সুসন্তান পরকালের সঞ্চয়পত্র
সন্তানের নরম গালে চুমুর আলপনা পৃথিবীর সব সুখ-শান্তি ও বেদনা কাব্যের চিত্রকল্প। সন্তান স্বর্গের উপমা। জান্নাতের প্রজাপতি। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, হৃদয় নিংড়ানো আলতো আদর ও ইবাদত মানে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ধন, ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের অলঙ্কার-শোভা। (সূরা কাহাফ : ৪৬)।
কোরআন অন্যত্র বলেছে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহতায়ালারই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। (সূরা শুরা: ৪৯-৫০)।
জীবন গাঙে বাবা-মায়ের বুক থেকে পূর্ণতা দেয় সন্তান। সন্তানের আকুলতা। হে আমাদের রব, আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আমাদের জন্য চোখের শীতলতা বানিয়ে দিন এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শ কর। (সূরা ফুরকান: ৭৪)।
আরও বর্ণিত হয়েছে, হজরত জাকারিয়া (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আমর রব! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (সূরা আল-ইমরান : ৩৮)। আমাদের প্রিয়নবী ও মানবতার পতাকাবাহী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের জান্নাতের প্রজাপতি বলে উপমা দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা সূত্রে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, তোমাদের শিশুরা জান্নাতের প্রজাপতি। (ইমাম বুখারি, আল আদাব আল মুফরাদাত)।
নবীজি আরও বলেছেন, তোমরা শিশুদের ভালোবাস এবং তাদের প্রতি দয়া কর। তাদের সঙ্গে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্ণ কর। তাদের কল্যাণে তোমরা রিজিক পেয়ে থাক (বুখারি-মুসলিম)। সন্তানের হাসিতে আলোকিত হোক আমাদের ভোর। রাতের নরম আলোয় জ্বলজ্বল করুক শিশুর মুখ। জীবন সংসারে ছড়িয়ে পড়ুক শিশুর অনাবিল হাসি।
সন্তান শুধু সংসারের নয় পরকালেরও পুঁজি। আমরা যারা পরকালে বিশ্বাসী, কবর, হাশর, মিজান আর হাউজে কাওসারে পেয়ালায় বিশ্বাসী তাদের কাছে সন্তান পরকালের সঞ্চয়, পুঁজি। সন্তানের ভালোবাসার ডানায় ভর করে পাড়ি দেব অনন্তকালের যাত্রা।
কোরআন বলছে, এবং যারা আখেরাত বিশ্বাস করে না তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত। (মুমিনুন ৭৪)। হজরত সাদ্দান ইবনে আওস সূত্রে মহানবী (সা.) বলেন, বুদ্ধিমান সে যে নিজেকে চিনতে পেরেছে এবং মরণ-পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করছে। আর সেই ব্যক্তি অসহায় যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণে জীবন পার করছে; কৃষক আদর-যত্নে ফসল বুনছে, মা-বাবা পরম যত্নে গড়ে তুলছেন সন্তানের ভবিষৎ। বিশ্বাসীরা নির্মাণ করে পরকালের রাজপ্রাসাদ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে মহানবী (সা.) বলেন, বাবা যখন তার সন্তানের দিকে তাকায় এবং খুশি অনুভব করে তখন সে একজন গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভ করে।
মা-বাবা সন্তান দেখে মুগ্ধ হয়। বারবার দেখে। আর এভাবেই গড়ে ওঠে তার পরকালের রাজপ্রাসাদ।
মহানবী (সা.) বলেছেন, কোনো মানুষ যখন মারা যায়, তখন তিনটি পথ ছাড়া সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। পথ তিনটি হল এক. সদকায়ে জারিয়া; দুই. উপকৃত হওয়ার মতো ইলম; তিন. সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম শরিফ ৯৪৯)।
সন্তানের দোয়া ও নেক আমলের অংশীদার হয় বাবা-মা। সুসন্তান রেখে যাওয়া মানে পরকালের জন্য সঞ্চয়পত্র খুলে যাওয়া। সন্তানের উসিলায় মৃত্যুর পর বান্দার আমল চালু থাকবে। সুসন্তান পরকালের মুক্তির উপলক্ষ হবে।
সন্তান লালন করে বেহেশত লাভের এ পথটি কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে আরও চমৎকার। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে মহানবী (সা.) বলেন, যার তিনজন কন্যাসন্তান আছে আর সে তাদের লালন-পালন, তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শন এবং তাদের ব্যয়ভার বহন করবে- তার বেহেশত নিশ্চিত। প্রশ্ন করা হল- যদি দুজন হয়! বললেন- দুজন হলেও!
সন্তানের প্রতি মমতার এক চূড়ান্ত উপমা ছিলেন হজরত ওমর (রা.)। হজরত ওমরের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীসহ সন্তান বসবাস করেন কোবায়! একদিন কোবার পথে সন্তানের সঙ্গে হজরত ওমরের দেখা। রোগা আর ক্ষুধায় কাতর সন্তানকে দেখে কেঁপে ওঠে ওমরের বুক! সন্তানকে বুকে তুলে তিনি চলে আসেন মদিনায়। অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা সন্তানের প্রতি গভীর মনোযোগী হন হজরত ওমর (রা.)।
এরই মধ্যেই সন্তানের মা এসে মামলা করে বসেন হজরত আবু বকরের (রা). দরবারে।
হজরত ওমরকে তলব করে আদালত! অভাব-অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে ওঠা সন্তানকে নিজের কাছে রাখার আবেদন করেন হজরত ওমর।
আদালত হজরত ওমরের আবেদন নাকচ করে দেন।
হজরত আবু বকর বলেন, হে ওমর! তোমার ছেলের জন্য তার মায়ের মুখের থুথু ; তোমার মধুর চেয়ে উত্তম! (পয়গামে ইনসানিয়াত : ১৩৪)।
সন্তানের ডানায় ভর করে পরকালের রাজপ্রসাদ তৈরির সূত্রটি যেন ভুলে না যাই আমরা। সন্তান ডাক্তার কিংবা ব্যারিস্টার হোক বাধা নেই, মা-বাবা মরার পর ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা’র পাঠ যেন সন্তানকে শিখিয়ে যান।
লেখক:হুমায়ুন আইয়ুব, সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম।