা লকব বাতিলের জন্য মহাকবি ইকবালের আল্লামা লকব কেড়ে নেওয়ারও হাস্যকর প্রতিযোগিতা। মুহিব খান বয়স, যোগ্যতা, কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি, সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতা ও ক্যাবের ব্যাপকতায় আল্লামা লকব ধারণের উপযুক্ত কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু আল্লামা ইকবালকে নিয়ে এধরনের কোন কথা আমি কস্মিন্নকালেও শুনিনি। কখনো দেখিনি কাউকে তার আল্লামা লকব নিয়ে টানাটানি করতে। বহু আলেম-ওলামাকে বারংবার দেখেছি ইকবালকে আল্লামা বলতে। বারবার দেখেছি ইকবালের কবিতাকে বিমুগ্ধ ভালোবাসায় বিমোহিত হয়ে আওড়াতে-
“আরব হামারা, চীন হামারা
হিন্দুস্তাঁ হ্যায় হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম, ওতন হ্যায়
সারা জাঁহা হামারা”।
“আরব আমার, ভারত আমার, চীনও আমার-
নহে তো পর-
মুসলিম আমি, জাহান জুড়িয়া
ছড়ানো রয়েছে আমার ঘর”।
বিড়বিড় করে গাইতে শুনেছি,
“শের কি সার পে বিল্লি খেল রাহি
ক্যায়সা হ্যায় মুসলমাঁ কা বদ নসীব
শাহাদাত কি তামান্না ভুল গ্যায়ি
তাছবি কি দাঁনু মেঁ জান্নাত ঢুঁন্ড রাহী”।
আরব আজমের কোথাও দেখিনি তার গায়ে আঁচড় বসাতে। তার শত্রুদেরও দেখেছি তাকে সম্মান ও সমীহ করে আল্লামা বলতে। কেবলমাত্র আমরাই ব্যতিক্রম! আমরা বোধয় এমনই, সবকিছুতেই একটু ব্যতিক্রমই। মাঝে মাঝে সাহস করে খানভক্তদের বলতে ইচ্ছা করে, আচ্ছা বলুন তো, মুহিব খানকে আল্লামা ইকবালের সঙ্গে তুলনা করার কেন এই ব্যর্থ প্রয়াস ও শিশুসুলভ প্রতিযোগিতা? একটি আল্লামা শব্দের উপাধি কি মুহিব খানের এতই প্রয়োজন? না হলে কি তিনি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন? তা না হলে আল্লামা হওয়ার কেন এই ব্যর্থ কসরত? সময় তো তার শেষ হয়ে যায়নি। সবে তো মাত্র পথচলা শুরু। অনুরোধ এখনি তাকে শেষ করে দিবেন না।
প্রতিভাধর, শক্তিমান এই তারুণ্যের জাগ্রত কবিকে দেশ, জাতি ও গোটা উম্মাহকে জাগাতে দিন। উম্মাহকে কিছু দিতে দিন। এখনি তাকে আল্লামা বানিয়ে দিবেন না। তবেই প্রথিতযশা এই যুবক সমহিমায় আপন আলোকে একদিন উদ্ভাসিত হবে। দিকদিগন্তে সুভাস ছড়াবে। বাংলাদেশ ছাপিয়ে একদিন সারা বিশ্ব জয় করবে। এভাবেই হয়ে উঠবে একদিন মুহিব খান মুসলিম জাগরণ ও রেনেসাঁর কবি। তখন আর আপনাদের কষ্ট করে আল্লামা লকব দিতে হবে না। সেদিন গোটা জগতই তার সাক্ষী দিবে। বলবে আল্লামা মুহিব খান। অনুরূপভাবে খানবিরোধীদেরও বিনয়ের সঙ্গেই বলতে ইচ্ছে করে, ভাইরে! আপনি এমন এক দেশে বাস করেন যে দেশের সবাই আল্লামা। বড় বড় আলেমের অভাব থাকলেও এ দেশে আল্লামার অভাব নেই!
সারা পৃথিবী জুড়ে বাংলাদেশের মতো এতো আল্লামা আপনি আর কোথাও পাবেন না। এটিই আজকের নির্মম বাস্তবতা। শুধু আল্লামাই নয়, এদেশে যতো খতীবে যামান, খতীবে মিল্লাত, শাইখুল ইসলাম, শাইখুত তাফসীর, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, বাতিলের আতংক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা, বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কুরআন, কুতুবে আলম, অলিয়ে কামেল আছে, তাবৎ দুনিয়া খুঁজেও তা আর পাবেন না। হাটবাজারে, অলিগলিতে শুধুই আল্লামা আর আল্লামা! সুতরাং আপনি মুহিব খানের আল্লামা নিয়ে এতো ক্ষ্যাপলেন কেন ভাই? যে দেশে মুফাসসিরে কিসসারা দিব্বি আল্লামা হয়ে বসে আছেন, সেখানে প্রতিভাবান যোগ্যতা সম্পন্ন একজন উদীয়মান কবি মুহিব খান আল্লামা হলে দোষের কি? আপানার যদি পছন্দ না হয় আপনি আল্লামা না ডাকবেন, তাই বলে তো আপনি মহাকবি ইকবালের আল্লামা ধরে টানাহেঁচড়া করতে পারেন না। তাই না? এটি কি মুহিব খানের প্রতি পরশ্রীকাতরতার প্রতিহিংসায় ইকবালের প্রতি অশুভ অবিচার নয়?
জামায়াতে ইসলামী ইকবালকে আল্লামা বানায়নি এটিই সত্য। আল্লামা বানিয়েছে ওলামায়ে কেরাম। এটিই ইতিহাস। এখন কেউ তা স্বীকার করুক বা না করুক। সুতরাং স্যুটেড বুটেড বলে উপহাস করে কাউকে আজীবন দাবিয়ে রাখা যায় না। কারো যোগ্যতাকে অস্বীকার করা গেলেও মুছে ফেলা যায় না। মূলত এসব অর্থহীন কথা বোধ হয় এখন আর সচেতন শিক্ষিত মানুষ গিলেওনা।
মহান আল্লাহহ্ বলেন, ইন্না আকরমাকুম ইন্দাল্লাহি আতক্বকুম। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি পররহেযগার/তাক্বওয়াসম্পন্ন।
তাই আসুন ইকবালকে নিয়ে আমরা আরো চর্চা করি। গবেষণা করি। তাকে নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় থেকে মুক্ত থাকি। বস্তুত যারা ইকবালকে গভীরভাবে চর্চা করেন তারা এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য বাক্যালাপে সময় অপচয় করেন না।
লেখক: যাকারিয়্যা মাহমূদ
এমফিল গবেষক, আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।
১৯ অক্টোবর, ২০১৭ ইং