আগামীর পৃথিবী হবে শুধুই ইসলামের
এক. বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর সাময়িক দুরাবস্থা দৃষ্টে কিছু মুসলিমের ধারণা হল, এই সঙ্কট ও দুরাবস্থা থেকে বুঝি মুসলিমদের উত্তরণের আর কোন পথই নেই! মুসলিমরা আর কখনো জেগে ওঠার শক্তি সঞ্চার করতে পারবে না। মুসলিমদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের যেকোন চেষ্টা ও সাধনাও হবে অর্থহীন ও ব্যর্থ। একটি ফুটো বালতিতে পানি ঢেলে যেমন লাভ নেই, তেমনি মুসলিমদের এই অধঃপতন ও ক্রান্তিকালেও পরিবর্তনের বিপ্লব ও প্রচেষ্টা সংগ্রামেরও কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তা কখনোই সফলতার আলো দেখবে না। বরং তা ব্যর্থতার কালো চাঁদরে আবৃত হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
এই সংশয়বাদীরা যদি চোখ কান খোলা রেখে একটু চতুর্দিকে দৃষ্টি দিতেন তাহলে তারা দেখতে পেতেন যে, অতি দ্রুতই বিশ্ব পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বের চিত্র পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে খুব তরিত গতিতেই। খানিক বিরতির পর আবারো ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে মুসলমানদের ব্যাপক উত্থান যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামের বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও সমকালীন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয়, ইসলাম আবারো তার হারানো অতীত ইহিহাস, ঐতিহ্য, আদর্শ, মহিমা ও তাওহীদের ঝাণ্ডা নিয়ে ধেয়ে আসছে, যার ভয়ে প্রকম্পিত ইঙ্গ মার্কিনী ও লাল বেনিয়ারা। সুতরাং আগামীর পৃথিবীর নেতৃত্ব দিবে মুসলিমরা। আগামীর বিশ্ব হবে ইসলামের।
দুই. মূলত এই ধরণের মানসিকতা চিন্তার অনগ্রসরতা এবং অসত্য কল্পনা প্রসূত হীনমান্যতা ও মানসিক বিপর্যয় থেকে উদ্ভূত একটি মানসিক রোগ। ভ্রান্ত আক্বীদা, দুর্বল ঈমান, জিহাদী চেতনায় নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ মুসলিমই কেবল এধরনের হতাশা ব্যঞ্জক হীনমান্যতায় ভোগে। আশাবাদী, ঈমানী চিন্তা-চেতনায় আত্মপ্রত্যয়ী, বিদ্যা বুদ্ধি ও বিবেচনা বোধে অগ্রসর, জ্ঞানে পরিপক্ক, সচেতন ও সবল কোন মুমিন এ ধরনের হতাশায় ভুগতে পারেন না। মুসলিমরা যখন থেকে তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বাবস্থার পরিবর্তে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে তখন থেকেই মূলত মুসলিম উম্মাহ তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্ব শাসনে তার সোনালী অতীতকে ভুলে যেতে শুরু করে। একথাও ভুলে যেতে শুরু করে যে, সকল ইসলাম-বিরোধী অপশক্তি, অসত্য ও ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র সহীহ আক্বীদাই পারে কথা বলার শক্তি ও সাহস যোগাতে। বিশুদ্ধ আক্বীদা এটি এমন একটি শক্তি যার ভয়ে পৃথিবীর সকল অপশক্তি ও তাগুতের তখতে তাউসগুলো থরথর কেঁপে ওঠে। কেননা আল্লাহ্র একাত্মবাদে বিশ্বাসী একজন তাওহীদবাদী খাটি মুসলিম দুনিয়ার কোন পরাশক্তির কাছেই মাথা নত করেন না। তিনি এক আল্লাহ্র বলে বলীয়ান হয়ে সকল বাধার প্রাচীরকে ডিঙ্গিয়ে বীর বিক্রমে বিজয়ীর বেশে সম্মুখপানে এগিয়ে যান। তাকে পৃথিবীর কোন শক্তি দমিয়ে রাখতে পারেনা।
তিন. সংশয়বাদী হতাশাগ্রস্থ দুর্বল ঈমানের এই শেণীর মুসলিমের ধারণার মূল অর্থ হচ্ছে, ইসলামের যুগ চিরতরে খতম হয়ে গেছে। পৃথিবীতে আর কখনোই পুর্ণাঙ্গ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফেয়ে রাশেদার যুগেই ইসলামী খেলাফত ও হুকুমত কায়েম সম্পন্ন হয়ে গেছে। বস্তুত তাদের এই ধারণাটি সঠিক নয়। পবিত্র কুরআন, হাদীস ও ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস অধ্যয়ন করলে বোঝা যায় যায় যে, তাদের এইরূপ ধারণা নিতান্তই একটি ভুল ধারণা যার দালিলিক কোন ভিত্তি নেই। কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও তাদের এই কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়না। ইসলাম সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞান, অজ্ঞতা বা সংশয়বাদীতার কারণেই তারা এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও বক্তত্বের অসারতা প্রমাণে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহয় অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। আমি কেবল এখানে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এর একটি হাদীস উল্লেখ করব। আশা করি এই একটি হাদীসটিই তাদের অসত্য ধারণা ও বিশ্বাসের অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “দিবা রাত্রির অবসান ঘটবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় ‘লাত’ উজ্জার পুজা করা না হবে। (আয়েশা রা.) আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ সূরায়ে তাওবার এ আয়াত هوالذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق নাযিল হওয়ার পর মনে করতাম এ আয়াতের প্রতিশ্রূত ইসলামের বিজয় সম্পন্ন হয়েছে, আর কখনো এর পরিবর্তন হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন নয়, বরং আল্লাহ্র ইচ্ছায় এর পরিবর্তন ঘটবে”। (মুসনাদে আহমদ ৫/২৭৮)।
অর্থাৎ এক সময় কুফর ও শিরকের প্রভাব বিস্তার লাভ করবে। জাহেলি যুগে মানুষ যেমন লাত, উজ্জা, মানাত তথা মূর্তিপূজা করতো তদ্রূপ ইসলাম আসার পরও আবারো কোন একটি সময় তারা সেই পূর্বেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অন্যায় অপরাধ জুলুম অত্যাচারে ছয়লাব হয়ে যাবে। মানুষ ফিরে যাবে আবারো তাদের বাপ দাদার ধর্মে। এক আল্লাহ্র ইবাদতের পরিবর্তে মানুষ নিজেদের হাতে বানানো ইলাহদের দাসত্ব করবে। পৌত্তলিকতায় ছেয়ে যাবে পৃথিবী। কিন্তু এতদসত্তেও আল্লাহ্ তাআলা আবারো ইসলামের বিজয় দান করবেন। আবারো ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার মাধ্যমে উক্ত আয়াতের পুনঃবাস্তবায়ন ঘটবে। শেষ বিজয় হবে ইসলামের।
এই হাদীসটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সংশয়বাদীদের সংশয় ভিত্তিহীন ও অমূলক।
চার. ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে বিশ্বরাজনীতি থেকে সমাজতন্ত্রের বিদায় ঘটে। এর আগে দীর্ঘ ৭০ বছর সমাজতন্ত্র তার রাহুর শক্তি নিয়ে সারা পৃথিবীকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও একটা সময় এই তন্ত্রের শোচনীয় পরাজয় হয়। সেই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে জন্ম হয় ৬টি স্বাধীন মুসলিম দেশের।
ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব ও পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান জেভিয়ার সোলানা বলেন, “স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছে, সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হবে এবং পৃথিবী মোকাবেলা করবে নতুন এক ধরনের শক্তি- যে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্য সৃষ্টি করবে নয়া হুমকি, আর সেই হুমকি হচ্ছে ইসলামিক মৌলবাদ। অতএব অদূর ভবিষ্যতে উদীয়মান ইসলামী মৌলবাদের হুমকিকে মোকাবিলার জন্য ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও একে টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য”।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জজ ওয়াকার বুশ ২০০৫ সালের ২৮শে অক্টোবর ভার্জিনিয়ার নরফোকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা দপ্তরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে দেয়া সন্ত্রাস-বিরোধী এক নীতিনির্ধারণী ভাষণে বলেন, “গত শতকের পতিত সমাজতন্ত্রের মতোই ইসলামী মৌলবাদ বর্তমান বিশ্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্দোনেশিয়া থেকে স্পেন পর্যন্ত তারা উদারপন্থিদের উচ্ছেদ করে একটি ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেয়া হবে না”।
