কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন

পবিত্র কুরআন জগতের একমাত্র অবিকৃত শ্বাশ্বত ও চিরন্তন ঐশী গ্রন্থ। নাযিলের সূচনা কাল থেকে তা আগাগোড়া এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে যে, তা যে ভাষায় এবং যে শব্দে ও বর্ণে নাযিল হয়েছিল আজ পর্যন্ত ঠিক সে রূপই আছে এবং প্রলয়কাল পর্যন্ত ঠিক তদ্রুপই থাকেব। আল-কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল রাসুল (সা)-এর যুগ। এ যুগে তাঁর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কুরআন সংরক্ষণের কাজ চলে।এ সময় প্রধানত তিনটি উপায়ে কুরআনের আয়াত সমূহকে সংরক্ষণের প্রয়াস চালানো হয়। যা নিম্নে বর্ণিত হলো:

(ক) হিফয বা মুখস্থকরণ পদ্ধতি: কুরআন নাযিলের ধারা শুরু হওয়ার পর যখন যেটুকু নাযিল হতো রাসূল (সা) সাথে সাথে তা হিফয করে নিতেন এবং সাহাবীদের নিকট তা উচ্চৈ:স্বরে পাঠ করে শোনাতেন ও তাদেরকেও তা মুখস্থ করা নির্দেশ দিতেন। ফলে মেধাবী সাহাবীগণ তা সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করে ফেলতেন। সে সময় শত শত সাহাবী ছিলেন, যাঁদের কুরআন আগাগোড়া কন্ঠস্থ ছিল।যে যুগের হাফেস সাহাবীদের মদ্যে বিখ্যাত কয়েকজনের নাম- আবু বকর, উমার,উসমান, আলী, ত্বালহা, সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবূ হুরায়রা, আমর ইবনুল আ’স, মু’আবিয়া, আয়েশা (রা)। তাঁর সবাই মুহাজির ছিলেন। অপরদিকে আনসার সাহাবীদের মর্ধ্যে যারা হাফেয ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- উবাই বিন কা’ব, যায়েদ বিন সাবিত, মু’আয বিন জাবাল, আনাস বিন মালিক (রা) প্রমুখ সাহাবীগণ।

(খ) লিখন পদ্ধতি: কুরআন নাযিলের সময় রাসূল (সা) মুখস্থ করার পাশাপাশি তা লিপিবদ্ধ করার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ‘ওয়াহী’ লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি একদল শিক্ষিত ও চৌকষ সাহাবীকে ‘কাতেবে ওয়াহী’ নিযুক্ত করেন। যাঁরা এ বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন, যায়েদ বিন সাবিত, আলী, উসমান, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উবাই ইবনে কা’ব, মু’আবিয়া, যুবাইর ইবনুল আউয়াম, আব্দুল্লাহ ইবনুল আরকাম, মু’আয ইবনে জাবাল, মুগীরা বিন শু’বা (রা) প্রমুখ।

কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার দরুন চামড়া, হাড়, গাছের পাতা, ছাল, পাথর, কাপড় প্রভৃতি লিখার উপকরণ নিয়ে তাঁরা সর্বদাই পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত থাকতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশ পাওয়ামাত্র ওয়াহী লিপিবদ্ধ করে নিতেন। এ সম্পর্কে যায়িদ বিন সাবিত (রা) বলেন, লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সা) বলতেন, ‘যা লিখেছ আমাকে পড়ে শোনাও। আমি লিখিত অংশ পড়ে শুনাতাম।কোথাও কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা শুদ্ধ করে দিতেন। এরপর সংশ্লিষ্ট অংশটুকু অন্যদের সামনে তিলাওয়াত করতেন।আর এমনিভাবে রাসূল (সা)-এর জীবদ্দশায় পর্যায়ক্রমে সমগ্র কুরআন মাজীদ হিফযকরণ ও লিখন প্রক্রিয়া অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পন্থায় সুসম্পন্ন হয়।

(গ) পঠন-পাঠন পদ্ধতি ও শিক্ষা দান পদ্ধতি: মুখস্থকরণ ও লিখন পদ্ধতি ছাড়াও রাসুল (সা) ও তার সাহাবীগণ পারষ্পরিক কুরআন শিক্ষা দান, পঠন-পাঠন ও শ্রবণ এবং আমলের মাধ্যমে তার ব্যাপক চর্চা অব্যাহত রাখেন।

সর্বোপরি প্রতি রামাযান মাসে জিবারাঈল (আ) ও মুহাম্মাদ (সা) পরষ্পরে কুরআন আবৃত্তি করতেন ।আর এভাবেই রাসূল (সা) ও সাহাবীগণের দ্বারা আল-কুরআন নিরন্তর সংরক্ষিত হতে থাকে।

সংকলন:

রাসুলুল্লাহ (সা) যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ আকারে সংকলিত হয়নি। রাসূল (সবা)-এর মৃত্যুর পর প্রথম খলীফা আবু বাকর (রা)-এর খিলাফতকালে এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে উমার (রা)-এর পরামর্শে ও যায়িদ বিন সাবিত(রা)-এর তত্ত্বাবধানে সমগ্র কুরআন সর্বপ্রথম গ্রন্থাবদ্ধ আকারে সংকলন করা হয়। তৃতীয় খলিফা উসমান মূল মাসহাফ হতে অতিরিক্ত পান্ডুলিপি তৈরী করে তা বিভিন্ন অঞ্চলে ও কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন।সেই থেকে অদ্যাবধি ‘মাসহাফে উসমানী’ বিভিন্ন প্রকারে অনুলিপি হয়ে সারা দুনিয়ায় প্রচারিত ও বিকাশিত হয়ে চলছে।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button