নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন একটি খ্রিষ্টীয় বিজাতীয় সংস্কৃতি। মুসলিমদের জন্য এ উৎসব উদযাপন বা এ উপলক্ষে কাউকে শুভেচ্ছা জায়েয নয়। বিপরীতে এ উপলক্ষে তারা যদি মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানায় সে শুভেচ্ছার জবাব দেয়াও মুসলিমদের জন্য জায়েয নয়। কারণ ইসলামে এ রকম দিবসের কোনো বিধান নেই। অন্যদিকে তাদের শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দেয়ার মধ্যেও এসব উৎসবের প্রতি সমর্থন ও স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। “শুভ নববর্ষ”, কিংবা “হ্যাপি নিউ ইয়ার” সেলিব্রেট করার অর্থ এই দাড়ায় যে, আমরা খ্রিষ্ট সভ্যতার সংস্কৃতি মনে প্রাণে মেনে নিয়েছি, তাদের আদর্শ বুকে ধারণ করেছি যারা পৃথিবী থেকে মুসলিমদের চিরতরে শেষ করে দিয়ে খ্রিস্টবাদ কায়েম করতে চায়। যারা ফিলিস্তিনের নিরপরাধ অসহায় মুসলিমদের হত্যা করছে। ইরাকের সুন্নি মুসলিমদের হত্যা করেছে। আফগানিস্তানের মুসলমানদের দীর্ঘ ২০ বছর ধরে হত্যা, ধর্ষণ, শোষণ, নির্যাতন করেছে। ফিলিস্তিন ধংসের জন্য ইহুদিদের মদদ দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমরা “শুভ নববর্ষ”, বা “হ্যাপি নিউ ইয়ার” মাধ্যমে সেসব অবিশ্বাসী মুশরিকদের খুশি করতে চাই, ভালবাসতে চাই যারা আমাদের এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী নয়, তিন আল্লাহ্য় বিশ্বাসী। ঈসা (আ.) কে যারা স্বয়ংআল্লাহ্ বলে, কখনো আল্লাহ্র পুত্র বলে, কখনো বলে তিনজনের তৃতীয় সত্বা।
এ মর্মে আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
“আর ইহুদিরা বলে, ‘উযাইর আল্লাহ্র পুত্র এবং নাসারারা বলে, ‘মাসীহ আল্লাহ্র পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতিপূর্বে কুফরি করেছে। আল্লাহ্ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে”? (সূরা তাওবা, আয়াত: ৩০)
অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন:
“অবশ্যই তারা কুফরি করেছে, যারা বলেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ হলেন মারইয়াম পুত্র মাসীহ”। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৭২)
খ্রিস্টানরা মূলত আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র নবী ঈসা (আ.) এর প্রতি মিথ্যারোপ করেছে। তারা ঈসা (আ.) এর প্রতি এমন সব মিথ্যা চাপিয়ে দিয়েছে যা তিনি বলেন নি। গোপন ও অস্বীকার করেছে যা তিনি তাদের বলেছন। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
“আর মাসীহ বলেছে, ‘হে বনি ইসারাঈল, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর’। নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই”। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৭২)
অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন:
“অবশ্যই তারা কুফরী করেছে, যারা বলে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তিন জনের তৃতীয়জন’। যদিও এক ইলাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। আর যদি তারা যা বলছে, তা থেকে বিরত না হয়, তবে অবশ্যই তাদের মধ্য থেকে কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব স্পর্শ করবে”। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৭৩)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:
“এতে আসমানসমূহ ফেটে পড়ার, যমীন বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কারণ তারা পরম করুণাময়ের সন্তান আছে বলে দাবি করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা পরম করুণাময়ের জন্য শোভনীয় নয়”। (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৯০-৯২)
ঈসা (আ.) পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
“মাসীহ ইবনে মারইয়াম একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তার পূর্বে আরও বহু রাসূল গত হয়েছে, আর তার মা একজন পরম সত্যবাদিনী, তারা উভয়ে খাদ্য আহার করত। লক্ষ্য কর! আমি কিরূপে তাদের নিকট প্রমাণসমূহ বর্ণনা করছি। আবার লক্ষ্য কর! তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে” ? (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৭৫)
‘নববর্ষ’ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন বা তার প্রতুত্তর বৈধ নয়:
অনেক মুসলিম ভাই বোন জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন যে,
প্রশ্ন: কাউকে ‘শুভ নববর্ষ’ জানানো বা কেউ ‘শুভ নববর্ষ’ বললে প্রতুত্তরে ‘আপনাকেও’ বলা কি জায়েয হবে?
উত্তর: এ সম্পর্কে আরব বিশ্বের প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ সালেহ আল উছাইমীন (রহ.)-এর ফাতাওয়াটি উল্লেখযোগ্য। শায়খ সালেহ আল উছাইমীন (রহ.) কে জিজ্ঞেস করা হয়: খ্রিস্টমাস উপলক্ষে কাফেরদেরকে শুভেচ্ছা জানানোর বিধান কী? তারা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলে আমরা কিভাবে এর জবাব দিবো? এ উৎসব উপলক্ষে তারা যে অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে সেসব অনুষ্ঠানে যাওয়া কি জায়েয? কেউ যদি উল্লেখিত বিষয়গুলোর কোন একটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে নয়; বরং ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে কিংবা লজ্জাবোধ থেকে কিংবা জড়তা থেকে কিংবা এ ধরণের অন্য যে কোন কারণে করে ফেলে সে কি গুনাহগার হবে? এ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তাদের মত রূপ ধারণ করা জায়েয হবে কি?
উত্তরে তিনি বলেন: খ্রিস্টমাস (বড়দিন) কিংবা অন্যকোন বিধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে কাফেরদেরকে শুভেচ্ছা জানানো আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) তাঁর ‘আহকামু আহলিয যিম্মাহ’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন: “কোন কুফরী আচারানুষ্ঠান উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। যেমন- তাদের উৎসব ও উপবাস পালন উপলক্ষে বলা যে, ‘তোমাদের উৎসব শুভ হোক’ কিংবা ‘তোমার উৎসব উপভোগ্য হোক’ কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন কথা। যদি এ শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করা কুফরীর পর্যায়ে নাও পৌঁছে; তবে এটি হারামের অন্তর্ভুক্ত। এ শুভেচ্ছা ক্রুশকে সেজদা দেয়ার কারণে কাউকে অভিনন্দন জানানোর পর্যায়ভুক্ত। বরং আল্লাহর কাছে এটি আরও বেশি জঘন্য গুনাহ। এটি মদ্যপান, হত্যা ও যিনা ইত্যাদির মত অপরাধের জন্য কাউকে অভিনন্দন জানানোর চেয়ে মারাত্মক। যাদের কাছে ইসলামের যথাযথ মর্যাদা নেই তাদের অনেকে এ গুনাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে; অথচ তারা এ গুনাহের কদর্যতা উপলব্ধি করে না। যে ব্যক্তি কোন গুনার কাজ কিংবা বিদআত কিংবা কুফরী কর্মের প্রেক্ষিতে কাউকে অভিনন্দন জানায় সে নিজেকে আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির সম্মুখীন করে।” (উদ্ধৃতি সমাপ্ত)
কাফেরদের উৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো হারাম ও এত জঘন্য গুনাহ (যেমনটি ইবনুল কাইয়্যেম এর ভাষ্যে এসেছে) হওয়ার কারণ হলো-
এ শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যে কুফরী আচারানুষ্ঠানের প্রতি স্বীকৃতি ও অন্য ব্যক্তির পালনকৃত কুফরী কর্মের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ পায়। যদিও ব্যক্তি নিজে এ কুফরী করতে রাজী না হয়। কিন্তু, কোন মুসলিমের জন্য কুফরী আচারানুষ্ঠানের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা কিংবা এ উপলক্ষে অন্যকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হারাম। কেননা আল্লাহ তাআলা কুফরীর প্রতি সন্তুষ্ট নন।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যদি তোমরা কুফরী কর তবে (জেনে রাখ) আল্লাহ্ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরী পছন্দ করেন না। এবং যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও; তবে (জেনে রাখ) তিনি তোমাদের জন্য সেটাই পছন্দ করেন।” (সূরা যুমার, আয়াত: ৭)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৩)
অতএব, কুফরী উৎসব উপলক্ষে বিধর্মীদেরকে শুভেচ্ছা জানানো হারাম; চাই তারা সহকর্মী হোক কিংবা অন্য কোন লোক হোক।
আর বিধর্মীরা যদি আমাদেরকে তাদের উৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানায় আমরা এর উত্তর দিব না। কারণ সেটা আমাদের ঈদ-উৎসব নয়। আর যেহেতু এসব উৎসবের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট নন। আর যেহেতু আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত মানবজাতির কাছে ইসলাম ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন, যে ধর্মের মাধ্যমে পূর্বের সকল ধর্মকে রহিত করে দেয়া হয়েছে; হোক এসব উৎসব সংশ্লিষ্ট ধর্মে অনুমোদনহীন নব-সংযোজন কিংবা অনুমোদিত (সবই রহিত)।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৮৫)
কোন মুসলমানের এমন উৎসবের দাওয়াত কবুল করা হারাম। কেননা এটি তাদেরকে শুভেচ্ছা জানানোর চেয়ে জঘন্য। কারণ এতে করে দাওয়াতকৃত কুফরী অনুষ্ঠানে তাদের সাথে অংশ গ্রহণ করা হয়।
অনুরূপভাবে এ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে কাফেরদের মত অনুষ্ঠান করা, উপহার বিনিময় করা, মিষ্টান্ন বিতরণ করা, খাবার-দাবার আদান-প্রদান করা, ছুটি ভোগ করা ইত্যাদি মুসলমানদের জন্য হারাম। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদের-ই দলভুক্ত”।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর লিখিত ‘ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম’ গ্রন্থে বলেন: “তাদের কোন উৎসব উপলক্ষে তাদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করলে এ বাতিল কর্মের পক্ষে তারা মানসিক প্রশান্তি পায়। এর মাধ্যমে তারা নানাবিধ সুযোগ গ্রহণ করা ও দুর্বলদেরকে বেইজ্জত করার সম্ভাবনা তৈরী হয়।” (উদ্ধৃতি সমাপ্ত)
যে ব্যক্তি এমন কোন কাজে লিপ্ত হয়েছে সে গুনাহ করেছে; সেটা যে কারণেই করুক না কেন: ভদ্রতার খাতিরে, কিংবা সম্প্রীতি থেকে কিংবা লজ্জা থেকে কিংবা অন্য যে কারণেই করুক না কেন। কারণ এটি আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে আপোষকামিতা। এবং এটি বিধর্মীদের মনোবল শক্ত করা ও স্ব-ধর্ম নিয়ে তাদের গর্ববোধ তৈরী করার কারণের অন্তর্ভুক্ত।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলমানদেরকে ধর্মীয়ভাবে শক্তিশালী করেন, ধর্মের ওপর অবিচল রাখেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে তাদেরকে বিজয়ী করেন। নিশ্চয় তিনি শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। (মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিস শায়খ ইবনে উছাইমীন ৩/৪৪)
আল্লাহই ভাল জানেন।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
প্রিন্সিপাল: মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম ও ইসলামিক গাইডেন্স।
[email protected]