শবে বরাত: সুন্নাহই মুমিনের রক্ষাকবচ
মুসলিম উম্মার জন্য রাসূল সা.-ই একমাত্র পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। রাসূল সা. এর জীবনের অনুকরণ ও অনুসরণরযোগ্য সকল আমল ও আদর্শ আল্লাহ্ তাআলা সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমাদের জন্য সংরক্ষণ করেছেন। তাই যেকোনো কর্ম বা আমলের ফযিলত জানার পাশাপাশি এ ফযিলত অর্জনে রাসূল সা. ও তার সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি বা সুন্নাহ জানাও আমাদের জন্য আবশ্যক কর্তব্য। কারণ রাসূল সা. এর সুন্নাহ ও তার সাহাবীদের কর্মপদ্ধতির বাইরে কোনো ইবাদত নেই, কোনো আমল নেই, থাকতেও পারে না। আর রাসুল সা. এর সুন্নাহ জানার একমাত্র উৎস তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস। এর বাইরে দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম বা সূত্র নেই।
এ কথা একজন মুমিনের জানা অত্যাবশ্যক যে, রাসূল সা. শুধু নেক আমলের কথা বলেই ক্ষান্ত হন নি, বরং তিনি নিজে তা পালন করেছেন, উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন, এবং আদেশ করেছেন- সকল ইবাদত তাঁর অনুকরণে তাঁর দেখানো পদ্ধতিতে করতে। তিনি এও ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর অনুমোদিত পদ্ধতির বাইরের আমল প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহ্ তাআলা এই আমল কখনো কবুল করবেন না।
শবে বরাত সম্পর্কে মোট ৩৩টি হাদীস পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ৩২টি হাদীসকে মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অবশিষ্ট ১ হাদীসকে সহীহ বা হাসান (গ্রহণযোগ্য) বলেছেন। তবে এর বাইরে লোকমুখে বা বিভিন্ন বই-পুস্তকে আরোও অসংখ্য হাদীস শোনা যায়, দেখা যায়, যা প্রকৃতপক্ষে হাদীস নয়, একদমই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা, যেমন: শবে বরাতের রাতে গোসল করা, হালুয়া-রুটি খাওয়া ও বিতরণ করা ইত্যাদি।
গ্রহণযোগ্য হাদীসটি হলো,
মুয়ায বিন জাবাল র. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ»
রাসূল সা. বলেছেন, অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি মনযোগ দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।
ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন, হাদীসটি সহীহ। সহীহ ইবনে হিব্বান-১২/৪৮১, হাদীস-৫৬৬৫।
শায়খ নাসীর উদ্দীন আলবানী উল্লেখ করেছেন,
“يطلع الله تبارك وتعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن”.
حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهم معاذ ابن جبل وأبو ثعلبة الخشني وعبد الله بن عمرو وأبي موسى الأشعري وأبي هريرة وأبي بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة.
উক্ত হাদীসটি সহীহ, যা সাহাবায়ে কেরাম রা. এর এক বড় জামাত বর্ণনা করেছেন এবং একটি হাদীস অন্য হাদীস এর সনদকে আরো মজবুত করে তুলেছে।
সাহাবীদের থেকে বর্ণনাকারীগণ হলেন:
(০১) মুয়ায ইবনে জাবাল
(০২) আবূ সালাবা আল খাসানী
(০৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর
(০৪) আবূ মূসা আল আশআরী
(০৫) আবূ হুরায়রা
(০৬) আবূ বকর সিদ্দীক
(০৭) আউফ ইবনে মালেক
(০৮) হযরত আয়েশা
(সিলসিলাতুস সহীহা-৩/১৩৫, হাদীস-৫৫১১৪৪)
এ হাদীসের আলোকে এটি স্পষ্ট যে, এ রাতের মর্যাদা ও এ রাতে মহান আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক বান্দাকে ক্ষমা করার বিষয়টি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। শায়খ আব্দুর রহমান মোবারকপূরী ও শায়খ আলবানী এমনই বলেছেন।
শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত সকল হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ মর্মে বর্ণিত ১টি হাদীস ব্যতিত অবশিষ্টগুলো সনদের বিচার-বিশ্লেষণে দুর্বল বা জঈফ কিংবা জাল, বানোয়াট বা ভিত্তিহীন। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা শবে বরাতের ফযিলত প্রমাণিত। এ রাতে আল্লাহ্ তাআলা মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী বা সম্পর্কছিন্নকারী ব্যতিত সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এ রাতে বিশেষ কোনো আমল নেই। এমন কোনো বিশুদ্ধ হাদীসও নেই যে, বান্দাকে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভের জন্য তাওবা, ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। বরং হাদীস থেকে বোঝা যায়, উপরোল্লোখিত দু শ্রেণীর মানুষ ব্যতিত আল্লাহ্ তাআলা নিজ দয়ায় এমনিতেই সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন।
সবশেষে, উম্মত হিসেবে আমাদের এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, শবে বরাতে বিশেষ কোনো আমল থাকলে তা সম্পর্কে রাসূল সা. অবশই জানতেন এবং তিনি নিজে তা আমল করতেন ও উম্মতকে শিক্ষা দিতেন। অথচ আমরা রাসূল সা. থেকে এমন কোনো আমলের কথা পাই না, যা তিনি শবে বরাতে করেছেন বা করতে বলেছেন।
আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দিন। রাসূলের আদর্শিক উম্মত হিসেবে কেবলমাত্র তাঁর থেকেই দ্বীন শেখার ও তাঁর মতো হুবহু আমল করার তাওফিক দিন। কেননা তাঁর সুন্নাহর বাইরে গিয়ে তো আমরা কোনো আমল করতে পারি না, এবং করলেও তার কোনো সওয়াব পাবো না।