হামাস ও ফিলস্তিন সংকট: মুসলিম উম্মাহর করণীয়
ফিলিস্তিনের জাতীয় বিদ্রোহী কবি মাহমূদ দারবীশের কথা দিয়ে শুরু যাক। কবি বলেন:
‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে,
ধরীত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়।
শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?
শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?’
এক. ১৯৪৮ এর ১৫ই মে, ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে জারজ রাষ্ট্র ইসরাঈলের জন্ম ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার স্বাদ। আবদ্ধ করেছে পরাধীনতার জিঞ্জীরে। ছিনিয়ে নিয়েছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা আল-আকছা। ইহুদী দখলদারিত্বের ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। ফিলিস্তিনিদের পাশে কেউ দাড়ায়নি। ৭৫ বছর ধরে মার খেয়ে যাচ্ছে, নিজেদের বসত-ভিটা হারিয়েছে। মাতৃভূমি হারিয়েছে। দেশ হারিয়েছে। হারিয়েছে বাবা-মা ভাই-বোন স্বামী-স্ত্রী সন্তান স্বজন সব। একদিন তাদের সবই ছিল। কিন্তু আজ তাদের কিছুই নেই। তারা নিঃস্ব রিক্ত শুন্য। তারা নিপীড়িত মযলুম। অভিশপ্ত ইহুদী দখ-লদার জায়োনিস্টরা তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রব সবকিছু লুট করেছে। জন্মভূমি ছিন্তাই করেছে। ওরা হয়েছে উদ্ধাস্ত, শরণার্থী। সন্ত্রাসী খুনি ও ধর্ষকদের ৭৫ বছরের এই দখলদারিত্ব ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে ডেকে এনেছে এক অমানিশার ঘোর অন্ধকার। দীর্ঘ এই পরাধীনতার প্রতিটি মুহূর্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য ছিল আতংকের। এর পরও যদি বলা হয়, হামাস হামলা করল কেন? না করলে তো এই যুদ্ধ হতো না। গাযায় এতো প্রাণহানি ঘটতো না। তারা হয়তো শুধু হা মা সে র এই আক্রমণটাকেই দেখেছে। বর্বর দখলদার ইহুদীদের ৭৫ বছরের যুলুম নির্যাতন অত্যাচার খুন ধর্ষণ ও ফিলিস্তিনি মুসলমানদের গণহত্যা দেখেনি। আসলে তারা হয়তো জানেই না যে, গাযাবাসী তো দীর্ঘ পচাত্তর বছর ধরে যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছে। হামাসের জন্মই তো যুদ্ধের ভেতর। অতএব, নতুন করে হামাস যুদ্ধ শুরু করেছে, এবং এর ফলে তারা এই বিশাল ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এ জাতীয় কথা বলা অবান্তর ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
দুই. ফিলিস্তিন-ইসরাঈল সংঘাতের খবর যারা রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, এই সমস্যা হঠাৎ ২০২৩-এ শুরু হয়নি। নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিরা ৭৫ বছর ধরে বিভিন্ন যুলুম অত্যাচার নির্যাতন ও সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্সের শিকার। সবাই এসব ভুলে গেলেও মযলুম ফিলিস্তিনিরা ভুলতে পারে না। সবাই বিস্মৃত হলেও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তীনীদের আত্মবিস্মৃত হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। নিজেদের মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার, আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখা, সর্বোপরি পবিত্র আল-আকছার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে ফিলিস্তিনিদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না। তারা জানত এই হামলার ফলে ইসরাঈলের ক্ষয়ক্ষতি যা-ই হোক, তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতি হবে তাদের। তারা জানতো তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। এতদসত্তেও ভয়ে তাদের পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না। যে জনপদের প্রতিটি বাড়ি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, সে জনপদের মানুষের বুকে জ্বলা তুষের আগুণের মর্ম আর কেউ না বুঝলেও তারা তো বোঝে। সেই মর্মজ্বালাই তাদেরকে এই মরিয়া আক্রমণে বাধ্য করেছে। সাম্রা জ্যবাদী হা য়ে না দের ছোবলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নিপীড়িত মযলুম ফিলিস্তিনিদের বস্তুত এখন আর কোন পথ নেই। তাদের সামনে এখন একটাই পথ, হয় প্রতিরোধ, নয় শাহাদাত। তারা আর জন্মভূমি ছাড়তে রাজি নয়। তাদের এখন একতাই কথা, ফিলিস্তিন আমাদের। আমরা আমাদের জন্মভূমি থেকে বের হব না। বের হলে আমাদের লাশ বের হবে। তারা হামাসের সঙ্গে আছে। শুধু হামাস নয় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা রক্ষায় উৎসর্গিত প্রতি আন্দোলনের সঙ্গে তারা আছে। বিকলাঙ্গ আরব নেতারা ভীরু কাপুরুষের পরিচয় দিতে পারে, কিন্তু নিরীহ ফিলিস্তিনিরা কাপুরুষ নয়। ওরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। বরং মৃত্যুর মুখেই ওদের জন্ম।
তিন. গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় ইসরাঈলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু নতুন ইসরাঈল রাষ্ট্রের যে মানচিত্র উপস্থাপন করেছেন, তাতে পশ্চিম তীর ও গাযা উপত্যকাকে ইসরাঈলের অংশ দাবি করা হয়েছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাষণ দেওয়ার সময় মধ্যপ্রাচ্যের দুটি মানচিত্র দেখান নেতানিয়াহু। প্রথমটি ইসরাঈল রাষ্ট্র সৃষ্টির বছর ১৯৪৮ সালের। আর পরেরটিকে তিনি আখ্যা দেন নব্য মধ্যপ্রাচ্য নামে। সেখানে তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাযাকে ইসরাঈলের অংশ দাবি করেন।
ইসরাঈলের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার পর ফিলিস্তিন ইস্যু এখন কোন আঞ্চলিক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন মুসলিম উম্মাহর ইস্যু। বাইতুল মাকদিস বা আল-আকসার ইস্যু। সর্বোপরি এটি এখন ঈমান ও কুফুরের ইস্যু। এটি স্পষ্ট মুসলিম ও ইহুদীবাদের যুদ্ধ। ইসলাম ও কুফুরের সংঘাত। হক ও বাতিলের চিরন্তন লড়াই। সালাফে সালেহীনের মানহাজ হল, যখন ইসলাম ও কুফুরের মধ্যে সংঘাত হবে, বিরোধ সৃষ্টি হবে, তখন ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। তাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্ছুতি থাকলেও তা উম্মাহর স্বার্থে উপেক্ষা করতে হবে। মুসলমানদের মনে রাখা উচিৎ, হামাস কোন সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন নয়, হামাস ফিলিস্তিন ও আলকুদস পুনরুদ্ধারের এক দুর্বার দুর্জয় শহীদি কাফেলা। আলআরদুল মুক্কাদ্দাসা তথা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধা। তারা আলআকুদস ও নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করছে। সুতরাং বর্তমান ইস্যুতে হামাসের বিরোধিতা করা কোন মুসলিমের জন্য কোন ভাবেই বৈধ নয়। বরং সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এখন মুসলমানদের হামাসের পাশে থাকা ফরয। কিছু ত্রুটি-বিচ্ছুতির জন্য উম্মাহর এই দুর্দিনে তাদের বিরোধিতা মানে গোটা মুসলিম উম্মাহর বিরোধিতা। তাদের সমালোচনা মানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের পক্ষে অবস্থান করা। এই কোন সত্যান্বেষী সত্যিকার মুসলিমের জন্য বৈধ হতে পারে না।
বিশেষ করে উম্মাহর এই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায়ও যারা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পাশে নেই, ভ্রাতৃত্ববোধ অনুভব করে না, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না, কোনো পদক্ষেপ নেয় না। উপরন্তু যারা এ পথে কাজ করছে উল্টা তাদেরকেই দোষারুপ করে, তারা বড়ই অবুঝ অথবা স্বার্থান্বেষী কপট মুসলিম। তাদের কখনোই উম্মাহর দুর্দিনে পাশে পাওয়া যায় না। তারা উম্মাহর বন্ধু নয়, শত্রু ও নীরব ঘাতক।
চার. ইসরাঈলে এই হামলার চুড়ান্ত পরিণতি যে খুবই ভয়ংকর হবে, তা কারো অজানা নয়। এই অসম যুদ্ধের ফলাফল কত ভয়াবহতা সম্পর্কে হামাসপূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিল। চ্যানেল আল-আরাবিয়ার সাংবাদিক রাশা নাবিল এক সাক্ষাৎকারে শীর্ষস্তানীয় হামাস নেতা খালেদ মিশআলকে জিগ্যেস করেন, তিনি কীভাবে আক্রমণ চালিয়ে ১,৪০০ ইসরাঈলির মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবেন? তখন খালেদ বলেন, ৭ অক্টোবর আমাদের অপারেশনের পরিণতি আমরা ভালো করেই জানতাম। তার এই বক্তব্যের পর এটি স্পষ্ট যে, হামাস বুঝে শুনেই এই আক্রমণ করেছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে বার বার পরীক্ষিত এই সাহসী যোদ্ধাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ৭ই অক্টোবরের ঘটনা একটি পরিকল্পিত হামলা। এখান থেকে এটিও সহজে অনুমেয় যে, এই আক্রমণকে উপলক্ষ্য করে গা যা র অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে চিরতরে বের করে দেয়া এবং সেই সাথে আল-আকছা গোটা ফিলিস্তিনকে দখল করার একটা সহজ সুযোগ গ্রহণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ইসরাঈল।
৫. হামাসের হামলার কারণ
মূলত চারটি মৌলিক কারণে হামাস এবারের হামলা শুরু করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথমত, প্রথম কিবলা আল-আকসা ও ফিলিস্তিনের ভূমি পুনরুদ্ধার এবং ইহুদী দখলদারিত্বের অবসান।
দ্বিতীয়ত, অধিকৃত গাযার পশ্চিম তীর ও যেরুযালেমে ইসরাঈলের ক্রমাগত বসতি স্থাপন, সৈন্য মোতায়েন ও আগ্রাসী আচরণ। এমতাবস্থায় হামাসের একটি শক্তিশালী সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানো ছাড়া কোনও পথ খোলা ছিল না।
তৃতীয়ত, আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের উন্নয়ন। আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরোক্কোর সঙ্গে ২০২০ সালে ইসরাঈলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে তাদের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর বাইরে আমেরিকার সহায়তায় সৌদি আরবের সঙ্গেও ইসরাঈল সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় সমস্যা আরব ও আরব নেতাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছিল। এই শঙ্কা থেকে হামাসের এই আক্রমণ। হামাস এর মাধ্যমে আরবদের তাদের সমস্যা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছে।
চতুর্থত, ৭৫ বছর ধরে দখলদার ইসরাঈল কোনও আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর গণহত্যা, গণধর্ষণ, ও যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে আসছে। আর এ কাজে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা দোসররা ইসরাঈলকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। হামাসের এই হামলা তারই একটি প্রতিক্রিয়া।
যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (IIUC)
প্রিন্সিপাল, জামিআতুল বানাত আল-ইসলামিয়া ও মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।