জীবনে হেরে গেলে কী করবেন? আসুন তা আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই শিখে নেই

আপনি যখন একবার হেরে যাবেন দেখবেন আপনি বারবারই হেরে যাচ্ছেন। যখন কোন বিপদে পতিত হবেন দেখবেন কখনও কখনও একই সময় আরও কিছু বিপদ আপনাকে ঘিরে ধরেছে। আর জীবনের এ সময়টিতে আপনি দুপায়া কিছু বিচিত্র মানুষেরও দেখা পাবেন। যারা আপনাকে কড়া গন্ডায় বুঝিয়ে দিবে, আপনি একজন হেরে যাওয়া মানুষ। ছলে বলে কলে কৌশলে আপনার এই দূর্বলাতার সুযোগে ওরা আপনাকে প্রমাণ করে ছাড়বে যে, পৃথিবী আপনার জন্য নয়! আপনার প্রয়োজন এখানে ফুরিয়ে গেছে। আপনি এখন এখানে একটি আগাছা। তাই খুব শিগগিরই এখান থেকে আপনার চলে যাওয়া উচিত!

ঘরে কিংবা বাইরে চলার পথে আকারে ইঙ্গিতে খুব সুক্ষাতিসুক্ষ ভাবে অপমানের মাধ্যমে সেটি আপনাকে মনে করিয়ে দিবে বারবার। ফলে আপনি জীবনের প্রতি কোন ভালোবাসা, অনুরাগ বা বেঁচে থাকার কোন আকর্ষণই আর বোধ করবেন না। ধীরে ধীরে নিজের প্রতি একসময় চরম হতাশা ও নাভিশ্বাস জন্ম নিবে। একটা সময় হয়তো আপনিও ভাবতে থাকবেন ঠিক তাদের মতো করেই। মূলত তখনই আপনি হেরে যাবেন চূড়ান্ত রূপে। জীবনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারাবেন চিরতরে। তবে যদি আপনি মুমিন হন তাহলে আপনি এসময়ও অটল ও অবিচল থাকবেন। আপনার মনে ঈমানের নূরস্ফুলিঙ্গ অযুত তেজ ও তীব্রতায় প্রজ্বলিত হবে। বোঝতে পারবেন, আপনি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সাময়িক কোন পরীক্ষায় নিপতিত হয়েছেন। আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া মুমিনকে কোন অকল্যাণ স্পর্শ করে না। সুখ-শান্তি, বেদনা বিদূর দুঃখ-যাতনা আল্লাহ্‌র তরফ থেকেই এসে থাকে। আপনার কর্ণকুহরে বারবার বেজে ওঠবে আর অন্তগহীনে প্রতিধ্বনিত হবে কুরআনের সেই মর্মধ্বনিগুলো-

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَن يُؤْمِن بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيم.ٌ

আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, সে তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করে। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত। (আত তাগাবুন- ১১)।

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ.

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসলাদী বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। (আল বাকারা-১৫৫)।

যখন আপনি উপরের দুটি আয়াতকে স্মরণ করবেন তখন হয়তো মহান আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করে আপনার অন্তরে আরেটি প্রশান্তির বাণী ঢেলে দিবেন, তখন আপনি অন্তরে এক অনাবিল সুখ ও পরম শান্তি অনুভব করবেন।

الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ.

যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। (আল বাকারা-১৫৬)।

আপনি যখন দয়াময় মহামহীমের উপরোক্ত কথা গুলোকে স্মরণ করতে সক্ষম হবেন তখন আপনার মনে জাগরূক হবে আমার রবের সেই ঐশী বাণী, তোমরা “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না”। (সূরা ইউসুফ- ৮৭)।

