হাদিসশাস্ত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী শায়খ আবদুল মুহসিন আল-আব্বাদ
শায়খ আবদুল মুহসিন আল-আব্বাদ আল-বদর। সঊদী বংশদ্ভূত বিশ্বময় পরিচিত একবিংশ শতাব্দীর এক বিরল বিস্ময়কর গুণী ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী খ্যাতি ও প্রজ্ঞায় প্রজ্ঞাবান এক দূরদর্শী বিদগ্ধ আলেম দ্বীন। তিনি এই যুগের শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ। উলূমে নবুওয়তের এক সুবিশাল চলন্ত লাইব্রেরী। বিনয়ী, মুখলিস, দাঈ ও একজন প্রতিথযশা বিশ্ববরেণ্য একজন ইসলামিক স্কলার। ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাজ্ঞ পান্ডিত্ব ও এক ক্ষনজন্মা আদর্শিক মহাপুরুষ। তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী।
এই ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ ১৩৮১ হিজরী সনে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সেখানে হাদীসের অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনিই প্রথম মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের শুভ সূচনা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৩৯২ হিজরী পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর ১৩৯৩ হিজরী সনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এর পদ অলঙ্কৃত করেন। এ পদে ছয় বছর সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন চ্যান্সেলর ছিলেন আরেক তাঁরই সুযোগ্য উস্তায, যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন, গ্রান্ড মুফতি ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.)। পাশাপাশি ১৪০৬ হিজরী থেকে মসজিদে নববীতে হাদীস, ফিকহ, আক্বীদা, আদব, আখলাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে দারস দিয়ে আসছেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারানো অশীতিপর বৃদ্ধ এই হাদীস বিশারদের ইলমী ও তাদরীসী খেদমত এখনও মসজিদে নববী ও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জারী আছে।
বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহে ৬ দিন তিনি নিয়মিত এখানে দারস প্রদান করে আসছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাঊদ, সুনানে তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ, মুছতালাহুল হাদীস ও আক্বীদার বিভিন্ন কিতাবের দারস প্রদান করছেন। মসজিদে নববীতে তাঁর প্রদানকৃত সুনানে আবূ দাউদের দারসটি শারহু সুনানে আবূ দাঊদ শিরোনামে মাকতাবা শামেলায় যুক্ত হয়েছে। এটি অত্যন্ত উপকারী একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। বর্তমানে সহীহ বুখারীর দারস দিচ্ছেন। হাদীসে নববীর এই অনবদ্য খিদমতের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৪৩৬ হিজরীতে তাঁকে রিয়াদে ‘আমীর নায়েফ বিন আব্দুল আযীয আলে সঊদ আত-তাক্বদীরিয়াহ লি-খিদমাতিস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’ শীর্ষক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারের সমুদয় অর্থ তিনি দুই হারামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে দান করে দেন।
কুরআন, হাদীস, তাফসীর, আক্বীদা, ফিক্ব, উসূলে ফিক্ব, ফারায়েযের দারসসহ উলুমে ইসলামীর এমন কোনো বিষয় নেই যার দারস মসজিদে নববীতে হয় না। শুধুমাত্র কুরআন শিক্ষা ও হিফযের হালাকা সংখ্যাই হাজারের ঊর্ধ্বে। প্রতি সালতের পরই মসজিদে নববীজুড়ে এইসব দারস হয়ে থাকে। তবে মসজিদে নববীতে যতগুলো দারস হয় তার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং তালেবে ইলমদের ভীড়ে প্রাণবন্ত দারস হচ্ছে শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদের দরস। শায়খের দারস মানেই অনন্য, অসাধারণ! কী নেই শায়খের দারসে? ইলম, আমল, আখলাক ও রুহানিয়্যাতের এ যেন এক প্রদীপ্ত কানন। নিম্নে এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল:-
জন্ম:
শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ-এর পুরো নাম- আব্দুল মুহসিন বিন হামাদ বিন আব্দুল মুহসিন বিন আব্দুল্লাহ বিন হামাদ বিন উসমান আল বদর। তিনি ১৩৫৩ হিজরী/১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে ইশার সালাতের পর রিয়াদের উত্তরাঞ্চল যুলফী নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। শায়খ আব্দুল মুহসিনের পর দাদা আব্দুল্লাহর উপাধি ছিল আব্বাদ। এ জন্য তাঁর নামের শেষে আল-আববাদ উপাধি যুক্ত হয়েছে। আরবের মূল গোত্র দুটি- আদনানী ও ক্বাহাতানী। এ দুটি গোত্র থেকেই পরবর্তীতে আরবের অন্যান্য সকল গোত্রের জন্ম হয়েছে। তাই সকল আরবই মৌলিকভাবে আদনানী না হয় ক্বাহাতানী। শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ-এর বংশ আল-বদর আদনানী গোত্র সমূহের অন্যতম গোত্র আনাযাহ-এর শাখা গোত্র আল জাল্লাস। তিনি এ বংশেরই উজ্জ্বল নক্ষত্র।
প্রাথমিক শিক্ষা:
শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কাটে নিজ জন্মভূমি যুলফীতেই। এখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। ১৩৬৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম যুলফী এলাকায় ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনই তিনি সেখানে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৩৭১ হিজরীতে তিনি সুনামের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
এখানে তিনি স্বনামধন্য যেসব শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন তাঁরা হলেন, শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ আল-মানী, শায়খ যায়েদ বিন মুহাম্মাদ আল-মুনাইফী, শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-গায়েছ ও শায়খ ফালেহ বিন মুহাম্মাদ আর-রূমী। ক্লাসিক্যাল পড়ার পাশাপাশি তিনি শায়খ হামদান ইবন আহমাদ আল-বাতিল এর নিকট ফারায়েয তথা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ও আরবি গ্রামার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা:
নিজ শহর যুলফীতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য তিনি রাজধানী রিয়াদের ‘মা‘হাদুর রিয়াদ আল-ইলমী’তে ভর্তি হন। এ বছরই শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায খারজ থেকে রিয়াদে আসেন এবং এখানে প্রথম বর্ষে পাঠদান করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য শায়খ আব্বাদ রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদে ভর্তি হন। এখানে শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৩৭৯ হিজরীতে ‘মা‘হাদু বুরাইদা আল-ইলমী’তে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। অতঃপর ১৩৮০ হিজরীতে ‘মা‘হাদুর রিয়াদ আল-ইলমী’, রিয়াদে শিক্ষক নিযুক্ত হন। শিক্ষাবর্ষের শেষের দিকে তিনি রিয়াদে ফিরে এসে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বড় বড় শায়খের দারসে অংশগ্রহণ করে ইলমী তারাক্কী ও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
শিক্ষক বৃন্দ:
তাঁর শিক্ষকগণের মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হলেন- ১. প্রথম সউদী গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শায়খ, ২. সাবেক গ্রান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, ৩. শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকীতী, ৪. শায়খ আব্দুর রহমান আফ্রীকী, ৫. শায়খ আব্দুর রাযযাক আফীফী, ৬. শায়খ আব্দুল্লাহ ছালেহ আল-খুলাইফী।
শায়খ আব্দুর রহমান আফ্রীকীর কাছে তিনি ১৩৭২ হিজরীতে রিয়াদে হাদীসও মুছতালাহুল হাদীস অধ্যয়ন করেন। শায়খ আব্বাদ তাঁর উস্তায সম্পর্কে বলেন,
كان مدرساً ناصحاً وعالماً كبيراً، وموجّهاً ومرشداً وقدوة في الخير رحمه الله تعالى
‘তিনি এজন হিতাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক, একজন বড় আলেম, দিক নির্দেশক, পথপ্রদর্শক এবং সৎকাজের আদর্শ ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর রহম করুন।[1]
শায়খ বিন বায (রহ.)-এর সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৩৭২ হিজরীতে তাঁর সাথে শায়খ আব্বাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ৪র্থ বর্ষে শরী‘আহ অনুষদে তিনি তাঁর কাছে নিয়মতান্ত্রিক পাঠ গ্রহণ করেন। পাঠের বিরতির সময় এবং মসজিদে তাঁর সাথে শায়খ আব্বাদের বেশীর ভাগ যোগাযোগ হ’ত। তিনি বাড়িতেও তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি সবমিলিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর তাঁর সাহচর্য লাভ করেন।
ছাত্রবৃন্দ:
তার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই এখন পৃথিবী খ্যাত স্কলার। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন-
১. শায়খ ড. রাবী আল মাদখালী, ২. শায়খ ড. সালেহ আস সুহাইমী, ৩. আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর, ৪. মসজিদে কুবার খতীব, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদে নববীর শিক্ষক শায়খ ড. সুলাইমান আর-রুহাইলী, ৫. শায়খ ড. ওয়াসিউল্লাহ আব্বাস, ৬. ছেলে প্রখ্যাত আলেম, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদে নববীর শিক্ষক শায়খ ড. আব্দুর রাযযাক আল-বদর, ৭. ড. আলী নাছির আল-ফাক্বীহী, ৮. শায়খ ইউসুফ বিন আব্দুর রহমান আল-বারকাভী, ৯ ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ (ভারত) ১০. হাফেয ছানাউল্লাহ মাদানী (পাকিস্তান) ১১. ড. বাসিম আল-জাওয়াবিরাহ, ১২. ড. নাছির আশ-শায়খ, ১৩. ড. ছালেহ আর-রিফাঈ, ১৪. ড. আছেম বিন আব্দুল্লাহ আল-কারইঊতী, ১৫. ড. আব্দুর রহমান আর-রুশায়দান, ১৬. ড. ইবরাহীম আর-রুহায়লী, ১৭. ড. মিস‘আদ আল-হুসায়নী, ১৮. ড. মুহাম্মাদ বিন মাতার আয-যাহরানী। বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট আলেম, স্কলারও মদীনায় শায়খের সরাসরি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। ড. এ বি এম হিযবুল্লাহ, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ, ড. মঞ্জুর-ই-এলাহী তাদের অন্যতম। এ বাইরে আরো অনেকে রয়েছেন।
এছাড়াও শায়খের বিগত ৬৫ বছরে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদে নববী থেকে হাজার হাজার ছাত্র রয়েছে, যারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন, এবং স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে ইসলাম, উম্মাহ ও মানবতার অসামান্য খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
স্মৃতিতে ভাস্বর শায়খ আব্বাদ:
শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ হাফিযহুল্লাহ শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে গৌরবে, নির্মল চরিত্রের মাধুর্যতায় এক উজ্জ্বল ভাস্কর। চিরন্তন মহাসত্যের এই প্রদীপ্ত উপমা আমার প্রিয় উস্তাদে মুহতারাম। তিনি আমার সারে তাজ। আমি ২০০৮-২০১৯ সাল পর্যন্ত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাঙ্গন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরেণ্য এই আলেমে রব্বানীর কাছে আমি কুতুবুস সিত্তার অন্যতম হাদীসের কিতাব সুনানে ইবনে মাজাহ পড়েছি। এছাড়াও তিনি মসজিদে নববীতে সুদীর্ঘকাল যাবত হাদীসের দারস দিয়ে আসছেন। বাদ মাগরিব এখানেও বহুবার শায়খের দারসে বসার সুযোগ পেয়েছি। এখনও মন চায় হাজির হয়ে যাই শায়খের দারসে। তৃষ্ণানার্থ নয়নে তাকিয়ে থাকি তাঁর নুরানী অবয়বে। পান করি ইলমে ওহির অমিয় সুধা।
মদীনায় শায়খ আব্বাদের দারসের সুখ্যাতি সর্বজন বিদিত। মাদরাসা, স্খুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইমাম, খতীব, ওলামা মাশায়েখগণ এই দারসে অংশগ্রহণ করে থাকেন। জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা তাঁর দারসে ভিড় করে। হজ্জ, ওমরায় আগত বিভিন্ন দেশের আল্লাহ্র মেহমানগণও বসেন। মাগরিবের সালাতের পর মসজিদে নববীর ৮ নম্বর গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে একটু পরই হাতের বায়ে পড়বে শায়খ আব্বাদের মনোমুগ্ধকর দারস। হাদীসের মতন, সনদ, রিজালুস সনদ, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সবই মুখস্ত এই বর্ষীয়ান বৃদ্ধ মুহাদ্দিসের। হাদীস শাস্ত্রের যেকোনো জটিল ও কঠিন প্রশ্নের উত্তর শায়খ আব্বাদ তাৎক্ষনিক প্রদান করেন। তিনি মদীনার সবচেয়ে বড় আলেম। এ ছাড়া হাদীসশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ বলা হয়। তিনি ১৩৭৯ হিজরি সন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ ৬৫ বছর হাদীসের সফল খেদমত করে আসছেন। আর তাঁর এই হাদীসের দারস ও খেদমত এতই সমাদৃত ও প্রলম্বিত যে, দুনিয়ার অন্য কোথাও এর নজির খুঁজে পাওয়া যায় না।
এছাড়াও ফিকহ, উসূল, আকীদা, কুরআন, তাফসীর, ইতিহাস, ফারায়েযসহ সকল বিষয়েই তাঁর রয়েছে অগাধ পাণ্ডিত্য। যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন তিনি অনায়াসে, মুহূর্তেই। জীবনের শেষভাগে এসে এই ইলমী মহীরুহ অন্ধ হয়ে গেছেন। ফলে তিনি স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করেই হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু তাঁর আলোচনা ও হাদীসের তাকারির বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শোনার পর কেউ ভাবতেই পারবে না যে তিনি একজন অন্ধ মানুষ। এ যেন মহান আল্লাহ্র আরেক কারিশমা! অপূর্ব নিদর্শন।
একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শায়খ আমাদের ইবনে মাজাহ-এর ক্লাস নিচ্ছিলেন। আমরা বিভিন্ন দেশী ছাত্ররা সামনে বসা। শায়খকে হুইল চেয়ারে করে আনা হলো। সালামের পর শায়খ একজনকে ইবারত পড়তে বললেন। সে পড়া শুরু করলো, আর শায়খ প্রতিটা রাবি সম্পর্কে বলে যাচ্ছিলেন। সনদে একটি নাম আসলো- মুহাম্মাদ। শায়খ প্রশ্ন কলেন মানিল মুহাম্মাদ? মুহাম্মাদ কে? তাঁর পরিচয় কী? পরক্ষণে তিনিই বলা শুরু করলেন- হুওয়া মুহাম্মাদ ইবন শিহাব আয-যুহরী…। এভাবে তিনি বলেই যাচ্ছিলেন। সেদিনের এই ঘটনাটি আজও আমার সৃতিতে জাগরূক রয়েছে। আর এভাবেই শায়খ আব্বাদ যখন আলোচনা করতেন আমি তাঁর বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি দেখে বিস্মিত হতাম। বিমুগ্ধ বিমোহিত হতাম। হতাম অভিভূত স্তম্ভিত। আমার সারা জীবনে দেশ-বিদেশে আমি এত বড় মাপের আলেম আর দ্বিতীয়জন দেখিনি। সংক্ষিপ্ত ও সাবলীল ভাষায় তিনি প্রতিটি হাদীসের সনদ/সূত্র ও মতনের (মূল টেক্সট) সার র্নিযাস তুলে ধরেন। প্রতিটি রাবির পরিচয় পেশ করেন। সবকিছু মিলিয়ে বলতেই হয়- তিনি এ যুগের ইমামুল মুহাদ্দিসীনা ফিল হাদীস, হাফেযুল হাদীস ও যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ। আর তিনি এমন হবেন না-ই কেন? তাঁর যে, বুখারী, মুসলিমসহ এমন কোনো হাদীসগ্রন্থ নেই যা মুখস্থ নয়! শুধু হাদীসের মতন বা টেক্সটই নয়, এর সনদ ও প্রতিটি রাবীর ইতিহাস পর্যন্ত তাঁর মুখস্থ সুবহানাল্লাহ! তাই দেখে মনে হয় এ যেন এক জীবন্ত আয়াতুন মিন আয়াতিল্লাহ! বা মহান আল্লাহর এক অসাধারণ নিদর্শন। মহাবিশ্বের এক মহা বিস্ময়কর মহা প্রতিভা!
জগতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে যারা পৃথিবীবাসীকে ঋণী করেছেন শায়খ আব্বাদ সেই আলোর মিছিলের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এক উদয়ালোক। তিনি আমার রাহবার। আলোকবর্তিকা, পথের দিশারী। আদর্শের বাতিঘর, আলোর মিনার। সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশ্ববরেণ্য এই ইসলামী ব্যক্তিত্বের কর্ম পরিধিও তাঁর মতোই বিশ্বময় বিস্তৃত।
রচনাবলী:
শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ বহু কালজয়ী গ্রন্থ প্রণেতা। তিনি কুরআন, হাদীস, আকীদা, ফিকহ, আখলাক, আদাব, ফাযায়েল, নাসীহা, তারাজুম, রুদূদ/খণ্ডন, ফাওয়াইদুল হাদীসসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর রচনাবলীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮টি। এর বাইরে তাঁর রয়েছে বিষয়ভিত্তিক বহু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। ১৪২৮ হিজরী পর্যন্ত তাঁর লিখিত রচনাবলী নিয়ে রিয়াদের দারুত তাওহীদ ‘কুতুব ওয়া রাসাইল আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ আল-বদর’ শিরোনামে ৮ বলিউমের একটি রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে। এতে মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪,৩২৫। তাছাড়া ২০১৭ সালে শায়খের নিজস্ব অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্যানুসারে ‘কুতুব ওয়া রাসাইল আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ আল-বদর’ শিরোনামে ১২ খণ্ডের আরোও একটি রচনাসমগ্র প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মোট পৃষ্ঠা রয়েছে ৬,২৩১ টি। এখানে তাঁর কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করা হল:-
১. ইশরূনা হাদীছান মিন হাদীসিল বুখারী।
২. ইশরূনা হাদীছান মিন সহীহিল ইমাম আল-মুসলিম।
৩. মিন আখলাকির রাসূলিল কারীম।
৪. আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ ফিছ সাহাবাতিল কিরাম।
৫ ফাদলু আহলিল বাইত ওয়া উলূমু মাকানাতিহিম ইন্দা আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ।
৬. ফাদলুল মাদীনাহ ওয়া আদাবু সুকনাহা ওয়া যিয়ারাতিহা।
৭. ফাদলু আহলিল বাইত।
৮. আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল আছার ফিল মাহদী আল-মুনতাযার।
৯. আল-ইখলাস ওয়াল ইহসান ওয়াল ইলতিযাম বিশ্যারীয়াহ।
১০. ইজতিনাউছ ছামার ফী মুছতালাহি আহলিল আছার।
১১. দিরাসাতু হাদীস নায্যারাল্লাহু ইমরাআন সামি‘আ মাক্বালাতী রিওয়াতান ওয়া দিরায়াতান।
১২. আল-হাছছু আলা ইত্তিবাইস সুন্নাহ ওয়াত তাহযীরু মিনাল বিদা ওয়া বায়ানু খাতারিহা।
১৩. বিআইয়ি আক্বলিন ওয়া দ্বীনিন ইয়াকূনুত তাফজীরু ওয়াত তাদমীরু জিহাদান?
সমকালীন আলেমদের বক্তব্য:
শায়খ আলবানী (রহ.) শায়খ আব্বাদের ইলমে হাদীসে পারদর্শিতার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল কাদের আরনাঊত বলেন, الشيخ عبد المحسن العباد أعرفه من قرابة أربعين عاما هذا الرجل في الحقيقة يعتبر من العلماء المعتدلين و رجل عالم فاضل- ‘শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদকে আমি প্রায় ৪০ বছর যাবৎ চিনি। তাঁকে মধ্যপন্থী আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি একজন সম্মানিত আলেম’।
গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করতেন।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর শায়খ হাম্মাদ আল-আনছারী বলেন, ان الشيخ عبد المحسن العباد ما رأت عيني مثله في الورع- ‘তাক্বওয়া-পরহেযগারিতায় শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদের মতো কাউকে আমার দু’চোখ দেখেনি’।
علماء وأعلام و أعيان الزلفي গ্রন্থে বলা হয়েছে, يعتبر مثالاً في العلم والعمل والاستقامة في دينه ، متواضعاً حليماً ذا أناة وتؤدة ‘ইলম, আমল ও দ্বীনের উপর সুদৃঢ় থাকার ক্ষেত্রে শায়খ আববাদকে দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। তিনি বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও ধীরস্থির’।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য ড. শায়খ সালেহ বিন ফাউযান আল-ফাউযান তাঁকে সউদী আরবের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম হিসাবে গণ্য করেছেন।
আল্লাহ তাআলা মুহতারাম শায়খের সকল দ্বীনি খিদমতগুলো কবুল করুন, এবং মুসলিম উম্মাহর উপর তাঁর নেক ছায়াকে আরো দীর্ঘায়িত করুন। আমীন।
লেখক: যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
প্রিন্সিপাল, মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা।
[email protected]