থার্টি ফাস্ট নাইট ও বর্ষবরণ: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতটিকে থার্টি ফাস্ট নাইট রাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ রাতে ১২টা ০১ মিনিটে ঘটা করে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান উদযাপনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতার মানুষ নতুন বর্ষে পদার্পন করে। ইদানিং আমাদের দেশেও পশ্চিমা এ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর আগে এ বঙ্গীয় মুসলিম সংস্কৃতিতে এর এতটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় নি। যদিও ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন রেওয়াজ এ দেশে আগে থেকেই কমবেশি চলে আসছে। তবে গত কয়েক বছর থেকে বর্ষবরণের সাথে সাথে যোগ হয়েছে একটি নতুন কথা “থার্টি ফাস্ট নাইট” যা হয়তো এ দেশের মানুষ বিগত এক দের যুগ আগেও শুনে নি।
উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:
ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজী নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন। প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জমশীদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে প্রবর্তন করেন নওরোজের। এখনো পারস্য তথা ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
গোঁড়ার দিকে নববর্ষ বিভিন্ন তারিখে ও বিভিন্ন ভাবে পালন করা হতো। গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ লা মার্চ, এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ লা জানুয়ারিতে।
মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ। ইউরোপিয়ানরা ধারণা করতো, এ দিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর।
ইহুদীদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন, আর কট্টরপন্থী গোঁড়া ইহুদীদের মতে সেই মাসের দ্বিতীয় দিন। ইহুদী সভ্যতায় সাধারণত তিসরি মাস হলো ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। থার্টি ফাস্ট নাইট বা বর্ষবরণ নামের এই পারস্য পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি সর্বশেষ ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর ১ লা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নির্দিষ্ট হয়। এরপর ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপেই নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ সংস্কৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে থাটি ফাস্ট নাইট বা বর্ষবরণ উৎসব উদযাপনের ব্যাপক প্রচলন ঘটে ২০০০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর মধ্যরাতের মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মধ্য দিয়ে। (সূত্র ইন্টারনেট)
দেশে দেশে এ উৎসব পালনে রয়েছে বিভিন্ন নিয়ম। থাইল্যান্ডে এ উৎসব পালিত হয় একজন অন্য জনের গায়ে পানি ছিটিয়ে, স্পেনে হয় আঙুর খেয়ে, নববর্ষের শুরুতে ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়- এ বিশ্বাস থেকে শুরুর সময়টাতে না ঘুমানো কোরিয়ানদের উৎসব, মেক্সিকোর উৎসব হলো- রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে বারোটি ঘণ্টা বাজানো, ভিয়েতনামীরা ভোর হওয়ার সাথে শিক্ষকদের নিকট র্দীঘায়ু কামনা করে, এটাই তাদের নববর্ষের উৎসব, আর্জেন্টিনাবাসী এই উৎসব পালন করে রাতে পরিবারের সব সদস্যরা একত্রে আহারের মাধ্যমে, আর সাদা পোষাক পরিধান করে ব্রাজিলিয়ানরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে।
বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রেমী বাংলাদেশীরা এ উৎসব পালন করে নাচ, গান, অশ্লীল ডিজে পার্টি, আতসবাজি, পটকাবাজি, নারী-পুরুষের উদ্যম, উতাল বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা ও অশ্লীল অসামাজিক ক্রিয়-কর্মের মাধ্যমে। ২০০০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর রাত ১২টা ২৫ মিনিটে গুলশানে থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনকারী এক তরুণীকে কিছু মাতাল যুবক শ্লীলতা হানি করে ও তার শরীরের বেশীর ভাগ কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। (সূত্র: দৈনিক মানবজমিন, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০০)। ২০০১ সালের যুবতী শাওন আখতার বাধনের ক্ষত-বিক্ষত বক্ষ-দেহ কে না দেখেছে? এ ছাড়াও এরকম বহু ঘটনা রয়েছে, রয়েছে এরকম নাম না জানা বহু বাধন।
মূলত থার্টি ফাস্ট নাইট একটি খ্রিস্টিয় সংস্কৃতি। ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান কাল থেকে চলে আসা এ দেশের বঙ্গীয় মুসলিম সংস্কৃতির বিপরীতে পশ্চিমা প্রেমীদের আমদানি করা একটি চরিত্র বিধ্বংসী নিরেট যৌনৎসব। উপরের দুটি ঘটনা থেকে যা স্পষ্ট।
আল্লাহ তা’আলা বলেন: “মহান আল্লাহ যাবতীয় অশ্লীল অন্যায় কাজ হারাম করেছেন।” (সূরা আল আ’রাফ, আয়াত: ৩২)
আল্লাহ্ তা’আলা আরোও বলেন: “আর তোমরা যিনা/ভ্যবিচারের নিকটবর্তী হয়ো না।” (সূরা বনী-ইসরাইল, আয়াত: ৩২)
থার্টি ফাস্ট নাইট সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:
আমরা মুসলিম। আমাদের জীবনের সবকিছুই হতে হবে ইসলামের আলোকে। আর ইসলাম বর্ষবরণের কথা আমাদে বলে নি। তাই এ অনুষ্ঠান কোনো মুসলিম উদযাপন করতে পারে না। উপরন্তু এ রাত্রিকে কেন্দ্র করে চলে নোংরামি, নষ্টামি, বেহায়াপনার ও অশ্লীলতার মহোৎসব। নাচ, গান, উলঙ্গ ডিজে ড্যান্স, আতশবাজি, পটকাবাজি, কনসার্ট, মদ, গাজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল ও মাদক সেবন, যুবতীরা অশালীন অর্ধ নগ্ন পোশাকে অবাধে চলাফেরা সমাজে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যুবক যুবতীরা বিপথগামী হচ্ছে। নৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন: “ঐসব নারী যারা হবে পোষাক পরিহিতা কিন্তু প্রায় নগ্ন। যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।” (সহীহ মুসলিম: ২১২৮)
এ ছাড়া থার্টি ফাস্ট নাইট বা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র অনেক কুফুরি, শিরক ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, যা একজন বিশ্বাসী মুমিনের ঈমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন, বহু মুসলিমকে দেখা যায় নববর্ষের উইশ করতে গিয়ে তারা বলেন, “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে সূচি হোক ধরা।”
এই শ্লোগানে অগ্নিপূজকদের আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। অগ্নিকে পূজা করা, সম্মান করা, আগুনের কাছে সাহায্য চাওয়া এবং আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ধারণা করা শিরক। এটি অগ্নিপূজক মুশরিকদের কাজ। তারাই কেবল আগুনের সামনে মাথা ঝুঁকায়, আগুনের ইবাদত ও দাসত্ব করে, আগুণকে ইলাহ মেনে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তাওহীদবাদী কোনো মুসলিম কখনোই এমন করতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে, আগুন মহান আল্লাহ্র একটি সৃষ্টি মাত্র, যা তিনি মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন। এ আগুন না কারো কল্যাণ সাধন করতে পারে, আর না কারো ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে।
শিরক সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তার সাথে শিরুক কারীকে ক্ষমা করবেন না।” (সূরা নিসা, আয়াত: ১১৬)
দ্বিতীয়ত থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন সম্পূর্ণরূপে একটি বিজাতীয় অপসংস্কৃতি সংস্কৃতি, যা উদযাপন করা মুসলিমদের জন্য হারাম। মুসলিমরা কখনোই বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ বা তার সাদৃশ্য রাখে কিছু করতে পারে না। ইসলাম এটি কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
রাসূল (স.) বলেছেন, «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»
“যে কেউ অন্য কোনো জাতীর সামঞ্জস্যতা বিধান করবে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে”। (আবু দাউদ, হাদীস: ৪০৩১)
সবশেষে মনে রাখা প্রয়োজন:
আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করতে হলে, তাঁর ক্ষমা ও জান্নাত লাভ করতে হলে তাঁর নির্দেশিত পথে চলতে হবে। তাঁর কথা বলতে হবে। তাঁর ইবাদত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে সময়টিতে থার্টি ফাস্ট নাইট বা বর্ষবরণ উদযাপন করা হয়, সেটি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। গভীর রাতের ‘মহান আল্লাহ্ দুনিয়ার আসমানে এসে আহ্বানকারীকে (সাহায্য প্রার্থীকে), অসুস্থ ব্যক্তিকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে (চাহিদা অনুযায়ী) যা ইচ্ছা তা ডেকে ডেকে দিয়ে যান।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«ينزل ربنا تبارك وتعالى إلى السماء الدنيا كل ليلة حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول: من يدعوني فأستجيب له، من يسألني فأعطيه، من يستغفرني فأغفر له، حتى ينفجر الفجر»
অর্থ- “রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে আমাদের রব পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেবো, কে আমার নিকট কিছু চাইবে আমি তাকে তা দিবো, কে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করবো, এভাবে ফজর হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৫৮)।
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোন, মহান আল্লাহ্ যখন তার বান্দাকে এভাবে আহ্বান করতে থাকেন তখন কী করে সে পাপাচারিতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নাফরমানীতে মগ্ন থাকতে পারে? !
তা ছাড়া শেষ রাতে তাহাজ্জুদের সালাত ও ইবাদত বন্দেগীর বিশেষ ফযিলতের কথা কুরআন, হাদীসে বর্ণীত হয়েছে। অতএব ফাস্ট নাইট নামের বিজাতীয় অপসংস্কৃতির অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের ঈমান, আকীদা ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে জীবন ও যৌবনের লাগামছাড়া উন্মাদনা উপভোগের সময় হিসেবে বেছে নেয়া মূর্খতা, নিজের প্রতি যুলুম ও চরম অন্যায়। বরং আমাদের উচিৎ, আল্লাহ্কে ভয় করা এবং সকল অন্যায়, অবিচার, অনাচার, পাপাচার, নোংরামি, নষ্টামি, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বিরত থাকা। সেই সাথে মহান আল্লাহ্র নির্দেশিত পন্থায় আমাদের জীবনকে অতিবাহিত করা। থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন ও এ রাতের যাবতীয় বিজাতীয় হারাম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে ও পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্তুতিকে বাঁচিয়ে রাখা।
আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে থার্টি ফাস্ট নাইট নামক অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করুন। উম্মাহকে বোধোদয় দিন। আমীন।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]