ঐতিহাসিক সিসিলি বিজয়: ইতালিতে ইসলামী বিপ্লব ও তার পতন

৯ই রমাদান ২১২ হিজরী, ১লা সেপ্টেম্বর ৮২৭ খৃস্টাব্দ। ইতালির সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের আকাশে ইসলামের বিজয় পতাকা পত পত করে উড়ছে। সিলিসির জমিন আল্লাহ্‌র রহমতে সিক্ত। সর্বত্রই শান্তির সুবাতাস বইছে। সুখ শান্তি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তায় মানুষের জীবন কানায় কানায় ভরে উঠেছে। আকাশে শান্তির পায়রারা ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সিসিলির এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। কিন্তু আজ সবই ভুলে যাওয়া অতীত। ইতালির সিসিলি মুসলিম ইতিহাসের আজ এক চেপে রাখা অধ্যায়। অতীত ঐতিহ্যের এক হারানো গৌরব। আজ আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে, ভূমধ্যসাগরের সর্ববৃহৎ এ দ্বীপটি একসময় মুসলিমরা ২০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে শাসন করেছিলো। ইতিহাসের নির্মম সত্য যে সেটি আজ ক্রুসেদারদের দখলে ইতালির একটি সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।

সিসিলি ভূমধ্যসাগরের মাঝ বরাবর অবস্থিত, যা ইতালির মূল ভূখণ্ড থেকে দক্ষিণে মেসিনার সংকীর্ণ স্ট্রেইট দ্বারা পৃথক হয়েছে। এর অধিকাংশ ভূমি মাউন্ট এটনের, যা ইউরোপের সবচেয়ে উচুঁ ও সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং পৃথিবীর সর্বাধিক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির একটি, বর্তমানে যার উচ্চতা হল ১০,২৯২ ফুট (৩,৩২৯ মিটার)। এ দ্বীপটিতে ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া ও জলবায়ু বিরাজমান।

ইতিহাসের শুরুটা এমন:

৮২৬ খ্রিস্টাব্দ। বাইজেন্টাইন নৌবাহিনী কমান্ডার ‘ইউফেমিয়াস’ নিজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতার কারণে রাজ্যে বিদ্রোহ করেন এবং আগলাবী আদালতে সিসিলির শাসকদের বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনদের সাথে স্বাক্ষরিত এক শান্তিচুক্তি যা আপাতদৃষ্টিতে তখনও বহাল ছিল, এর কারণে আগলাবের আমীর যিয়াদ শুরুতে ইউফেমিয়াসকে সাহায্য করতে ইতস্তবোধ করেন। এ সময় আগলাবী আমিরাতের অত্যন্ত প্রভাবশালী আলেম ও প্রসিদ্ধ ইসলামী আইনজ্ঞ আসাদ আলফুরাত যিনি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ আশ শাইবানীর সহপাঠী ছিলেন, আমীর যিয়াদকে এই যুক্তি দেখান যে, বাইজেন্টাইনরা বেশকিছু মুসলিম ব্যবসায়ীকে অপহরণ করায় বাইজেন্টাইনদের সাথে সাক্ষরিত চুক্তিটি ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এ যুক্তি আমীর যিয়াদের খুব পছন্দ হল।

৮২৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস। আসাদ আল ফুরাতের নেতৃত্বে প্রায় ১০,০০০ সৈন্যের মুসলিম সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা ত্যাগ করে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে যায়। শুরু হয় হক বাতিলের জয় পরাজয়ের অসম যুদ্ধের তীব্র লড়াই। এ যুদ্ধে আল্লাহ্‌র রহমতে বাইজেন্টাইনরা মুসলিম বাহিনীর কাছে লজ্জাজনক ভাবে পরাজয় বরণ করে। শেষ হয় সিসিলি বিজয়ের এক দুর্বার ঐতিহাসিক অভিযান।

৯০৯ খ্রিস্টাব্দ। আব্দুল্লাহ আল মাহদি নামক এক ব্যক্তি নিজেকে রাসূল সা. এর বংশধর এবং ইসমাইলী শিয়া সম্প্রদায়ের ইমাম এবং মুসলিম বিশ্বের একমাত্র বৈধ নেতা হিসেবে দাবী করে। শুরু হয় সুন্নি নিধন ও শিয়া ফেতনা। একসময় ষড়যন্ত্র ও গাদ্দারির মাধ্যমে এই মাহদি ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে নেয়। পতন ঘটে আগলাবী রাজবংশের। পরাজয় হয় সুন্নীদের। এরপর দীর্ঘসময়কাল পর্যন্ত সিসিলি শাসিত হয়েছে শিয়াদের হাতে। এসময় শিয়ারা সুন্নিদের গণহারে হত্যা করে। এর ফলে শহরগুলো মানবশূন্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শহরগুলোকে পুনরায় জনপূর্ণ করতে ফাতেমীয়রা উত্তর আফ্রিকা থেকে তাদের অনুগত নতুন অভিবাসীদের নিয়ে আসে।

সুন্নিদের উপর ফাতেমী শিয়াদের নির্যাতন দিন দিন বাড়তেই থাকে। যার ফলে সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে ব্যাপক অনৈক্য ও চরম বিভেদ তৈরির পাশাপাশি সিসিলির সাধারণ অভিবাসীদের মধ্যেও গভীর উত্তেজনা ও বিভাজন দেখা দেয়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সিসিলি মুসলিম সাম্রাজ্য থেকে একসময় চূড়ান্ত পতনের দারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়।

১০৯০ খ্রিস্টাব্দ। সিসিলির ইতিহাসে কালো মেঘের দিন। এদিনই সিসিলির মুসলিম শাসনের পিঠে চূড়ান্ত পেরেক বসানো হয়। ধ্বংস হয় ৪৪০ বছরের এক বর্ণিল মুসলিম ইতিহাস। রচিত হয় মুসলিম সিসিলির কবর। মুসলিম অনৈক্যের ফলে উত্তর ইউরোপের নরম্যান ক্রুসেদাররা সিসিলি জয় করে নেয়। এর পরও কিছু কিছু মুসলিম সিসিলির বিভিন্ন দ্বীপে রয়ে গিয়েছিলেন। সেই সব মুসলিমদের উপর খৃস্টান ক্রুসেদাররা গণহত্যা চালায়। এবং পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট সিসিলির মুসলিমদেরকে দেশের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। ও মুসলিমদের জোর করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এসময় অনেকে ক্রুসেডারদের অত্যাচারে স্বেচ্ছানির্বাসনেও চলে যায়।

১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ। সবশেষে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ থেকে সর্বশেষ মুসলিমটিকেও জোর করে বের করে দেওয়া হয়। এভাবেই অভিশপ্ত শিয়া গোষ্ঠীর গাদ্দারি আর শয়তানী ষড়যন্ত্র, কুচক্রী ইহুদিদের ইন্দন আর খৃস্টান ক্রুসেডারদের ধোঁকা, প্রতারণা ও তাদের নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে সলিল সমাধি ঘটে সিসিলির প্রায় ৮২ বছরের সুন্নিদের সোনালী শাসন, ১৬১ বছরের শিয়া শাসন, ২৪৩ বছরের গৌরবান্বিত মুসলিম শাসন আর ৪৪০ বছরের প্রতিষ্ঠিত একটি ইসলামী সভ্যতার।

★ পোষ্টের প্রথম বা মূল ছবিতে সিসিলির পালেরমো শহরের সান জিওভান্নি চার্চ, যা মুসলিম সিসিলিতে একটি মসজিদ ছিল।

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button