দুআ-মুনাজাতে নবী রাসূলের উসিলা দেয়া: একটি পর্যালোচনা
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على أشرف الأنبياء والمرسلين محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين.
বিভিন্ন দুআ মুনাজাতের সময় দেখা যায়, ইমাম সাহেব বা আলেম সাহেব দুআ-মুনাজাতের মধ্যে বলছেন, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তোফায়েলে আমাদের দুআ কবুল করুন।’ অনেকে বলে থাকেন, ‘হে আল্লাহ আপনার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলায় আমাদের দুআ কবুল করুন।’
একটি মসজিদে মাঝে মধ্যে জুমুআর সালাত আদায় করতাম। দেখতাম, ইমাম সাহেব দ্বিতীয় খুতবায় দুআ করার সময় বলছেন:
أللهم إنا نتوسل إليك بجاه نبيك الميمون.
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমরা আপনার বরকতময় নবীর ওসীলা নিচ্ছি.. ।
একটি দুআ অনুষ্ঠানে শুনলাম, দুআকারী আলেম সাহেব বলছেন :
سهل يا إلهي كل صعب بحرمة سيد الأبرار.
‘হে আমার মাবুদ! নেককারদের মহান নেতার মর্যাদায় সকল মুশকিল আসান করে দিন।’
হজের সফরে বিমানে এক ব্যক্তিকে দেখলাম, আমার পাশে বসে দুআ করছে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার রওজা যিয়ারত করার জন্য হজে রওয়ানা দিলাম। আপনি আল্লাহর কাছে শাফায়াত করে আমার হজ কবুল করিয়ে দিন।’
অনেক দিন পূর্বে একটি জিকিরের জলছায় বসেছিলাম। দেখলাম, জলছার পরিচালক বলছেন, ‘সকলে বলুন, আমার কলব অমুকের কলবের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ আছে। তার কলব দাদাপীর অমুকের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ আছে। তার কলব অমুকের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ আছে … । তার কলব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ আছে, হে মাবূদ তার অসীলায় আমাদের তওবা কবুল করুন …।’
সুবহানাল্লাহ! তারা যা বলছে, মহান আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মুক্ত। এগুলো সবই হল অসীলা। অবশ্যই ভ্রান্ত অসীলা। নিশ্চয় এগুলো বিদআতী অসীলা। সন্দেহ নেই- এগুলো শিরকী অসীলা। এ সকল অসীলার স্বপক্ষে আল্লাহ তাআলা কোন প্রমাণ নাযিল করেননি। তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল অসীলার কথা বলে যাননি।
মুমিনের জীবনে ঈমান আর ইসলাম হল সবচে বড় সম্পদ। সর্বশ্রেষ্ঠ মূলধন। এ সম্পদটিকে সর্বদা ভেজাল মুক্ত রাখতে হবে। নিখুঁত রাখতে হবে তা আল্লাহ তাআলার জন্য । ঈমান যদি কোন কিছুর মাধ্যমে ভেজাল বা কলুষিত হয়ে যায়, তাহলে মুমিনের জীবনে দুনিয়া আখেরাত সবই বরবাদ হয়ে যাবে। দুনিয়া বরবাদ হবে, কারণ সে ইসলাম মান্য করায় কাফেরদের মত দুনিয়ার মজা ভোগ করতে পারেনি। তাদের মত অবাধে চলাফেরা ও বাধাহীন জীবন উপভোগ করতে পারেনি। আবার ঈমান ও ইসলামকে নির্ভেজাল না করার কারণে সব নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে, ফলে আখেরাতে কিছুই পাবে না।
তাই নিজের আসল সম্পদ ঈমানকে খালেস ও নির্ভেজাল করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ঈমানকে নির্ভেজাল করার কথা বলেছেন আল কুরআনে। ইরশাদ হচ্ছে :
যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে জুলুমের সাথে সংমিশ্রণ করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা আর তারাই সুপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম : ৮২)
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হল, ঈমান গ্রহণ করলেই মুক্তি পাওয়া যাবে না। ঈমানকে সকল প্রকার শিরক থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ আয়াতে জুলুম বলতে শিরককে বুঝানো হয়েছে। ঈমানদারকে সর্ব প্রকার শিরক থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
• প্রশ্ন হতে পারে, শিরক আর ঈমান কি একত্র হতে পারে? যে শিরক করে তাকে কি আবার মুমিন বলা যায়? হ্যাঁ, বলা যায়। আর সে হল ভেজাল মুমিন।
দেখুন আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, তবে শিরক করা অবস্থায়। (সূরা ইউসূফ : ১০৬)
এ সকল মানুষেরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে বটে, কিন্তু সাথে সাথে তার সাথে শরীক স্থির করেছে।
আরো উদাহরণ দেখুন। কিভাবে তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখত কিন্তু সাথে সাথে শিরক করত।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, ‘কে আকাশমন্ডলী আর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র সূর্যকে নিয়োজিত করেছেন?’ তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। তাহলে কোথায় তাদের ফিরানো হচ্ছে? (সূরা আনকাবুত : ৬১)
দেখুন, এতগুলো বিষয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখার পরও তাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ, তারা শিরক করত।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:
আর তুমি যদি তাদের প্রশ্ন কর, কে আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতপর তা দিয়ে মৃত্যুর পর যমীনকে জীবন দান করেন? তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা আনকাবুত : ৬৩)
এমনিভাবে তারা আল্লাহ তাআলার সকল কর্তৃত্ব স্বীকার করে ঈমান আনার পর শিরক করেছে। ফলে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। সব আমল ব্যর্থ হয়ে গেছে।
• আমরা অনেকেই মনে মনে ভাবি যে, আল্লাহ তাআলার প্রতি আমার বিশ্বাস অনেক মজবুত। তাই আমি যদি কবরে যেয়ে দুআ করি, মাজারে মানত করি। আর মাঝে মধ্যে একটু আধতু অসীলা দিয়ে দুআ করি, তাতে আমার ঈমানের কি এমন ক্ষতি হবে?
