যিলহজ মাসে চুল, নখ ইত্যাদি কাটার বিধান
‘যারা কোরবানি দিতে সক্ষম নয় তারা যিলহজ্জের প্রথম নয়দিন নখ, চুল, পশম ইত্যাদি না কেটে কোরবানির দিন কাটলে তাদের কোরবানি করার সওয়াব লাভ হয়’ এমন কথা এক হাদীসে থাকলেও তা সহীহ নয় মর্মে অনেক মুহাদ্দিসীনে কেরাম মন্তব্য করেছেন। কারণ এর সনদে রাযী ‘ঈসা বিন হিলাল আস্ সদাফী নামের একজন রাবী রয়েছেন। তাকে অনেক মুহাদ্দিস নির্ভরযোগ্য বলেননি। ইবনু হিব্বান তাকে সিকাহ বলেছেন, তবে ইমাম যাহাবী ইবনু হিব্বান এর এ তাওসীক্বকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাদীসটি হল,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ» . قَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: «لَا وَلَكِنْ خُذْ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ مِنْ شَارِبِكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ». رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ.
’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা কোরবানির দিনকে এ উম্মাতের জন্য ’ঈদ’ হিসেবে পরিগণিত করেছেন। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! আমি যদি মাদী ’মানীহাহ্’ ছাড়া অন্য কোন পশু না পাই। তবে কি তা দিয়েই কোরবানি করব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: না; তবে তুমি এ দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে। তোমার গোঁফ কাটবে। নাভীর নীচের পশম কাটবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পরিপূর্ণ কোরবানি।
(আবূ দাঊদ-২৭৮৯, নাসাঈ-৪৩৬৫, শারহু মা‘আনির আসার-৬১৬১, ইবনু হিব্বান-৫৯১৪, দার কুত্বনী-৪৭৪৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী-১৯০২৮)।
)الراوي: عبدالله بن عمرو | المحدث: الألباني | المصدر: هداية الرواة، الصفحة أو الرقم: 1424 | خلاصة حكم المحدث: في إسناده عيسى بن هلال الصدفي، وفيه – عندي – جهالة(
তাহলে যিলহজ মাসে চুল, নখ ইত্যাদি কাটার বিধান কী?
উত্তর: যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানি করার নিয়ত করে থাকেন, তাহলে তিনি যিলহজ মাসের চাঁদ ওঠা থেকে শুরু করে কোরবানি করা পর্যন্ত হাতের নখ, মাথার চুল বা শরীরের যে পশমগুলো রয়েছে, সেগুলো কাটবেন না। এটি কোরবানির সঙ্গে যুক্ত মাসআলা। এ বিধান শুধু ওই ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য যিনি কোরবানি করবেন, অর্থাৎ পশুর মালিক। পরিবারের সদস্য বা অন্য কারো জন্য এ বিধান সাব্বস্ত হবে না। এ ক্ষেত্রে নর-নারীর মাঝেও কোন পার্থক্য নেই। কোন নারী তিনি বিবাহিত হন বা অবিবাহিত হন, যদি কোরবানি করতে চান তাহলে তিনিও তার শরীরের চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকবেন। যেহেতু এ মর্মে বর্ণিত হাদীসটি ব্যাপক ও সাধারণ অর্থবোধক। যা নারী পুরুষ উভয়কে শামীল করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
سَمِعْتُ أُمَّ سَلَمَةَ، تَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أَهَلَّ هِلَالُ ذِي الْحِجَّةِ فَلَا يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ قَالَ أَبُو دَاوُدَ: اخْتَلَفُوا عَلَى مَالِكٍ، وَعَلَى مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرٍو، فِي عَمْرِو بْنِ مُسْلِمٍ قَالَ بَعْضُهُمْ عُمَرُ، وَأَكْثَرُهُمْ قَالَ عَمْرٌو قَالَ أَبُو دَاوُدَ: وَهُوَ عَمْرُو بْنُ مُسْلِمِ بْنِ أُكَيْمَةَ اللَّيْثِيُّ الْجُنْدُعِيُّ
উম্মু সালামাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যার কুরবানীর পশু রয়েছে, সে যেন যিলহজ্জ মাসের নতুন চাঁদ উঠার পর থেকে কুরবানী করার পূর্ব পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।
(আবূ দাঊদ-২৭৯১)
হাদীসের মর্মার্থ:
১। হাদীসের বাহ্যিক মর্ম থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নখ, চুল ইত্যাদি না কাটার বিধান যিনি কোরবানি করবেন তার জন্য খাস। তার পরিবারের সদস্য বা অন্য কারো জন্য নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুকুমটাকে কোরবানিকারীর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। এর (বিপরীত) মর্মার্থ হচ্ছে- যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে বা যারা করছে না, তাদের জন্য এ হুকুম সাব্যস্ত নয়।
২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন। কিন্তু এমন কোন বর্ণনা আসেনি যে, তিনি তাদেরকে বলেছেন যে, ‘তোমরা তোমাদের চুল, নখ ও চামড়ার কোন অংশ কেটো না’। যদি এগুলো করা তাদের জন্য নিষেধ হত তাহলে অবশ্যই তিনি তাদেরকে নিষেধ করতেন। এটাই অগ্রগণ্য অভিমত।
৩। যে ব্যক্তির সামর্থ্য না থাকার কারণে তার কোরবানি করার ইচ্ছা নেই তার জন্য এগুলো কাটা হারাম নয়। আর কোরবানি করতে ইচ্ছুক এমন কেউ যদি এগুলো কেটে ফেলে তার উপর ফিদিয়া আবশ্যক হবে না। বরং তার উপর তাওবা ও ইস্তিগফার করা আবশ্যক হবে।
ইবনে হাযম বলেন: যে ব্যক্তি কোরবানি করতে ইচ্ছুক যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা গেলে সে তার দেহের চুল বা নখ ইত্যাদি হাত দিবে না; অর্থাৎ কামাবে না কিংবা ছাটবে না কিংবা অন্য কোন ভাবে দূর করবে না। আর যে ব্যক্তির কোরবানি করার সংকল্প নেই তার উপর এগুলো অবধারিত নয়। (আল-মুহাল্লা, ৩/৬)
ইবনে কুদামা বলেন: এটা যখন সাব্যস্ত হল তখন সে ব্যক্তি চুল কাটা, নখ কাটা বর্জন করবে। যদি করে ফেলে তাহলে আল্লাহ্র কাছে ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করবে। তাকে ফিদিয়া দিতে হবে না মর্মে ইজমা সংঘটিত হয়েছে; চাই সে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করুক কিংবা ভুলক্রমে করুক। (আল-মুগনি, ৯/৩৪৬)
শাওকানি বলেন: এ নিষেধাজ্ঞার হেকমত হলো, কোরবানিকারীর শরীরের সম্পূর্ণ অংশ অটুট থাকুক; যাতে করে গোটা দেহ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পায়। কারো কারো মতে, ইহরামকারীর সাথে সাদৃশ্যস্বরূপ এ বিধান। এ দুটি হেকমত ইমাম নববী উল্লেখ করেছেন।
ইমাম শাফেয়ির ছাত্রবর্গ থেকে বর্ণিত আছে যে, দ্বিতীয় হেকমতটি ভুল। কারণ ইহরামকারী আরও যেসব জিনিস বর্জন করে থাকে কোরবানিকারী তো সেগুলো বর্জন করে না; যেমন- নারী, সুগন্ধি, সাধারণ পোশাক ইত্যাদি। (নাইলুল আওতার, ৫/১৩৩))
আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
পরিশেষে, যিলহজ্জ মাসের ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস ও আমল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেগুলো জেনে সঠিকভাবে আমল করে পরিপূর্ণ সওয়াব লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন।
যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল:
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
প্রিন্সিপাল: জামিআতুল বানাত আল-ইসলামিয়া, মিরপুর-১, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।