৮ই ফাল্গুন থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি, বিজিতের বিচিত্র পতিত চেতনা
আমরা বাঙ্গালী। আমরা বাংলায় কথা বলি, এ ভাষাতেই স্বপন দেখি, ইংরেজীতে নয়। ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন (১৯৫২) ভাষা আন্দোলনে শহীদরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে কেড়ে এনেছিলেন এ ভাষাতেই কথা বলার অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, যে বাংলার জন্য আমরা জীবন দিলাম ৮ই ফাল্গুন, সেই ভাষা দিবসটি পালন করছি আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি ইংরেজী তারিখে। এখানে হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি তো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলার ভাষার কথা বলা হচ্ছে কেন? হ্যাঁ তাহলে আপনাকে একটু পিছনের ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে, ১৩৫৮ সালে ঘটে যাওয়া সেই নির্মম ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে একটু ঘুরে আসতে হবে, এর পরেরটা আমিই বলছি,
ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে। ইউনেস্কো ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯ সালে দিবসটি উদযাপনের কথা প্রথম ঘোষণা করে। উইকিপিডিয়া অনুসারে এ দিবসটি প্রতিপালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ‘পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবির সপক্ষে মিছিলের ওপর সরকারি বাহিনীর গুলি বর্ষণের ফলে নিহতদের সম্মানে এবং সেই ঘটনা স্মরণের উদ্দেশ্যে।’
অবশ্য এর কৃতিত্বও বাংলার কৃতি সন্তান আরেক রফিকের। ভ্যানকুভারে (কানাডা) বসবাসরত বাঙালি রফিকুল ইসলাম ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ তে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে এক চিঠিতে বিশ্বের ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রস্তাব দেন। তার পরামর্শ গ্রহণ করে কফি আনান জাতিসঙ্ঘে এই প্রস্তাব আনেন। রফিকুল ইসলাম ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে চারজন ছাত্র (আ: সালাম, আ: জাব্বার, বরকত ও রফিক) নিহতের ঘটনাকে স্মরণ করে এই দিনটি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার পরামর্শ দেন। এই রফিকও শহীদ রফিকের ন্যায় বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সুতরাং উল্লেখিত ইতিহাস থেকে এটি স্পষ্ট যে, ক্ষমতাবানেরা নিজেদের স্বার্থে আবহমানকাল থেকেই আমার এই ভাষাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাংলার বীর দামাল সন্তানেরা শাসক গোষ্ঠীর সেই রক্তচক্ষুকে কখনো ভয় করেনি, শত বাঁধা বিপত্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ছিনিয়ে এনেছে আমরি বাংলা ভাষা।
যুক্তি তর্কের খাতিরে যদি কিছু সময়ের জন্য মেনেও নেওয়া হয় যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলা ভাষা দিবস নয়, তবুও আমরা এটি মানতে পারিনা, কেননা এটি আমাদের ইতিহাস ও অস্তিত্তের বিপরীত স্বকীয়তা বিসর্জন ও আত্মহননের শামিল। ৮ই ফাল্গুন বাংলার জন্য জীবন দিয়ে ভাষা দিবস পালন করব ২১শে ফেব্রুয়ারি? অন্তত দুনিয়ার সগৌরবে বলীয়ান সভ্য কোন জাতি কখনোই তা করবেনা। আসলে আমরা ভাষাপ্রেম ও পরিচর্যার কথা বলি, কিন্তু ভাষার মূল্যায়ন, সঠিক ইতিহাস ও তার স্বকীয়তা অন্তরে লালন করিনা। আমরা ইতিহাস পড়ি, কিন্তু চর্চা করিনা। আমরা ভুলে যাই, তাই পিছনে পড়ে যাই, একবার, বার বার, বহুবার। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করিনা।
শেষকথা: এভাবে নিজেদের ইতিহাস-অইতিহ্যের ৮ই ফাল্গুনকে ভুলে গিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মাতম করা আত্মভোলা পথহারা প্রভাত ফেরিওয়ালারই নামান্তর। তাই এ ভাষার মাসে আজ আমাদের ভাষা প্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি একটাই প্রত্যশা ও দাবী হওয়া উচিৎ, আগামী বছর থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি নয়, ৮ই ফাল্গুন হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
লেখক: যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।