এমন ভাবনার মানুষের জন্য এ আয়াতসমূহে শিক্ষা গ্রহণের বিষয় আছে। আছে চিন্তার বিষয়।
আল্লাহ আমাদের সকলকে হিদায়াত দান করুন।
শিরক ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। সকল ভাল কাজ ও নেক আমলকে বরবাদ করে দেয়। শিরক এমন মারাত্নক বিষয় যা নবীওয়ালা ঈমানেকও শেষ করে দেয়। দেখুন আল্লাহ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলছেন :
আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, যদি তুমিও শিরক করো, তাহলে অবশ্যই তোমার আমল ব্যর্থ হয়ে যাবে। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার : ৬৫)
শিরক নবী রাসূলদের মজবুত ঈমান-আমলকেও নষ্ট করে দিত, যদি তারা তাতে জাড়াতেন।
তাই সকল মুমিন-মুসলমানের উচিত হল সদা-সর্বদা শিরক থেকে সচেতন থাকা। যে সব বিষয়াদি শিরকের পথে নিয়ে যায় তা থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে নিজের ঈমানকে হিফাজত করা আর আমলকে কার্যকর রাখা।
যে সকল বিষয় মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায় তার একটি হল অসীলা গ্রহণ। দুআ-মুনাজাতে অসীলা গ্রহণ, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য অসীলা গ্রহণ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অসীলা গ্রহণ ইত্যাদি সকল অসীলাই শিরক। তবে যে অসীলাসমূহ শরীয়ত অনুমোদিত তা শিরক নয়।
এই অসীলার পথ দিয়েই অনেক মানুষ মারাত্মক শিরকের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এই অসীলার ধারণা থেকেই বহু মানুষ মূর্তি পূজা ও পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হয়েছে। তারা অনেকে বিশ্বের সকল কর্তৃত্ব আল্লাহ তাআলার বলে বিশ্বাস করত। কিন্তু মূর্তি ও বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত এ বিশ্বাসে যে, এগুলো তাদেরকে আল্লাহ তাআলার কাছে পৌছে দেয়ার মাধ্যম। এ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা ইবাদত তো কেবল আল্লাহর জন্যই করি। আর ঐ সকল মূর্তি ও দেব-দেবী অসীলা মাত্র।
দেখুন তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
আর যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের অলী হিসাবে গ্রহণ করে তারা বলে, আমরা তাদের ইবাদত করি না তবে এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে। (সূরা যুমার : ৩)
দেখুন, তাদের বক্তব্যই প্রমাণ, তাদের ইবাদত-বন্দগীর মূল লক্ষ্য ছিল কিন্তু আল্লাহ তাআলা। তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্যই তো তারা এগুলোকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করেছে। এগুলোর সামনে মাথা নত করে প্রণাম করেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তা কবুল করেননি। কাজটাকে আল্লাহ তাআলা, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যকে গ্রহণ বলে অভিহিত করেছেন। অসীলা গ্রহণের ফলে তাদের ইবাদত-বন্দেগী ভেজালে কলুষিত হয়ে গেছে।
তবে দুআ মুনাজাতে সব ধরনের অসীলা কিন্তু নিষিদ্ধ নয়। কিছু অসীলা আছে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা অনুমোদিত ও প্রমাণিত। এগুলো শিরক নয়। আর যে সকল অসীলা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা অনুমোদিত নয় তা পরিত্যাগ করতে হবে।
এখানে আমরা শরীয়ত অনুমোদিত অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহ সমর্থিত অসীলাগুলোর কথা আলোচনা করব।
• দুআ-মুনাজাতে শরীয়ত অনুমোদিত অসীলা হল তিন প্রকার:
এক : আল্লাহ তাআলার সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলীর মাধ্যমে দুআ করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আল্লাহর রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। অতএব তোমরা সে সব নামের মাধ্যমে তাঁর কাছে দুআ কর। (সূরা আরাফ : ১৮০)
যেমন আমরা বলি ইয়া রাহমান! আমার উপর রহম করুন। ইয়া রাযযাক! আমাকে রিযক দান করুন ইত্যাদি।
এভাবে আল্লাহ তাআলার নামের অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা যায়। এটা দুআ-মুনাজাতের একটি উত্তম পদ্ধতিও বটে। বড় কথা হল, আল্লাহ আমাদের-কে তাঁর নামের অসীলা নিয়ে দুআ-প্রার্থনা করতে আদেশ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নামের অসীলা দিয়ে দুআ করতেন।
হাদীসে এসেছে –
عن أنس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم كان إذا حزبه أمر- أي أحزنه- قال: يا حي يا قيوم برحمتك أستغيث . رواه الترمذي وقال حديث حسن
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত হতেন তখন বলতেন : হে চিরঞ্জীব, চিরন্তন সত্ত্বা! আপনার রহমতের অসীলায় আপনার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। (বর্ণনায় : তিরমিজী)
এ হাদীসে আমরা দেখলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার দু’টো নাম ও তাঁর রহমত নামক গুণের অসীলায় দুআ করলেন। আবার ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যূমু বলে তার মহান দুটো নামের অসীলা নিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলার সুন্দর নাম ও গুণাবলীর অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করার দৃষ্টান্ত সহীহ হাদীসে অসংখ্য রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সুন্দর নাম ও গুণাবলীর অসীলায় দুআ করার জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।
দুই. নিজের সুন্দর ও ভাল কোন নেক আমলের অসীলা দিয়ে দুআ করা:
যেমন বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে এসেছে :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا- قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- يَقُوْلُ : اِنْطَلَقَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكَمُ ْحَتّى أوَوا الْمَبِيْتَ إلى غَارٍ فَدَخَلُوْهُ، فَانْحَدَرَتْ صَخْرَةٌ مِنَ الْجَبَلِ، فَسَدَّتْ عَلَيْهِمُ الْغَارَ، فَقَالُوْا : إنَّه لَايُنْجِيْكُمْ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةَِ إلَّا أنْ تَدْعُوا اللهَ بِصَالِحِ أعْمَالِكُمْ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنْهُمْ : اللّهُمَّ كَانَ لِيْ أبْوَانِ شَيْخَانِ كَبِيْرَانِ وَكُنْتُ لَا أغْبِقُ قَبْلَهُمَا أهْلًا ولَا مَالًا، فَنَأى بِيْ فيْ طَلَبِ شَيْئٍ يَوْمًا، فَلَمْ أرِحْ عَلَيْهِمَا حَتَّى نَامَا : فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوْقَهُمَا، فَوَجَدتُّهُمَا نَائِمَيْنِ، وَكَرِهْتُ أنْ أغْبِقَ قَبْلَهُمَا أهْلًا أوْ مَالًا، فًلَبِثْتُ – وَالْقَدْحُ عَلَى يَدِيْ- أنْتَظِرُ اِسْتِيْقَاظَهُمَا حَتّى بَرِقَ الْفَجْرُ، فَاسْتَيْقَظَا فَشَرِبَا غَبُوْقَهُمَا، اللّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةِ، فَانْفَجَرَتْ شَيْئًا لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ الْخُرُوْجَ.
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : وقال الآخَرُ : اللَّهُمَّ كَانَتْ لِيْ بِنْتُ عَمٍّ، كَانَتْ أحَبَ النَّاسِ إلَيَِّ، فَأرَدتُّهَا عَنْ نَفْسِهَا، فَامْتَنَعَتْ مِنِّيْ حَتَّى ألَّمَتْ بِهَا سَنَةٌ مِنَ السِّنِيْنَ، فَجَائتْنِيْ فَأعْطَيْتُهَا عِشْرِيْنَ وَمِائةَ دِيْنَارٍ عَلَى إن تُخَلِّيَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ نَفْسِهَا، فَفَعَلَتْ، حَتَّى إذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا، قَالَتْ : لَا أحِلُّ لَكَ أنْ تَفُضَّ الْخَاتَمَ إلَّا بِحَقَّهِ، فَتَحَرَّجْتُ مِنَ الْوُقُوْعِ عَلَيْهَا، فَانْصَرَفْتُ عَنْهَا وَهِيَ أحَبُّ النَّاسِ إلَيَّ، وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِيِ أعْطَيْتُهَا، اللّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، غَيْرَ أنَّهُمْ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ الْخُرُوْجَ مِنْهَا.
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ: وقَالَ الثَّالِثُ : اللّهُمَّ إنِّيْ اسْتَأجَرْتُ أجَرَاءَ، فَأعْطَيْتُهُمْ أجْرَهُمْ غَيْرَ رَجُلٍ وَاحِدٍ تَرَكَ الَّذِيْ لَهُ وَذَهَبَ، فَثَمَّرْتُ أجْرَهُ حَتّى كَثُرَتْ مِنْهُ الْأمْوَالُ فَجَاءَنِيْ بَعْدَ حِيْنٍ فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، أدِّ إلَيَّ أجْرِيْ، فَقُلْتُ لَهُ : كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أجْرِكَ، مِنَ الْإبِلِ، وَالْبَقَرِ، وَالْغَنَمِ، وَالرَّقِيْقِ، فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، لَاتَسْتَهْزِئْ بِيْ، فَقُلْتُ : إنِّيْ لَا أسْتَهْزِئُ بِكَ فَأخَذَهُ كُلَّهُ فَاسْتَاقَهْ فَلَمْ يَتْرُكْ مِنْهُ شَيْئًا، اللَّهُمَّ فَإنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، فَخَرَجُوْا يَمْشُوْنَ. رواه البخاري(2111)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ করে। আকস্মাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে এবং তাদের উপর গুহামুখ বন্ধ করে দেয়। এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, ‘তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারবে এমন কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া কর তাহলে হয়ত নাজাত পেতে পার।’
তাদের একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবার-দুগ্ধ পেশ করতাম না। একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি তাদের জন্য রাতের খাবার দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান বা মালিকানাধীন গোলাম-পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি পেয়ালা হাতে তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের রাতের খাবার-দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দোয়ার ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত ও অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দিই, এ শর্তে যে, আমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতে রাজি হল। আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না, তবে বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে আছি, তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল, তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমি কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দেই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত, সে নিজের মজুরি রেখে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আমার মজুরি পরিশোধ কর।’ আমি তাকে বললাম, ‘তুমি যা কিছু দেখছ, উট-গরু-বকরি-গোলাম, সব তোমার মজুরি।’ সে বলল : হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, ‘উপহাস করছি না।’ অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল। তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। (বর্ণনায় : সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম, নিজের সৎকর্মসমূহের মধ্যে যে কাজটি সুন্দর ও নির্ভেজাল আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত তার অসীলায় দুআ করা হয়েছে। ও দুআ কবুল হয়েছে।
তাই নিজের নেক আমলের অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা জায়েয।
তিন : জীবিত নেককার লোকদের কাছে যেয়ে দুআ-মুনাজাতে তাদের অসীলা করা
যেমন কোন ব্যক্তি একজন আল্লাহভীরু-পরহেযগার মানুষের কাছে যেয়ে বলল, জনাব আমি নতুন ব্যবসা শুরু করেছি। আপনি একটু দুআ করুন, আমি যেন ব্যবসায় সফল হতে পারি।
এ কাজটিও একটি অসীলা। আমরা অনেকেই মুত্তাকী ও নেককার মানুষ দেখলে তাদের কাছে অনুরূপভাবে উস্তাজ, মুরব্বীদের কাছে দুআ চেয়ে থাকি। এটা না জায়েয নয়। বরং এটি শরীয়ত অনুমোদিত একটি অসীলা।
সহীহ হাদীস দ্বারা এ ধরনের অসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণিত।
যেমন –
عن أنس ابن مالك رضي الله قال: أصابت الناس سنة على عهد النبي صلى الله عليه وسلم ، فبينما النبي صلى الله عليه وسلم يخطب في يوم جمعة ، قام أعرابي فقال : يا رسول ، هلك المال وجاع العيال ، فادع الله لنا . فرفع يديه ، وما نرى في السماء قزعة ، فو الذي نفسي بيده ، ما وضعها حتى ثار السحاب أمثال الجبال ، ثم لم ينزل عن منبره حتى رأيت المطر يتحادر على لحيته صلى الله عليه وسلم ، فمطرنا يومنا ذلك ، ومن الغد وبعد الغد ، والذي يليه ، حتى الجمعة الأخرى . وقام ذلك الأعرابي ، أو قال غيره ، فقال : يا رسول الله ، تهدم البناء وغرق المال ، فادع الله لنا . فرفع يديه فقال : اللهم حوالينا ولا علينا . فما يشير بيده إلى ناحية من السحاب إلا انفرجت. رواه البخاري
