বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের ভূমিকা
ভূমিকা:
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন। মায়ের গর্ভ থেকে স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়। ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৈৗমত্ব রক্ষার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেয়া পৃথিবী ও তার মধ্যকার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’ নবী কারীম (সা.) হিজরতের পর মদীনার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গঠণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সময়ের ধারাবহিকতায় ১৯৭১ সালে মাতৃভূমি রক্ষার জন্যে পরাধীনতার হাত থেকে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আমাদের এ অমূল্য স্বাধীনতা অর্জনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মাতৃভূমি রক্ষায় যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁরা মহান। তাঁরা দেশ ও জাতির গৌরব। সকল সংগ্রাম ও আন্দোলনে আলেম সমাজের ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, যাঁদের শ্রম ও মেধা কাজে লাগিয়ে ইংরেজ বেনিয়াদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, যাঁরা শত্রুর হাত থেকে এদেশকে রক্ষা করেছিলেন; তাদের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরাই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল সশস্ত্র সংগ্রামে আলেম সমাজের ভূমিকা:
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায় ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হয়। ১৭৫৭ খ্রি. পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কার্যত ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। ইংরেজদের শোষণযুক্ত রাজস্ব-নীতি, চিরাচরিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপসহ নানান কার্যকলাপে স্বাধীনতাকামী মুসলিম সমাজ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রেƒাহ দেখা দেয়। আবার অনেক সময় দেশের স্থানীয় প্রভাবশালীরা অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে।
ওয়ারেন হেস্টিংসের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘১৭৬৩ খ্রি. ফকিরগণ বরিশালে ইংরেজ কোম্পানীর কুঠির উপর হামলা করে।’ রবার্ট ক্লাইভের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘১৭৬৩ খ্রি. ফকিরেরা ইংরেজদের ঢাকা কুঠি আক্রমণ করে এবং তারা কুঠি দখল করে। এতে ইংরেজগণ পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। একই বছর রাজশাহীতে কোম্পানির কারখানা আক্রমণ করে। তারা কারখানার অধিকর্তা মিঃ বেনেটকে ধরে নিয়ে যায় এবং পাটনায় নিয়ে পরে হত্যা করে। ফকির সন্ন্যাসীরা উত্তর বাংলা ছেয়ে ফেলে। ফকির সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপে আতঙ্কিত হয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস তাদের দমনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এর ফলশ্রুতিতে মজনু শাহের সঙ্গে ১৭৬৭ ও ১৭৬৯ খ্রি. কোম্পানির সৈন্যদের কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ইংরেজ সৈন্যধ্যক্ষ মার্টল ও ল্যাফটেনেন্ট কিথসহ বহু সৈন্য নিহত হয়। এই সাফল্যে ফকির সন্ন্যাসীদের সাহস আরও বেড়ে যায়। ওয়ারেন হেস্টিং ১৭৬৫ খ্রি. ফকির-সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য বিষেশ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁকে চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত করা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হয়নি। মজনু শাহের রণকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমন ও নিরাপদে পলায়ন। ফকির মজনূ শাহ’র সাহসে উৎসাহিত হয়ে মুসাশাহ, চেরাগ আলীশাহ, সোবহানশাহ এবং করিমশাহ প্রমুখ আরও অনেকেই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তুলতে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৭৮৭ খ্রি. রংপুরের কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহের কারণ ছিল কোম্পানি সরকারের রাজস্ব-নীতি। এভাবে ১৭৯১-১৭৯২ খ্রি. কৃষকরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষকগণ ইংরেজ শাসক ও জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ করে। বলাকী শাহ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বলে এই বিদ্রোহকে ‘বলাকী শাহের বিদ্রোহ’ বলা হয়ে থাকে।
অন্যদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী ফতওয়া প্রচার করে এই জাতিকে পথের দিশা দেন এবং তিনি তাদেরকে ইসলামের জেহাদী প্রেরণায় উদ্বুুদ্ধ হবার আহ্বান করেন। এই নির্ভীক মোজাহিদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ফতোয়ার মাধ্যমে ঘোষণা করলেন যে, “এখানে (ভারতে) অবাধে খৃষ্টান অফিসারদের শাসন চলছে, আর তাদের শাসন চলার অর্থই হলো, তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণ বিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স ওশর, ব্যবসায় গণ্য, চোর-ডাকাত-দমনবিধি, মোকদ্দমার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রভৃতিকে (যেমন –সিভিল, ফৌজ, পুলিশ বিভাগ, দীওয়ানী ও ফৌজদারী, কাস্টমস ডিউটি ইত্যাদিতে) নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনই অধিকার নেই। অবশ্য এটা ঠিক যে, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ, আজান, গরু জবাই –এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিষয়ে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে না। কিন্তু এগুলোতো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা; যে সব বিষয় উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং স্বাধীনতার মূল (যেমন মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমূহ বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা খতম করে দেয়া হয়েছে। এমন কি মুসলমান হোক কি হিন্দু-পাসপোর্ট ও পারমিট ব্যতীত কাউকে শহরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দানও দেশের স্বার্থে কিংবা জনগণের নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থেই দেওয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন সুজাউল-মুলক, বেলায়েতী বেগম প্রমুখ ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া বাইর থেকে প্রবেশ করতে পারছেন না। দিল্লি থেকে কলকাতা পর্যন্ত তাদেরই অমলদারী চলছে। অবশ্য হায়দ্রাবাদ, লক্ষেèৗ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের অনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার সরাসরি নাছারাদের আইন সেখানে চালু নেই। কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরই ‘দারুল হরবের-ই হুকুম বর্তায়”।
এভাবে শাহ আবদুল অজীজ দেহলভী অন্য একটি ফতওয়ার মাধ্যমে ভারতকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন। ফতওয়ার ভাষায় ‘দারুল হরব’ পরিভাষা ব্যবহারের মূল লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক ও স্বাধীন সংগ্রামের আলো প্রজ্জ্বলিত করা। যার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে,-“আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা খৃষ্টানদের হাতে, তারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে হরণ করেছে। কাজেই প্রতিটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হলো বিদেশী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে এখন থেকে নানানভাবে সংগ্রাম করা এবং লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখা”। এই ফতওয়া প্রদানের মধ্য দিয়ে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে একটি নতুন গতি দেখা দেয়। এই ফতোয়ায় শুধু মুসলমান নয়; বরং সারা ভারতবর্ষের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। এ আন্দোলনকে অনেকেই ‘ওহাবি আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেন।
ঠিক এমনিভাবে ১৮০৮ সাল থেকে সাইয়েদ আহমদ শহীদ প্রথমে মুসলমানদের ভেতরের কুসংস্কার দূর করার জন্য ব্যাপক সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন। তিনি ১৮২৬ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন। ধারাবাহিক সংগ্রামে সাইয়েদ আহমদ শহীদ সারা ভারতবর্ষে বিশেষকরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে জিহাদী কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। অবশেষে ১৮৬৫ সালের ৬ মে বালাকোট ময়দানে ইংরেজদের আক্রমণে তিনি শহীদ হন। এর মাধমে শেষ হয় দীর্ঘ জিহাদী আন্দোলনের এক অধ্যায়। সংগ্রামের বহমান ধারায় পরবর্তীতে সংঘটিত হয় সিপাহী বিপ্লব, তিতুমীরের আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন। এসবক’টি আন্দোলন সংগ্রাম ও বিপ্লবই ছিল বালাকোটের প্রেরণার ফসল।
সংগ্রাম ও আন্দোলনের উদ্যোক্তা, সিপাহসালার আর কর্ণধাররা ছিলেন জগদ্বিখ্যাত আলেম। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য আলেম-ওলামা। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে অনেককেই। ভারতবর্ষের এসব আলেমের জিহাদী আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা এ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আজ সেই স্বাধীনতার ধারক বাহক আলেমগণের কোনো নাম নেই। কোথাও নেই তাঁদের অবদানের উল্লেখ। বরং সুকৌশলে তাঁদের অবদান ও সংগ্রামী নানা অধ্যায়কে পাথরচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ তথা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর পরাজয়ের পর এদেশের আলেমগণ যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন। বাহুবলের পরিবর্তে কলমকে শক্তিশালী করার মানসে আলেম সমাজের পথপ্রদর্শক হযরত মাওলানা কাসিম নানৌতুভি (১৮৩৩-১৮৭৭) এবং অপরাপর আরো কয়েকজন আলেম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম দূর্গ ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময় ‘এই দারুল উলুম দেওবন্দ’ ই হয়ে ওঠে উপমহাদেশের মুসলমানদের বিপ্লবের সূতিকাগার। এই দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র ছিলেন মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (১৮৫১-১৯২০)। যাকে ‘শায়খুল হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘জমিয়তুল আনসার’ এরই মাধ্যমে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে একটি সমতা সৃষ্টি হয় এবং ইংরেজদের মোকাবেলায় মুসলমানগণ যৌথভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর চিন্তাধারায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাতের জন্য হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে রাষ্ট্রপতি, অধ্যাপক বরকত উল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী আর মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় এবং দেশের ভেতর ও বাইরের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এটিই ছিল ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল আন্দোলন। যা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ চল্লিশবছরের সাধনার একটি ফলপ্রসূ সম্ভাবনাময় দিক। এরপর ইংরেজরা তাঁকে বন্দী করে মাল্টায় পাঠিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন পর মাল্টার কারাবন্দী থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ‘খেলাফত আন্দোলন’ শুরু করেন। খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী ও মওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃতে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে, এর মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার হয়। অবশেষে ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই স্বাধীন হলো ‘পাক ভারত উপমহাদেশ!’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম : আলেম সমাজের ভূমিকা:
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ দীর্ঘ ৯ (নয়) মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের’। বিবেকবান কোনো মানুষ কখনও জালিমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা এটাই মনুষত্বের পরিচয় এবং ঈমানী দায়িত্ব। আর সে ঈমানী দায়িত্ব পালনার্থেই আলেম সমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানি জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করতে স্বচেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজপথে যুদ্ধ করেছেন। কাজ করেছেন দেশপ্রেমিক হয়ে। অসংখ্য উলামায়ে কেরাম তাদের জান-মাল ও সর্বশক্তি দিয়ে এ দেশের মজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার অনেকেই পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে অবদান রেখেছিলেন। নিচে স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের মধ্যে অন্যতম কয়েকজনের অবদান উল্লেখ করা গেল।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্য ইতিহাস দৃশ্যপটে আনলে আমরা এমন এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যাকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মুল স্বপ্নদ্রষ্টা বলা যেতে পারে। তিনি হলেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাষানীর শিক্ষক সিরাজগঞ্জ মাদরাসার প্রধান মাওলানা আব্দুল বাকী উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। ওখানে দুই বছর অবস্থানকালে তিনি মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সাহচর্যে শাহ ওয়ালীউল্লাহর রাজনৈতিক চিন্থাধারার সাথে পরিচিত হন।
১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাষানী তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিলে দেশে ‘ফরাসী বিপ্লব’ করার হুমকি দান।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ:
এপর্যায়ে আমরা স্মরণ করতে পারি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এর কথা। যিনি মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯২৩ সালে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হয়ে এক বছর অধ্যয়ন করেন। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়া একজন আলেম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিজ্ঞ সংগঠক ও যোদ্ধা।
মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী:
আলেম সমাজ যে শুধু যুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছেন তা নয়, বরং ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে চলে যাওয়ার সময় যখন নেতারা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রাপ্তির সাফল্যে সন্তুষ্ট, তখন একজন আলেম পূর্ব-পশ্চিমের এ সংযুক্ত বিভাগকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এ ভুখ-ের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন। তিনি হলেন মাওলানা মুহাম্মদ শামছুল হুদা পাঁচবাগী। যিনি পাকিস্তান প্রস্তাব (১৯৪৩)-বিরোধী এবং স্বাধীন বাংলার প্রবক্তা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মৌলভী আবুল হাশেম, বেঙ্গল কংগ্রেস পার্লমেন্টারি পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় প্রমুখ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলেন। কিন্তু সেই দাবি কংগ্রেসের সমর্থন লাভ করেনি এবং গোটা বাংলা-আসামকে পাকিস্তানভুক্ত করার যে দাবি মুসলিম লীগের ছিল, তাও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট মেনে নেয়নি। হাশেম-সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলার দাবির বেশ আগেই মাওলানা পাঁচবাগী তাঁর প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা কায়েমের দাবি পেশ করেছিলেন। এ নিরিখে তাঁকে বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার সর্বপ্রথম দাবিদার বা স্বপ্নদ্রষ্টা বলা চলে।
১৯৭০-৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় মাওলানা পাঁচবাগী মুক্তিকামী জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেন। পাকবাহিনীর হাত থেকে অনেকের জীবন রক্ষা করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি তাঁর বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। গফরগাঁও এবং কিশোরগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে এখনও যা কিংবদন্ডি হয়ে আছে।
শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান:
‘অমর বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান যিনি ছিলেন ধর্মমন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম ষাটের দশকে ‘স্বতন্ত্র ধর্মদপ্তর’ একটি জাতীয় প্রয়োজন’বই লিখে বহুকাঙ্খিত স্বপ্নের জানান দেন। বহু আলেম-ওলামা যখন পাকিস্তান ও ইসলামকে একীভূত করে দেখেছিলেন আর পূর্বপাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে এদেশ থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলে ভাবতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক সে মুহূর্তে অসংখ্য আলেম-ওলামার মধ্য থেকে বের হয়ে এসে বীরবিক্রমে তিনি স্বাধীনতার ও স্বাধিকারের স্বপক্ষে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনিই একমাত্র আলেম, যিনি ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বই লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
হিংস্র হানাদারদের হাতে বন্দি হবার ক’দিন আগে শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান ছন্দ এঁেকছিলেন এভাবে- আমায় তোরা দিস গো ফেলে হেলা ভরে পথের ধারে হয়তো পথিক করবে দোয়া দেখবে যখন কবরটাকে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বুদ্ধিজীবী তালিকায় মাওলানা অলিউর রহমানের নাম থাকলেও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বুদ্ধিজীবী নামের তালিকায় তাঁর নাম নেই।
মুফতী আমীমুল ইহসান:
১৯৭১ সালে মুফতী আমীমুল ইহসান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফতওয়া দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াহিয়া সরকার তাঁকে জোর করে সৌদিআরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব হিসেবে নিযুক্ত করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর:
১৯৭১ সালে মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এদেশের মজলুমদের এগিয়ে আসতে জাতির উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফুরের যুদ্ধ নয়, এটা জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ- পাকিস্তানিরা জালেম’। এ দেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন কোনো মানুষ জালেমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তার পক্ষে কথা বলা এটাই বিবেকের দাবি।
মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী:
১৯৭১ সালে মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী যিনি সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি বলেন- ‘আমি তখন হাফেজ্জী হুজুর এবং শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হকের ছাত্র, লালবাগে পড়ি, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বড় ছাত্ররা হাফেজ্জী হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ভুমিকা কী হতে পারে এই যুদ্ধে? হুজুর বললেন- অবশ্যই জালেমদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারবো? হুজুর বললেন –‘অবশ্যই যেতে পার’। অত:পর আমি গেরিলা প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে যাই এবং যুদ্ধে অংশ নেই।
এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন আলেম সমাজের একটি বড় অংশ। প্রমান করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলন বাংলাদেশীদের একান্ত প্রয়োজন।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী ও মাওলানা আব্দুল্লাহ জালালাবাদী:
মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী বলেন, সারাদেশে টালমাহাল অবস্থা ৬ দফাকে কেন্দ্র করে। ফুঁসে উঠেছে চারদিক ৬ দফার সমর্থনে। তখন এদেশে কতিপয় ধর্মীয় দল, আলেম-ওলামা ৬ দফার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। প্রচারণা শুরু করে এই বলে যে, ৬দফা কর্মসূচী ইসলাম পরিপন্থী, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিরোধী ইত্যাদি। এমনি সময় বঙ্গবন্ধু এলেন সিলেটে। দেখা হলো, পরিচয় হলো। তিনি ঢাকায় গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন। ঢাকায় এসে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে আমি দেখা করি। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ৬ দফায় ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু আছে কী-না? প্রতি উত্তরে আমি বললাম, আপনি ৬দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির দাবি জানিয়েছেন, এটা ইসলামের পরিপন্থী তো নয়ই বরং সহায়ক। সেই থেকে শুরু, এগিয়ে নিলেন নিজেকে। গড়ে তুললেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আলেমদের জনমত। নিজেকে জড়িয়ে দিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান আন্দোলনে। কখনো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনী উসমানীকে যুদ্ধকালীন সঙ্গ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখেছেন মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। তাঁরই অগ্রজ মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী সময়, মেধা, ও শ্রম দিয়ে সাহায্য করেছেন ছোট ভাই উবায়দুল্লাহকে, জীবন বাজী রেখে পক্ষ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের। অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের উপলক্ষ্য হয়েছেন স্বাধীনতাপ্রেমী এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানের।
মাওলানা আব্দুুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী:
মাওলানা আব্দুুল্লাহ বিন স্ঈাদ জালালাবাদী বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, পাকিস্তান আসলে কোন ইসলামী রাষ্ট্র নয়। আমি নিজ থেকে স্বভাবসুলভ ভাবে অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম পাকিস্তান আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। না এতে ইসলামের উপকার হবে, না আমরা রক্ষা পাব। মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি, যিনি প্রথম ঢাকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়ান, তিনি এবং মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানিসহ প্রখ্যাত আলেমদের সঙ্গে জিন্নাহ’র ওয়াদা ছিল পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হবে। তারা আমাদের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমরা কেন সেই রাষ্ট্র রক্ষা করব। এসব জিজ্ঞাসার প্রতি-জিজ্ঞাসা মাঝে আমার ছোট ভাই উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আমারই শিক্ষক মাওলানা অলিউর রহমানকে প্রধান করে ‘আওয়ামী ওলামা পার্টি’ গঠন করে। আমি ওস্তাদের সঙ্গে দেখা করে আশ্বাস ও সাহস যুগিয়ে যাই এই বলে, আপনি এগিয়ে যান, আমি আপনাকে সাহায্য করে যাব পেছন থেকে” মুক্তিযুদ্ধ সময়ের দিনগুলোর কথা বললেন আব্দুুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।
আলেমদের ত্যাগ-তিতীক্ষা স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এমনই অজানা আরও অনেক আলেম ওলামা রয়েছেন যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে আনেক আলেম সম্মুখ সমরে অগ্রগামী হয়ে আহত হয়েছেন, আনেক শাহাদত বরণ করেছেন এমন আলেমের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখিত বর্ণনা থেকে দুই-একটি উদাহরণ পেশ করছি- তিনি লিখেছেন, “একইভাবে তারা রাজবাড়ী জেলখানার মাওলানার কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধারা বিহারিদের রাজবাড়ী জেলখানায় আটক করার পর মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলী তাদের পাকিস্তানপ্রীতি ত্যাগ করে জয় বাংলার প্রতি সমর্থন জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী দখলের পর বিহারীরা ছাড়া পেয়ে মাওলানা ইয়াকুব আলী আলীকে হত্যা করে। এপ্রিলের শেষ দিকে ইয়াকুব আলী কাজী কান্দাস্থ নিজবাড়ী থেকে শহরাভিমুখে আসার পথে অবাঙালীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে বিহারীরা গলা কেটে হত্যা করে। তারপর তাঁর পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে নিয়ে বলে “আভি শালা জয় বাংলা বলো।”
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলব অথচ ওলামায়ে কেরামের কথা বলব না, তা হয় না। অবশ্যই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের অবদানের বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হতে হবে। তা না হলে ইতিহাসটি এক মহান দায় চিরদিন আমাদের কাঁদে থেকে যাবে। এখন ও বহু মুক্তিযুদ্ধা বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখা সে সময়ে পূর্ণবয়স্ক ও বুদ্ধি সম্পন্ন বহু নাগরিক, কোরো ধরণের ব্যাখ্যা ছাড়া তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করেন। তাঁদেরকে স্মরণ করা সকলের দায়িত্ব বলে মনে করি।
দেশের বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া ও স্বাধীনতার সংশ্লিষ্টতা:
চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত ‘জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসা’ যা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত হয় পটিয়া মাদ্রাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন, তখনই পটিয়া মাদ্রাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষণে পটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও কারী মাওলানা জেবুল হাসানসহ অনেকেই শহীদ হন। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নিয়ে পটিয়া মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষককে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। বোমা মেরে গুড়িয়ে দেয় মাদ্রাসার একাধিক ভবন।
যুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার:
আগা শাহীর সাক্ষাৎকারটি মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এবিসির মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। এই সাক্ষাতকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আগা শাহী যখন পূর্বপাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা,লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন, তখন তার প্রতি বব ক্লার্কের প্রশ্ন ছিল,জনাব রাষ্ট্রদূত, গণহত্যার অভিযোগ কিন্তু নানা সূত্র থেকে এসে পৌঁছেছে। এসব সূত্র হচ্ছে বিদেশী কূটনীতিবিদ, ধর্মপ্রচারক ও সাংবাদিক। এরা কিন্তু আপনাদের সশস্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণের আগে থেকেই ঘটনাস্থলে ছিল। পাকিস্তান থেকে সীমান্তের ওপারে যেসব শরণার্থী চলে গেছে, তাদের বক্তব্যের সঙ্গে এদের গণহত্যার বিবৃতির মিল থাকাটা কি অর্থবহ নয়?
আলেম সমাজ যে শুধু যুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছেন তা নয়, বরং ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে চলে যাওয়ার সময় যখন নেতারা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রাপ্তির সাফল্যে সন্তুষ্ট তখন একজন আলেম পূর্ব-পশ্চিমের এ সংযুক্ত বিভাগকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এ ভুখন্ডের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন। তিনিও ছিলেন একজন মাওলানা।
একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘জমিয়তে উলামা হিন্দ’-এর ভূমিকা:
ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা কেন্দ্রিয় আলেমদের সংগঠন ‘জমিয়তে উলামা হিন্দ’-এর নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক ফতোয়া, বিবৃতি দিয়েছিলেন। ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সিপাহসালার শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানীর সুযোগ্য সন্তান ভারতীয় কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট মেম্বার এবং ‘জমিয়তে উলামা হিন্দ’-এর সংগ্রামী সভাপতি মাওলানা সাইয়েদ আসআদ মাদানী, পশ্চিমবঙ্গ ‘জমিয়তে উলামা হিন্দ’-এর সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ তাহের প্রমুখ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বার বার ছুটে গিয়েছেন, নগদ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশ-বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে তাঁরা জোড়ালো ভূমিকা রেখেছেন।
পাকিস্তানিদের স্বাক্ষ্য:
পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা তারেক ওয়াহিদ বাট তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালী মুসলমানদের পক্ষে ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিন্নুরী মাদ্রাসার ছাত্র। একদিন মুফতী মাহমুদ সাহেব মাদ্রাসায় এলে তাঁকে একনেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাদ্দারকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁকে কি এখনো হত্যা করা হয়নি?’ এ কথা শুনে মুফতী মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘কাকে গাদ্দার বলছো? মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন সুন্নী মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
মুফতি মাহমুদ ১৩ মার্চ তাঁর এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহইয়া-ভুট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহক্ষান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য।
বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এদেশের আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এমনকি এ দেশের স্বাধীনচেতা মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করণে অনেক কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী শায়খে ফুলবাড়ি (রহ.) সিলেট, মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), মাওলানা হাবিব উল্লাহ (রহ.) সিলেট, মাওলানা লুৎফুর রহমান (রহ.) শায়খে বর্ণভী, সিলেট, শায়খুল হাদীস মাওলানা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ (রহ.), শায়খুল হাদীস মরহুম তজম্মুল আলী (রহ.) সিলেট, মাওলানা আবুল হাসান (রহ.) যশোহর, মাওলানা আরিফ রাব্বানী (রহ.) ময়মনসিংহ, মুফতী মোঃ নুরুল্লাহ (রহ.) ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) ঢাকা, মাওলানা মোস্তফা আজাদ, ঢাকা প্রমুখ আলেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে বংলাদেশের আলেম সমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ একমাত্র মাতৃভূমির টানে, দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এবং নির্যাতিত নিষ্পেশিত মা-বোনদের ইজ্জত সম্মান রক্ষার্থে পাকিস্তানী হানাদারদের লালসার হাত থেকে রক্ষার জন্যেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এ যুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরই অংশগ্রহণ ছিল তা ঠিক নয় বরং স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশের আলেম সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সংশ্লিষ্টতা অনস্মীকার্য। আমরা বলতে পারি সকল স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের আলেম সমাজের ভূমিকা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ছিল।
তথ্যপুঞ্জী:
সহীহ আত-তিরমিযী, ইমাম আবু মুহাম্মদ বিন ঈসা সারওয়াহ। সুনান আবু দাউদ, ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান ইবনুল আশ’আস-সিজিস্তানী, ২য় খ-। বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা, কে. কে. রাইছউদ্দিন খান, খান ব্রাদার্স এ- কো, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০০৯খ্রি.। আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের ভুমিকা, জুলফিকার আহমদ কিসমতি, অজানা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৭খ্রি.। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত ইতিহাস, দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ইফাবা, ঢাকা, ১৯৯৭খ্রি. । ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদুদ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০১১ খ্রি.। বালাকোটের মর্মান্তিক শিক্ষা: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ড. মুহিব্বুল্ল্যাহ সিদ্দীকী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ঢাকা, ২০০৭ খ্রি.। রাজনীতিতে বঙ্গীয় উলামার ভূমিকা, ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ইফাবা, ঢাকা, ২০০৯ খ্রি.। স্বাাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজ, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ঢাকা। মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আন্ওয়ার উল্লাহ, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০৮খ্রি.। মুক্তিযুদ্ধের অনন্য শহীদ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বাপ্নিক মাওলানা অলিউর রহমার: জীবন ও সাহিত্য, আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মহানবীর স্মরণীকা পরিষদ, ঢাকা, ১৯৯৮খ্রি.। মুফতী আমিমুল এহসান : জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ইফাবা, ঢাকা, ১৯৮৪ খ্রি.। দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি, সৈয়দ মবনু, নগর পাবলিকেশন, সিলেট, ২০০৯। সাংবাদিকের কলাম থেকে, এহসান বিন মুজাহির, দৈনিক জনতা, ঢাকা । একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস, আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলী, আল এসহাক প্রকাশনী, ২০১১ খ্রি.। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসের, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা। আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল, সাগর পালিশার্স, ঢাকা, ২০০৭ খ্রি.। সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট, আশফাক হাশেমী, কাইদে জমিয়ত মুফতী মাহমুদ, সংখ্যা-২, ঢাকা।
লেখক: অধ্যক্ষ, সৈয়দপুর সৈয়দীয়া শামছিয়া আলিম মাদরাসা, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।