এর আগে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর সামুয়েল পি হান্টিংটং তার বই The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order-এ লিখেন, “সমাজতন্ত্র একটি সাময়িক সমস্যা ছিল, যা উত্থানের ৭০ বছর পরই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ইসলাম দেড় হাজার বছর থেকেই পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে দন্ধে লিপ্ত। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ বাধাবার শক্তি একমাত্র ইসলামী সভ্যতার মধ্যেই বিদ্যমান। তাই নতুন বিশ্বব্যবস্থা নির্মাতাদের ইসলামী সভ্যতার উত্থানকে প্রতিহত করার বলিষ্ঠ পরিকল্পনা নিতে হবে”।
পাঁচ. আপনি যদি উপরোল্লিখিত পশ্চিমাদের এই কথাগুলোর সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন তাহলে আপনি স্পষ্টতই বোঝতে পারছেন যে, সমাজতন্ত্র বিদায় পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণে পাশ্চাত্যরা তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে একমাত্র মুসলিমদেরকেই গণ্য করে। বিশেষ করে ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের বিপ্লব তাদের সকল হিসাব-নিকাশকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হলেন তিউনিসিয়া, মিসর ও ইয়েমেনের শাসকেরা। মদ্ধপ্রাচ্চে স্থিতিশীল ইসলামী নেতৃত্ব, তুরস্ক ও সুদানে ইসলামপন্থীরাও দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায়। তিউনিসিয়া, মরক্কোতেও ইসলামপন্থীদের উত্থান। ভারতবর্ষে মুসলিমদের শক্তাবস্থান, পাকিস্তানে ইসলামপন্থীদের বিজয়, এসব নিয়ে ওরা খুব একটা সুখে নেই। বাংলাদেশ নিয়েও তারা বেশ শঙ্কিত। মসজিদ, মাদরাসা, আলেম-ওলামা ও ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময়ই তারা ভয়ে থাকে। কখন না জানি কি হয়! তাদের মাথা ব্যথা একমাত্র ইসলামকে নিয়েই। কারণ তারা এটি খুব ভালভাবেই বুঝে গেছে যে, পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা একমাত্র ইসলামেরই রয়েছে, বিগত দেড় হাজার বছরের পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার দন্ধই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সুতরাং সহজেই অনুমেয় হয় যে, ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতার দন্দ অনিবার্য সত্য। এবং এই সংঘাতে ইসলামী শক্তিরই জয় হবে ইনশা আল্লাহ্। অন্তত পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিমদের দ্রুত উত্থ্যান ও প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামী বিপ্লব ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা ও নতুন নেতৃত্বের সূচনা একথারই জানান দিচ্ছে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো, তিনি তার নূরকে প্রজ্বলিত করবেন”। (সূরা সফ, আয়াত-৮)।
আমি আশাবাদী যে, আবারো এই জমিনের আকাশে বাতাসে কালিমার পতাকা পতপত করে উড়বে। তাওহীদের ঝাণ্ডা সমুন্নত হবে বিশ্বময়। আগত শতাব্দী হবে মুসলমানদের। আগামীর পৃথিবী হবে শুধুই ইসলামের।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ও
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ইফতা ও দাওরায়ে হাদীস: যাত্রাবাড়ী ও লালবাগ জামেয়া, ঢাকা।
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা।
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।
[email protected]