সাহাবী আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মানুষ অনাবৃষ্টির শিকার হল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জুমআয় খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল,’ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর পরিজন উপোস থাকছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন।’ তখন তিনি হাত তুলে দুআ করলেন। আকাশে আমরা কোন মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম না। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! তাঁর হাত নামানোর আগেই পর্বতের মত মেঘ আকাশ ছেয়ে গেল। এরপর তিনি মিম্বর থেকে নামার আগেই আমরা দেখলাম তার দাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। সেদিন তার পরের দিন, তারও পরেরদিন বৃষ্টি হল এমনকি পরবর্তী জুমআর দিনও বৃষ্টি হতে থাকল।
আবার সেই বেদুঈন দাঁড়াল অথবা অন্য কেউ। বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর মাল-সামান ডুবে যাচ্ছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দুটো উত্তোলন করে বললেন: ‘ হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষে করে দিন, আমাদের বিপক্ষে নয়।’ তাঁর হাত দিয়ে মেঘের দিকে ইশারা করা মাত্র মেঘ কেটে গেল। (বর্ণনায় : বুখারী, হাদীস নং ৯৩৩)
এ হাদীস থেকে আমরা জানলাম, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দুআ করতে বলেছেন। এটা হল দুআ করার ক্ষেত্রে অসীলা গ্রহণ। এভাবে আমরা নেককার লোকদের কাছে দুআ চাই।
এ কাজটিকে যে ‘দুআ মুনাজাতে অসীলা গ্রহণ’ হিসাবে ধরা হয় আমরা তা জানতে পারি অন্য একটি হাদীসে।
সহীহ বুখারীতে এসেছে –
أن عمر بن الخطاب : كان إذا قحطوا استسقى بالعباس بن عبد المطلب ، فقال : اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا صلى الله عليه وسلم فتسقينا ، وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا ، قال : فيسقون . (رواه البخاري)
যখন অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিত তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রা. আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। তখন তিনি বলতেন : হে আল্লাহ! আমরা আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে (অসীলায়) আপনার কাছে দুআ করতাম, আপনি আমাদের বৃষ্টি দিতেন। আর এখন আমরা আপনার কাছে আপনার নবীর চাচার অসীলায় (দুআ করছি) আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন। লোকজন বলল, তখন বৃষ্টি হত। (বর্ণনায় : বুখারী, হাদীস নং ৩৭১০)
এ দুটো হাদীস থেকে আমরা যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম।
এক. কাউকে এ কথা বলা যে, আপনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন, এর অর্থ হল, দুআর ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিকে অসীলা বা মাধ্যম করা। এটা জায়েয। যেমন সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তাকে অসীলা করে দুআ করেছেন।
দুই. যার অসীলা দিয়ে দুআ করবে তার জীবিত হওয়া ও উপস্থিত থাকা শর্ত। যেমন আমরা দেখতে পেলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত থাকাকালে তাঁর অসীলা দিয়ে দুআ করা হল। তিনি যখন চলে গেলেন, তখন তাঁরই জীবিত এক মুরুব্বী বয়োবৃদ্ধ আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর অসীলা দিয়ে বৃষ্টির জন্য দুআ করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীলা করা হল না।
তিন. কোন মৃত ব্যক্তির অসীলা দেয়া জায়েয নয়। তিনি যত বড় রাসূল, নবী, অলী বা পীর-বুযুর্গ-গাউস-কুতুব যে-ই হোন না কেন। যদি জায়েয হত তাহলে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দুআর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিতেন। তাকে বাদ দিয়ে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর অসীলা নিতেন না।
চার. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তার নাম বা মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা যে ঠিক নয় এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত হয়েছে। কারণ, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বললেন : হে আল্লাহ! আমরা আপনার নবীর অবর্তমানে তাঁর চাচা আব্বাসের অসীলায় দুআ করছি… তখন কোন সাহাবী প্রতিবাদ করলেন না। কেউ বললেন না, ‘কেন, আমরা এখনো যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিয়ে বা তার মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ করি তাহলে দোষের কী?’ কারণ, তারা জানতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তার অসীলা দিয়ে দুআ করা ঠিক নয়।
এ রকম অসীলা প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস আলোচনা করা যেতে পারে।
أخرج أحمد وغيره بسند صحيح عن عثمان بن حنيف أن رجلاً ضرير البصر أتى النبي r، فقال: ادع الله أن يعافيني. قال: )إن شئت دعوت لك، وإن شئت أخّرتُ ذاك، فهو خير) وفي رواية: (وإن شئتَ صبرتَ فهو خير لك)، فقال: ادعهُ. فأمره أن يتوضأ، فيحسن وضوءه، فيصلي ركعتين، ويدعو بهذا الدعاء: اللهم إني أسألك، وأتوجه إليك بنبيك محمد نبي الرحمة، يا محمد إني توجهتُ بك إلى ربي في حاجتي هذه، فتقضى لي، اللهم فشفّعه فيَّ. قال: ففعل الرجل فبرأ.
ইমাম আহমদসহ আরো অনেক মুহাদ্দিস সাহাবী উসমান বিন হানীফ রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আপনি আল্লাহ তাআলার কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে সুস্থতা দান করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘যদি তুমি চাও আমি তোমার জন্য দুআ করব। আর যদি চাও, তাহলে দুআ বিলম্বিত করব। আর এটা তোমার জন্য কল্যাণকর।’ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, ‘যদি তুমি চাও, ধৈর্য ধারণ করবে, তাহলে এটা তোমার জন্য কল্যাণকর।’ লোকটি বলল, ‘আপনি তাঁর কাছে দুআ করুন।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে নির্দেশ দিলেন, তুমি অজু কর। সে সুন্দরভাবে অজু করল। এরপর দু রাকাআত নামাজ আদায় করল। অতপর এভাবে দুআ করল : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি। আপনার নবী মুহাম্মাদ, রহমতের নবীর মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি। হে মুহাম্মাদ! আমি আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য আপনার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করুন। বর্ণনাকারী উসমান বিন হানীফ বলেন, লোকটা দুআ করল আর সে সুস্থ হয়ে গেল।
(সহীহ ইবনে মাজাহ ও সহীহ তিরমিজীতে শায়খ আলবানী রহ. হাদীসটির সূত্রকে বিশুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন)
এ হাদীস থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম :
এক. অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিল তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাতে। যেমন লোকটি বলল, ‘দুআ করুন।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি চাইলে দুআ করতে পারি।’
এ কথার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দুআ চাইতে এসেছিল।
আর এটা হল, অনুমোদিত অসীলার তৃতীয় প্রকার। যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
দুই. যদি লোকটির উদ্দেশ্য হত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা বা সম্মানের অসীলা দিয়ে দুআ করা, তাহলে সে তো তার বাড়িতে বসেই তার অসীলা দিয়ে দুআ করতে পারত।
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দুআ করার ওয়াদা দিলেন। সাথে সাথে তাকে বললেন, ‘তুমি যদি অন্ধত্বের উপর ধৈর্য ধারণ কর, তা তোমার জন্য কল্যাণকর।’ এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই কথার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন :
إن الله قال : إذا ابتليت عبدي بحبيبتيه فصبر ، عوضته منهما الجنة . يريد : عينيه
আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি আমার কোন বান্দাকে যখন তার প্রিয় বস্তুদুটো (চক্ষুদ্বয়) নিয়ে পরীক্ষা করি আর সে তাতে ধৈর্য ধারণ করে তাহলে আমি এর বিনিময়ে তাকে জান্নাত দান করব। (সহীহ বুখারী)
তিনি লোকটার জন্য দুআ করার আগে তাকে নসীহত করলেন। বিপদে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। কিন্তু লোকটি ধৈর্য ধারণের চেয়ে দুআ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিল।
চার. লোকটি যে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমি আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য আপনার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম।’
এ কথার অর্থ হল, আপনাকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম।
এটা হল, নেক আমলকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়। এটা তো শরীয়ত অনুমোদিত অসীলা। যা ইতিপূর্বে দ্বিতীয় প্রকার শরীয়ত সম্মত অসীলায় আলোচিত হয়েছে।
পাঁচ. এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মুজিযা প্রকাশ পেয়েছে। তার দুআয় একজন অন্ধ মানুষ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে।
ছয়. এ সকল দিক বিবেচনায় এ হাদীস দিয়ে কোনভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় বা তার অনুপস্থিতিতে তার নাম, মর্যাদা, সম্মানের অসীলা দিয়ে দুআ করার বৈধতা প্রমাণিত হয় না।
• নবী আদম আলাইহিস সালাম কি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিয়ে দুআ করেছিলেন?
আমাদের সমাজে এ কথা প্রচলিত আছে যে, নবী আদম আলাইহিস সালাম নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিয়ে দুআ করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবুল করে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই দুআ-মুনাজাতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দেয়া একটি প্রমাণিত ও অনুমোদিত বিষয়। বরং এটি একটি সুন্নাত।
প্রচলিত এ কথার ভিত্তি হল একটি দুর্বল ও মুনকার হাদীস। যা আল কুরআনের আয়াতের বিরোধী হওয়ার কারণে মুনকার বা প্রত্যাখ্যাত হাদীস বলে গণ্য হয়েছে।
সেই হাদীসটি হল :
أخرجه الحاكم في “المستدرك” (2/615) من طريق أبي الحارث عبد الله بن مسلم الفهري: حدثنا إسماعيل بن مسلمة: أنبأ عبد الرحمن بن زيد بن أسلم عن أبيه عن جده عن عمر بن الخطاب مرفوعاً: لما اقترف آدم الخطيئة قال: يا رب أسألك بحق محمد لما غفرت لي، فقال: يا آدم ! وكيف عرفت محمداً ولم أخلقه؟ قال: يا رب لما خلقتني بيدك، ونفخت في من روحك رفعت رأسي، فرأيت على قوائم العرش مكتوباً: لا إله إلا الله محمد رسول الله، فعلمت أنك لم تضِف إلى اسمك إلا أحب الخلق إليك، فقال: غفرت لك، ولولا محمد ما خلقتُك.
হাকেম তার মুস্তাদরাক কিতাবে ( ৬১৫/২ নম্বরে) আবু হারিস আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম আল ফাহরীর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইসমাঈল ইবনে মুসলিমাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই সূত্রে যে, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম তার পিতা থেকে, পিতা তার দাদা থেকে, দাদা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন আদম আলাইহিস সালাম ভুল করলেন, তখন বললেন, ‘হে আমার প্রভূ! আমি মুহাম্মাদ এর হকের অসীলায় আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যেন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন।’ তিনি বললেন, ‘হে আদম! তুমি কিভাবে চিনলে মুহাম্মাদকে, অথচ আমি তো তাকে এখনো সৃষ্টি করিনি?’