আপনি আল্লাহ্‌র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে বিমূর্ত হবেন। এই কঠিন মুহূর্তেও আপনি নিঃসংকোচে দ্যর্থহীনভাবে বলিষ্ঠকণ্ঠে উচ্চারণ করবেন, এক আল্লাহ্‌ই আমার জন্য যথেষ্ট। আপনি আবারো ঘুরে দাড়াবেন। ব্যর্থতা শিখাবে আপনাকে সফলতার পাঠ। আপনি শিখবেন কীভাবে হেরে গেলে জীবনের অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দূরে সরিয়ে দিতে হয়। নিষ্প্রয়োজনীয় জঞ্জাল গুলোকে দূরে নিক্ষেপ করতে হয়। কিছু মানুষকে চিনে রাখতে হয় জীবনের তরে, কিছুকে ফেলে দিতে হয় জীবনের প্রয়োজনে। শিখবেন এসব কেন আর কেমন করে করতে হয়। এক আল্লাহ্‌র প্রতি যদি আপনার অগাধ বিশ্বাস থাকে তবে আপনি আপনার তনুমনে আসমানী আত্মপ্রশান্তির একটি কোমল স্পর্শ অনুভব করবেন। দেখবেন যে, আপনি আগের চেয়েও বহুগুণ সতেজ ও ফুরফুরে হয়ে ওঠছেন। নবোদ্যমে সবকিছুকে নতুন করে শুরু করার এক আধ্যাত্বিক শক্তি অনুভব করছেন। মহান আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اصْبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.

“হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার”। (আল ইমরান- ২০০)।

আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন,

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.

“বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। (যুমার- ৫৩)।

প্রিয় ভাই ও বোন আমার!
আপনার ভালো করে মনে রাখা উচিৎ, যিনি আপানাকে জীবনে অপ্রত্যাশিত কোন পরীক্ষায় ফেলতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই কল্পনাতিত ভাবে সে পরীক্ষায় আপনাকে ব্যাপক সফলতাও এনে দিতে পারেন। আপনি হয়তো জীবনে এমন কিছু হারিয়েছেন যা কখনো কল্পনা করেন নি। কিন্তু একথা আপনার ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, যা হারিয়েছেন তার বিপরীতে আল্লাহ্‌ আপনাকে এমন উত্তম কিছু দিতে সক্ষম, যা আপনি কখনো ভেবেই দেখেন নি। তাই হেরে যাওয়া মানেই শেষ হয়ে যাওয়া নয়। হেরে যাওয়া মানে নতুন করে আরেকবার শুরু করা। জীবনে যেখানে গিয়ে থেমে যাবেন, সেখান থেকেই আবারো শুরু করুন। জীবন যুদ্ধের এই চলতি পথে যেখানেই হোঁচট খাবেন, সঙে সঙেই উঠে দাঁড়ান। যখনই পা পিছলে পরে যাবেন, আত্মপ্রত্যয়ে তখনই উঠে পড়ুন। স্বকীয় সত্তায় স্বমহিমায় সুতীব্র নব চেতনায় আবারো জেগে উঠুন। বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাড়ান। মনে রাখবেন, কখনোই পরনির্ভরশীল হবেন না। জীবনে কারো কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। এ জগতে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই। পিছন থেকে আপনাকে টেনে ধরার লোকের সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আপনি হোঁচট খেয়ে পরে গেলে আপনাকে হাত ধরে টেনে তোলার মানুষের বড়ই অভাব! হ্যাঁ সত্যিই বড় অভাব!

তাই মহান আল্লাহ্‌র প্রতি পূর্ণ ঈমান রাখুন। তিনিই একমাত্র আপনাকে বিজয়ী করতে পারেন। বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। মানবতার মুক্তির মহান দূত রাসূলে আরাবীর সেই অমীয় বাণীকে স্মরণ করুন আর সদা-সর্বদাই তারই শিখানো ভাষায় কায়মনোবাক্যে করুণাময় আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করুন, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন। হে আল্লাহ, তোমার নিকট আমার দুঃখের যোগ্য পুরস্কার আছে; অতঃএব আমাকে তা থেকে মুক্ত কর এবং উত্তম কিছু দান কর”। (তিরমিযি ও ইবনে মাজা)।

তথাপিও আল্লাহ্‌ না করুন যদি আপনি সত্যিই পার্থিব এই জগতে জীবনে চলার পথে কোন এক গলিতে হেরেই যান তো আপনার জন্যই আল্লাহ্‌ তাআলার নিম্মোক্ত ঘোষণাটি। যদি আপনি প্রকৃত মুমিন হন।

لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ.

“তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথা কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা। (ইউনুস- ৬৪)।

শেষকথা, মুমিন বান্দারা কখনোই হারেন না, বস্তুত তারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে পার্থিব জগতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আর এভাবেই তারা বিপদাপদের এই পরীক্ষায় সবর ও ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ পাকের প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়ে তারই জান্নাতের চিরস্থায়ী অধিবাসী হয়ে থাকেন।

যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
মসজিদে নববী, মদীনা মুনাওয়ারা।
বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১৮।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button