কওমির সনদ কওমের বহু প্রত্যাশিত আল্লাহ্‌র বিশেষ নেয়ামত

১. কওমি মাদরাসার সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এটি কওম ও কওমির জন্য আল্লাহ্‌ তা’আলার বিশেষ এক নেয়ামত। আমাদের জীবনে মহা মহীমের অশেষ ও অফুরন্ত রহমত, দয়া ও ভালোবাসার ভাণ্ডারে আরো একটি সংযোজন। আজকের এই নেয়ামত অর্জনের পিছনে যেমনি রয়েছে অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর বর্ণাঢ্য ইতিহাস, তেমনি রয়েছে অনেক অশ্রু ও রক্ত ঝরার বর্ণিল উপাখ্যান। রয়েছে শেষ রাতে তাহাজ্জুদে নীরব কান্না আর অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান রব্বে কারীমের দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা এবং অজস্র আন্দোলন-সংগ্রাম পেশের প্রদীপ্ত নাযরানা।

তাই যে মহান তাগ-তিতিক্ষা সংগ্রাম, সাধনা ও মেহনতের বদৌলতে আজকের এই অর্জন ও প্রাপ্তি, তাকে কোন ভাবেই আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। কাংখিত এই নেয়ামত ও রহমতকে অবহেলা ও খাটো করে দেখতে পারেন না। কলাপাতা, কচুপাতা, ন্যাকড়া, তেনা ইত্যাদি বলে উপহাস ও অপমান করতে পারেন না। হ্যাঁ আপনি কখনোই তা পারেননা। কোন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ মানুষ তা পারেনা। কেননা এটি পক্ষান্তরে আল্লাহ্‌ তা’আলার নেয়ামতের নাফরমানী ও অকৃতজ্ঞতারই নামান্তর।

আপানকে ভুলে গেলে চলবেনা, কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি একটি সময়োপযোগী ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি হতে পারে আপনার কাছে কলাপাতা বা তার চেয়েও কম মূল্যহীন, কিন্তু এই কলাপাতাই অপরদিকে লক্ষ লক্ষ তালিবুল ইলমদের কাছে মহা মূল্যবান, স্বপ্নের সোনার হরিণ। তাদেরকেও আপনি অবজ্ঞা করতে পারেন না।

আপনার মনে রাখা উচিৎ, আগে সাধারণ মানুষ বা শিক্ষিত সমাজ আপনার শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতো না, আপনাকে অবজ্ঞার চোখে হীন দৃষ্টিতে দেখতো। ঠাট্টা-বিদ্রূপ পর্যন্ত করতো। বাম, রাম ও সেক্যুলাররা ছাড়াও বহু সাধারণ মানুষ মনে করতো কওমিপড়ুয়ারা সমাজের বোঝা। এখন কিন্তু সে সুযোগটা তারা পাবে না। আপনার ভাষায় সেই কলাপাতাটাই কিন্তু আপনাকে সে স্থান থেকে একটি শিক্ষিত সমাজে তুলে এনেছে। আপনাকে সম্মান ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত একটি অবস্থানে সমাসীন করেছে।

আপনার বোধয় আরো মনে রাখা প্রয়োজন, যে পুষ্পিত সোনালী বাগানে আপনি ইলম আমল আখলাক শিখেছেন, বিদ্যা ভদ্রতা ইবাদত মনুষ্যত্ব মানবতা ও আদর্শের দীক্ষা নিয়েছেন, সেই সুবাসিত কানন, খাটি মানব তৈরির আদর্শ সেই সূতিকাগারই কিন্তু যুগের চাহিদায় সময়ের তাগিদে আপনার সেই শিক্ষা-দীক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসলাম, জাগতিক ও সামগ্রিক কল্যাণের বিবেচনায় একবিংশ শতাব্দীর এই বৈশ্বিকচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাকে সুযোগ্য রাহবারের ভূমিকায় এগিয়ে দিতে চায়। তাই ভালো ভাবে কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই, যুগের ভাষাটা না বুঝেই শ্রোতের বিপরীতে গিয়ে অহেতুক বা হঠকারীমূলক কোন কিছু বলা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।