আদম বললেন, ‘হে আমার প্রভূ! আপনি যখন আমাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন, আপনার রূহ আমার মধ্যে ফুঁকে দিলেন তখন আমি মাথা উঠালাম। দেখলাম, আপনার আরশের খুটির উপর লেখা আছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আমি বুঝে নিলাম, এটা আপনার সৃষ্টির সর্বোত্তম নাম না হলে আপনি নিজের নামের সাথে লিখতেন না।’
তখন আল্লাহ তাআলা বললেন : ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। যদি মুহাম্মাদ না হত, তা হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।’
যে কারণে এ হাদীসটি দুর্বল :
এ হাদীসের সনদে দু জন বর্ণনাকারী : আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম ও মুসলিম আল ফাহরী। আব্দুর রহমান বিন যায়েদ সম্পর্কে ইমাম হাকেম লিখেছন: ইমাম বুখারী ও মুসলিম তার হাদীস গ্রহণ করতেন না। তিনি দুর্বল। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেছেন, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ হাদীস জাল করত ও মিথ্যা হাদীস রচনা করত।
ইমাম জাহাবী রহ. আল মিযান কিতাবে লিখেন, মুসলিম আল ফাহরী বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী।
ইবনে হিব্বান তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হলে যুগের শীর্ষস্থানীয় হাদীস বিশারদ শায়খ আলবানী রহ. সংকলিকত কিতাব
التوسل : أنواعه وأحكامه للشيخ الألباني
দেখা যেতে পারে। এই কিতাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীলা করার হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করেছেন স্পষ্টভাবে।
এ হাদীসটি কেন প্রত্যাখ্যান করতে হবে ?
যদি কোন হাদীসে সরাসরি আল কুরআনের বিপরীত কথা বলা হয়, তাহলে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করা হবে।
মুস্তাদরাক হাকেমে বর্ণিত, আদম আ. এর অসীলা গ্রহণের এ হাদীসটি আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন, তার বিরোধী।
এ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের অসীলা দেয়ার কারণে আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার ক্ষমা লাভ করেছিলেন।’ কিন্তু আল কুরআন বলছে অন্য কথা।
দেখুন আল্লাহ তাআলা বলেন :
অতপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেল। ফলে তখনই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী অতি দয়ালু। (সূরা বাকারা, আয়াত ৩৭)
এ আয়াত থেকে আমরা জানলাম, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওবা ও ইস্তেগফার করার কিছু বাক্য আদম আলাইহিস সালামের অন্তরে ঢেলে দেয়া হল। তিনি এ কথাগুলো বলার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করে নিলেন।
সেই কথাগুলো কি ছিল?
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তা বলে দিয়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে :
তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের প্রভূ! আমরা নিজেদের উপর জুলুম করেছি। আর যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের উপর দয়া না করেন তাহলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। (সূরা আল আরাফ, আয়াত ২৩)
সকল মুফাসসিরে কুরআন এ বিষয়ে একমত, তাওবা করার জন্য আল্লাহ যে বাণী আদম আলাইহিস সালামকে শিখিয়েছিলেন তা হল সূরা আরাফে বর্ণিত উপরোল্লেখিত দুআ।
অতএব এখন যদি কেউ বলে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দেয়ার কারণে তার তাওবা কবুল হয়েছে, তাহলে সে আল কুরআনের বিপরীত কথা বিশ্বাস করল ও প্রচার করল। এটা কুরআন প্রত্যাখ্যান অর্থাৎ হিজরুল কুরআনের অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর কুরআন প্রত্যাখ্যান করা যে কবীরা গুনাহ তাতে চুল পরিমাণ সন্দেহ নেই।
দুআ-মুনাজাতে অসীলা দেয়া কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ?
শরীয়ত সম্মত অসীলা তিন প্রকার। আল্লাহর নাম ও গুণাবলী। নিজের নেক আমল ও জীবিত নেককার মুত্তাকী মানুষের দুআ।
আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলী দিয়ে নফল দুআ-মুনাজাতে অসীলা দেয়া সুন্নাত। কারণ আল্লাহ তাআলাও আদেশ দিয়েছেন আর তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আমল করেছেন। নফল বললাম এ জন্য যে, অনেক বিধিবদ্ধ দুআ-প্রার্থনায় আমরা নিয়ম মাফিক আল্লাহ তাআলার বিভিন্ন নামের অসীলা নিয়ে থাকি। যেমন সূরা ফাতেহাতে আমরা তার কয়েকটি নাম উল্লেখ করে দুআ করি ; ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার অসীলা দিয়ে দুআ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে মাত্র। কেউ যদি জীবনে একবারও আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলি ব্যতীত অন্য কোন অসীলা দিয়ে দুআ না করে তাহলে তার কোন পাপ হবে না। তার ঈমান ইসলাম অপূর্ণ থাকবে না। তার তাকওয়া পরহেযগারীর কোন ক্ষতি হবে না।
যখন শরীয়ত অনুমোদিত অসীলা গ্রহণের হুকুম হল এ রকম তখন যে সকল অসীলা নেয়ার সমর্থনে শরীয়তে কোন প্রমাণ নেই সে সকল অসীলা নেয়ার মর্যাদা কী হতে পারে? কতটুকু প্রয়োজন ও গুরুত্ব রাখে এ সকল অসীলা? যারা বিভিন্ন কথা-বার্তায় ইনিয়ে বিনিয়ে, এখান-সেখান থেকে বিভিন্ন বাজে প্রমাণাদি, দুর্বল কথা-বার্তা দিয়ে ঐ সকল অসীলা প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাদের তাকওয়া-পরহেযগারী, দীনি সচেতনতা আর আওলাবিয়্যাত বা অগ্রাধিকার নীতিজ্ঞান কতটুকু আছে আমরা তা ভেবে দেখতে পারি। দুআ কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলী ব্যতীত অন্য কিছুর অসীলা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আর যখন আমার বান্দারা তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৬)
যখন আল্লাহ তাআলা বান্দার নিকটবর্তী তখন তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য ভিন্ন কোন অসীলা বা মাধ্যম গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই, তখন মানুষ সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাছে তার সকল প্রার্থনা নিবেদন করবে কোন মাধ্যম বা অসীলা ব্যতীত। এটাই ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য ও মহান শিক্ষা। আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ-প্রার্থনায় কোন অনুনোমোদিত মাধ্যম গ্রহণ করার দরকার নেই মোটেই। বরং অসীলার ধারণাগুলো মানুষকে শিরক বিদআতের দিকেই নিয়ে যায়।
দুআ-প্রার্থনায় মাধ্যম বা অসীলা গ্রহণ একটি বিজাতীয় বিষয়। হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে মূর্তি, পাদ্রী ও ধর্ম যাজকদের মাধ্যম বা অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। এ দিকের বিবেচনায় এটি একটি কুফরী সংস্কৃতি। যা কোন মুসলমান অনুসরণ করতে পারে না। তারা অসীলার ভাবনা থেকেই পৌত্তলিকতার প্রবর্তন করেছে।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম, মর্তবা, সম্মান-মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ করা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোন প্রমাণ নাযিল করেননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তার নাম, মর্যাদা, সম্মান দিয়ে দুআ করতে বলেননি। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর কোন সাহাবী বা তাবেয়ীন তার নাম, মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ করেননি। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসতেন। অনেক বেশী সম্মান করতেন। তাকে অনেক বেশী জেনেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কখনো তার নাম বা মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ করেননি। যদি তার নাম বা মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ করাটা শরীয়ত সম্মত হত, ভাল কাজ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই তা আমাদের বলে যেতেন। তিনি ইসলাম শিক্ষা দিতে, দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব পালনে কোন অলসতা করেননি। অতি সামান্য বিষয়ও তিনি তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন।
দুআ-মুনাজাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা গ্রহণ যদি কোন নেক আমল হত, তাহলে তিনি তার সাহাবীদের বলে যেতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার কোন সাহাবী এ রকম অসীলা দিয়ে দুআ করেননি। বরং তারা এটাকে জায়েয মনে করার কোন প্রয়োজনও অনুভব করেননি।
• কেয়ামতের সময় বা শেষ বিচারে আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন করবেন, আল্লাহ তাআলার রাসূল যা কিছু নিয়ে এসেছিল তোমাদের কাছে, তা তোমরা কতটুকু গ্রহণ করেছ?
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আর সেদিন আল্লাহ তাদের ডেকে বলবেন, তোমরা রাসূলদের কী উত্তর দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস : ৬৫)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :
সুতরাং আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করব যাদের নিকট রাসূল পাঠানো হয়েছিল। এবং অবশ্যই আমি রাসূলদের জিজ্ঞাসাবাদ করব। (সূরা আরাফ, আয়াত ৬)
অতএব, আল্লাহ তাআলা আমাদের কখনো প্রশ্ন করবেন না, তোমরা অমুক ইমাম, পীর, মুরব্বী, আকাবির বা উস্তাদের কথা মেনে নিয়েছিলে কি না। বা অমান্য করেছ কি না?
তাই কুরআন ও সহীহ হাদীস মানা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। এর বাইরে তৃতীয় কোন সূত্র দিয়ে দীনি বিষয় প্রমাণিত হবে না।
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী ও রাসূলদের পাঠিয়েছেন তাদের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার তাওহীদকে ধারণ করার জন্য।
তিনি তাদের নামের অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করে শিরকের পথ খোলার জন্য কখনো নবী রাসূল প্রেরণ করেননি।
আমাদের পক্ষ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপর, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের উপর হৃদয় নিংড়ানো হাজার হাজার সালাত ও সালাম নিবেদিত হোক।
আল্লাহ আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ তাওহীদ গ্রহণ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরে দীনে ইসলামে অটল থাকার তাওফীক দিন।
সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা: মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব