রমাদনকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতে ভাগ করা কি ঠিক?
প্রশ্ন: রমাদন মাসকে তিন ভাগে করা হয়, যেমন, প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত ও শেষ দশক নাজাত। বিষয়টি কি কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত?
উত্তর: এ বিষয়ে বহুল প্রচলিত ও প্রশিদ্ধ একটি হাদীস রয়েছে, যা ইমাম বায়হাকি রহ. তার শু’আবুল ঈমানে ও ইমাম ইবনে খুযাইমা রহ. তার সহীহ ইবনে খুযাইমাতে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হলো:
সালমান রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি ইবনে খুযাইমা তাঁর ‘সহীহ’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রমাদন মাসের ফযিলত শীর্ষক পরিচ্ছেদ; যদি এ হাদীসটি সহীহ সাব্যস্ত হয়। এরপর তিনি বলেন, আমাদের নিকট আলী ইবনে হুজর আল-সাদী হাদীস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমাদের নিকট ইউসুফ ইবনে যিয়াদ হাদীস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমাদের নিকট হুমাম ইবনে ইয়াহইয়া হাদীস বর্ণনা করেছেন আলী বিন যায়িদ বিন জুদআন হতে; তিনি সাঈদ ইবনে আল-মুসাইয়্যিব হতে, তিনি সালমান রা. হতে; তিনি বলেন,
خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ فِي آخِرِ يَوْمٍ مِنْ شَعْبَانَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ أَظَلَّكُمْ شَهْرٌ عَظِيمٌ مُبَارَكٌ شَهْرٌ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مَنْ أَلْفِ شهر جعل الله تَعَالَى صِيَامَهُ فَرِيضَةً وَقِيَامَ لَيْلِهِ تَطَوُّعًا مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بخصلة من الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ وَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ وَالصَّبْر ثَوَابه الْجنَّة وَشهر الْمُوَاسَاة وَشهر يزْدَاد فِيهِ رِزْقُ الْمُؤْمِنِ مَنْ فَطَّرَ فِيهِ صَائِمًا كَانَ لَهُ مَغْفِرَةً لِذُنُوبِهِ وَعِتْقَ رَقَبَتِهِ مِنَ النَّارِ وَكَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَجْرِهِ شَيْءٌ» قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَيْسَ كلنا يجد مَا نُفَطِّرُ بِهِ الصَّائِمَ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : «يُعْطِي اللَّهُ هَذَا الثَّوَابَ مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا عَلَى مَذْقَةِ لَبَنٍ أَوْ تَمْرَةٍ أَوْ شَرْبَةٍ مِنْ مَاءٍ وَمَنْ أَشْبَعَ صَائِمًا سَقَاهُ اللَّهُ مِنْ حَوْضِي شَرْبَةً لَا يَظْمَأُ حَتَّى يَدْخُلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ شَهْرٌ أَوَّلُهُ رَحْمَةٌ وَأَوْسَطُهُ مَغْفِرَةٌ وَآخِرُهُ عِتْقٌ مِنَ النَّارِ وَمَنْ خَفَّفَ عَنْ مَمْلُوكِهِ فِيهِ غَفَرَ الله لَهُ وَأعْتقهُ من النَّار.