২. মহান আল্লাহ্‌র কোন নেয়ামতকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সেটি আপনার কাছে যত ছোট ও গুরত্বহীনই হোকনা কেন। এটি কুরআন ও সুন্নাহ এবং এক আল্লাহ্‌র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও মজবুত ঈমানের পরিপন্থী। একনিষ্ঠ বা তাওহীদবাদি মুসলিমের বিরুদ্ধবাদী ঈমান অনিষ্টকর।

মাদারিসে কওমিয়ায় সেই শিশুকাল থেকে তো আমারা এ শিক্ষাই পেয়ে এসেছি যে, একটি পাতাও ছিঁড়ে নষ্ট করা যাবেনা, সেটি আরবি বাংলা বা যেকোনো বইয়েরই হোকনা কেন। কাগজকে সম্মান করতে হয়, কারণ এই কাগজ দিয়েই কুরআন, হাদীস লেখা হয়। একটি ভাত পরে গেলেও তা উঠিয়ে খেতে হয়। একটি মুড়িও নষ্ট করা যায়না। একটু আলুকনা ও শিমের বিচিও ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা অন্যায়। এসবই আল্লাহ্‌র নেয়ামত। উস্তাদগণ বার বার বলতেন, কোন ভাবেই আল্লাহ্‌র কোন নেয়ামতকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও খাটো করে দেখা যাবেনা। এতে আল্লাহ্‌ নারাজ হন। নেয়ামত ছিনিয়ে নেন।

দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনে এমনিতেই আমরা সকলে আল্লাহ্‌ তাআলার অজস্র অনিঃশেষ অসীম নাজ নেয়ামত ও রহমতের বারিধারায় ডুবে আছি। তার দয়ার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। নিঃসৃত সেই রহমতের ধারায় এবার যোগ হয়েছে কওমি সনদের স্বীকৃতি। এটি মহান আল্লাহ্‌ তা’আলার বিশেষ একটি দয়া ও করুণা। অসংখ্য রহমতের মাঝে একটি সুবাসিত ফাল্গুধারা। বিশ লক্ষ তৃষিত হৃদয়ে রহমতের ঝর্ণাধারা। তাই এই রহমতেরও কদর ও মূল্যায়ন করা চাই। সকল ধরণের দীনতা হীনতা নীচতা সংকীর্ণতা পরিহার করে দীপ্তমানসে অবলীলায় অকপটে স্বীকার করা চাই আল্লাহ্‌র নেয়ামতের। একান্তে একনিষ্ঠ চিত্তে স্বীকৃতি চাই স্রষ্টার এই অপার করুণার। শুকরিয়া আদায় করা চাই মহান রবের। আমাদের উচিৎ প্রতিটি রহমত প্রাপ্তির পরে আরো বেশি আল্লাহ্‌মূখী হওয়া। দাম্ভিকতা, আত্বম্ভরিতা পরিহার করে কৃতজ্ঞ চিত্তে অবনত শীরে সিজদায় লুটিয়ে পড়া। তবেই আশা করা যায় আমরা প্রকৃত নিষ্ঠাবান ও কৃতজ্ঞ মুমিন হতে পারবো।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন, তিনি তোমাদের কান, চোখ ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন; তোমরা খুবই অল্প কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাকো। (সূরা আল মু’মিনূন,৭৮)।

মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আরো বাড়িয়ে দিবো, আর অকৃতজ্ঞ হলে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। (সূরা ইবরাহীম,৭)।

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
মদীনা মুনাওয়ারা, ভোর ৪:১০ মি., ২৩ শাবান, ১৪৩৮ হি., ১৯ মে, ২০১৭ ইং, জুমাবার।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button