একবার শাবান মাসের শেষ দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা (ভাষণ) দিলেন। খুতবা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, হে লোকেরা! তোমাদের নিকট এক মহান মাস হাজির হয়েছে। এক বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে এমন এক রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ মাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ ফরয করেছেন এবং এ মাসের রাতে কিয়াম (নামায আদায়) করা নফল করেছেন। এ মাসে যেকোন একটি (নফল) ভালো কাজ করা অন্য মাসে একটি ফরয কাজ করার সমান। আর এ মাসে কোনো একটি ফরয আমল করা অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আমল করার সমান। এটি হল ধৈর্য্যের মাস; ধৈর্য্যের প্রতিদান হচ্ছে- জান্নাত। এটি হলো- সহানুভূতির মাস। এটি এমন এক মাস যাতে একজন মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি পায়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার সমূহ গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাকে সেই রোজাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে; কিন্তু রোজাদারের সওয়াবে কোন কমতি করা হবে না। তারা বললো, আমাদের মধ্যে সবার তো একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মত সামর্থ্য নেই। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, কোন ব্যক্তি যদি একজন রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি অথবা এক চুমুক দুধ দিয়েও ইফতার করায় আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দিবেন। এটি এমন মাস, এর প্রথম ভাগে রহমত, দ্বিতীয় ভাগে মাগফিরাত এবং শেষ ভাগে রয়েছে জাহান্নাম হতে নাজাত। আর যে ব্যক্তি তার কৃতদাসের দায়িত্ব সহজ করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দিবেন। সুতরাং এ মাসে তোমরা চারটি কাজ বেশি করে করবে। দুটি হলো, যা দিয়ে তোমরা নিজেদের রবকে সন্তুষ্ট করবে। আর দুটি কাজ এমন যা তোমাদের না করলেই নয়। যে দুটি কাজ দ্বারা তোমরা নিজেদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবে, (১) এ বলে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই, এবং (২) তাঁর কাছে ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আর যে দুটো কাজ তোমাদের না করলেই নয়, (৩) তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবে এবং, (৪) জাহান্নামের আগুন থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আর এই মাসে যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহ তাঁকে আমার হাউজ থেকে এক ঢোক পানি পান করাবেন যার ফলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, ৩/১৯১, হাদীস , ১৮৮৭, শুয়াবুল ঈমান, ৫/২২৩, হাদীস, ৩৩৩৬)
হাদীসের মান:
উপরোক্ত হাদীসটি সনদের দিক থেকে জইফ বা দুর্বল কেউ কেউ হাদীসটিকে মুনকার বা পরিত্যাজ্য বলেছেন। কারণ এর সনদে একজন রাবী হচ্ছেন আলী বিন যায়েদ বিন জুদআন। তিনি একজন জঈফ বা দুর্বল রাবী। যেহেতু তার মুখস্থশক্তি দুর্বল ছিল। হাদীসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন ইউসুফ বিন যিয়াদ আল-বসরী। তিনি মুনকারুল হাদীস। হাদীসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন হুমাম বিন ইয়াহইয়া বিন দীনার আল-আউদী। তার সম্পর্কে ইবনে হাজার ‘আত-তাক্বরীব’ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি ছিকাহ তথা শক্তিশালী তবে কখনো কখনো ভুল করেন।
দেখুন: “কিতাবুদ দুয়াফা” লিল উকাইলি: ২/১৬২, “আল-কামেল ফি দুয়াফায়ির রিজাল” লি ইবনু আদি: ১/১৬৫, “কিতাবু ইলালিল হাদীস ” লি ইবনু আবি হাতেম: ১/২৪৯, “সিলসিলাতিল আহাদিসুস দায়িফা ওয়াল মাওদুয়াহ” লিল আলবানি: (২/২৬২, ও (৪/৭০)
“মুনকার” হাদীস: হাদীস বিশারদদের একটি পরিভাষা হচ্ছে “মুনকার”, এর অর্থ সম্পর্কে ইমাম আহমদ রহ. বলেন:
(الحديث عن الضعفاء قد يُحْتاج إليه في وقتٍ، والمنكر أبدًا منكر)
“দুর্বল বর্ণনকারীদের হাদীস কখনো প্রয়োজন হয়, কিন্তু মুনকার সর্বদা মুনকার”। দেখুন: “ইলালুল মারওয়াযী”: হাদীস, ২৮৭), “মাসায়েল ইবনু হানি”: ১৯২৫-১৯২৬, ইবনু রজব “শারহুল ইলাল”: ১/৩৮৫ গ্রন্থে ইবনু হানি থেকে তা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদের কথার অর্থ হচ্ছে: মুনকার সর্বদা পরিত্যক্ত, এর বিপরীতে দুর্বল হাদিসের প্রয়োজন হলেও মুনকার কখনো গ্রহণ করা যাবে না।
অর্থগত দিক থেকেও হাদীস টি রমাদন সম্পর্কিত অন্যান্য সকল সহীহ হাদিসের বিপরীত। আমরা যদি রমাদনের ফযিলত সংক্রান্ত হাদীস গুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেই তাহলে দেখবো যে, রমাদনের ফযিলত কোনো দশককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি। কোনো দশকের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং রমাদন সম্পর্কিত হাদীস গুলো সামগ্রিক ভাবে এটিই প্রমাণ করে যে, শুধু প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত ও তৃতীয় দশক-ই নাজাত নয়, বরং রমাদনের প্রতিটি দিন-ই রহমতের, প্রতিটি দি-ই মাগফিরাতের, প্রতিটি দি-ই নাজাতের। তাছাড়া হাদিসের মূল বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করলেও দেখবো যে, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত এই তিনটি আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ও সম্পর্কিত। আমরা যদি রমাদনকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেলি তখন প্রশ্ন হবে, তাহলে কি রহমতের দশকে আল্লাহ্ কাউকে মাগফিরাত ও নাজাত দিবেন না? মাগফিরাতের দশকে কি তিনি বান্দাকে রহমত ও নাজাত দিবেন না? বা শেষ দশক-ই যদি কেবলমাত্র নাজাতের জন্য নির্দিষ্ট হয়, তাহলে কি আল্লাহ আমাদের প্রথম দুই দশকে রহমত ও মাগফিরাত দিবেন না? আরো প্রশ্ন হবে, আল্লাহ্র রহমত ও মাগফিরাত ছাড়া বান্দা কী করে নাজাত পেতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা খুঁজে দেখি তো দেখবো যে, মুলত আল্লাহ্ যাকে রহমত করবেন তাকে তিনি মাগফিরাত বা ক্ষমাও করেন, আর যাকে তিনি রহমত ও মাগফিরাত দেন তাকে নাজাতও দেন।
রমাদনের ফযিলত সংক্রান্ত কিছু সহীহ হাদীস:
১. আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,
من صام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه،
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযান মাসের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮, ২০১৪; সহীহ মুসলিম ৭৬০ (১৬৫); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস, ৮৯৬৮)
২.আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,
ان الله عز وجل فرض صيام رمضان وسننت قيامه، فمن صامه وقامه ايمانا واحتسابا خرج من الذنوب كيوم ولدته أمه
আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন, আর আমি কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ তারাবীহ’র নামাযকে সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে, সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস, ১৬৬০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস, ৭৭৮৭, মুসনাদে বাযযার, হাদীস, ১০৪৮, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস, ২২০১, সুনানে নাসাঈ, হাদীস, ২৫১৮
৩. ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র রহ. … আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ بُكَيْرٍ، قَالَ حَدَّثَنِي اللَّيْثُ، عَنْ عُقَيْلٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، قَالَ أَخْبَرَنِي ابْنُ أَبِي أَنَسٍ، مَوْلَى التَّيْمِيِّينَ أَنَّ أَبَاهُ، حَدَّثَهُ أَنَّهُ، سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ، وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ ”.
রমাদন আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শৃংখলিত করে দেয়া হয় শয়তানকে। (সহীহ বুখারি, ইফাবা নাম্বার, ১৭৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বার, ১৮৯৯)
৪. মুসলিম ইবনু ইবরাহীম রহ. … আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا هِشَامٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ”.
যে ব্যাক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে। আর যে ব্যাক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তাঁরও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে। (সহীহ বুখারি, ইফাবা নাম্বার, ১৭৮০, আন্তর্জাতিক নাম্বার, ১৯০১)
৫. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,
إن للصائم عند فطره لدعوة ما ترد. قال البوصيرى: اسناده صحيح.
ইফতারের সময় রোযাদার যখন দুআ করে, তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দুআ কবুল হয়)। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস, ১৭৫৩)
৬. আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,
ثلاثة لا ترد دعوتهم الامام العادل، والصائم حتى يفطر، ودعوة المظلوم، تحمل على الغمام، وتفتح لها ابواب السماوات، ويقول الرب عز وجل : وعزتى لانصرنك ولو بعد حين. وقال الترمذى : هذا حديث حسن.
তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না (অর্থাৎ তাদের দুআ কবুল করা হয়) ন্যায়পরায়ন শাসকের দুআ; রোযাদার ব্যক্তির দুআ ইফতারের সময় পর্যন্ত ও মজলুমের দুআ। তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এর জন্য সব আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, আমার ইয্যতের কসম! বিলম্বে হলেও অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করব। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস, ৮০৪৩; সুনানে তিরমিযী, হাদীস, ৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস, ১৭৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস, ৩৪২৮)
দ্বিতীয়ত সহীহ হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তার বান্দাদের রমাদন মাসের প্রতি রাতেই জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। তাই রমাদন মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা মহান আল্লাহর প্রতি আমাদের একটি সংকীর্ণ ধারণা, যা কোনো ভাবেই আল্লাহ্র শানে যায় না। আল্লাহ বান্দাদের রমাদন মাসের শুরু থেকেই বান্দাদের ক্ষমা করতে থাকেন। সুতরাং পুরো রমাদন মাস-ই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের।
হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلم يفتح مِنْهَا بَاب الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَيُنَادِي مُنَادٍ يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أقصر ن وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ.
যখন রমাযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে, শয়তান ও অবাধ্য জিন সকলকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহবানকারী আহবান করতে থাকে, হে কল্যাণের অমেবষণকারী অগ্রসর হও, হে মন্দের অমেবষণকারী থাম। আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন, আর এটা প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হাদিস,১৯৬০)।
উপরোক্ত আলোচনার পর প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের আলেম-ওলামাগণ তাহলে কেন এই জইফ বা দুর্বল হাদিসের উপর ভিত্তি করে রমাদনকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন? আমি যদি একটু সংক্ষেপে বলি তো বলবো যে, আমাদের দেশের সম্মানিত আলেম-ওলামাগণ নতুন করে কোনো ভুল করেন নি। আল্লাহ্ তাদের যততুকু তাওফিক দিয়েছেন তারা সে হিসেবে সাধ্যমত দীনের খেদমত করে গেছেন, যাচ্ছেন। সমস্যাটা হলো, ঐতিহাসিক, ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাতারিদের বাগদাদ আক্রমণ ও সকল ইসলামী কিতাবাদি ও তুরাস ধ্বংস করে ফেলার ঘৃণ্য ইতিহাস, অন্য দিকে আছে ভারত বর্ষের মুসলিমদের উপর ব্রিটিশ বেনিয়াদের দুশ বছরের দুঃশাসন থেকে শুরু করে বার বার মুসলিম ও ইসলামী সংস্কৃতির ওপর হিন্দু জমিদারদের শোষণ নিপীড়ন ও নির্যাতন। অপরদিকে এপার ও ওপার বাংলার নবাব আলী বরদি খান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা ও নবাব মুর্শিদ কুলি খানরা ছিলেন শিয়া। তাদের শাসনামলে সুন্নি মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সুন্নি মুসলিমদের কোনো অংশিদারিত্ব বা সম্পৃক্ততা ছিলো না। এভাবে শত শত বছর ধরে ভারত বর্ষে চলে আসা শিয়া-হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের ফলে সহীহ হাদীস বা ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষা বঞ্চিত মুসলিমদের গ্রাস করে জাল, জঈফ, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অসত্য কিচ্ছা-কাহিনী ও সুফিজমের নামে ভ্রান্ত বিশ্বাস নির্ভর ধর্মীয় ও সামাজিক নানা ব্যাধি। ভয়ঙ্কর সেই শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে বের হয়ে আসাটা তখনকার মুসলিমদের জন্য খুব সহজ ছিলো না। সহজ নয় আজও।
তাই আমরা যুগের পর যুগ আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহন করে চলেছি ইতিহাসের সেই গ্লানি ভরা বিষভাস্প। যার ফলে ভারত বর্ষে কখনো ইসলামের তেমন কোনো জ্ঞান-গবেষণা নির্ভর নির্ভেজাল উচ্চতর গবেষণামূলক কোনো ইসলামী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। সঙ্গত কারণেই আমাদের ভারত বর্ষের সম্মানিত আলেম-ওলামাদের কিছু ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে হাদীস বা ইলমী তাহকীকের ক্ষেত্রে এটি একটি দৃশ্যমান প্রকট সংকট। আলহামদুলিল্লাহ্ আশার কথা হলো, এখন আমাদের দেশেও হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান গবেষণায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান হয়েছে, হচ্ছে। তবে এ কথা আমাদের মানতেই হবে যে, এদেশে এখনো যে, আযান হয়, আল্লাহু আকবারের নামে সূর্য ওঠে, মসজিদে নামায হয়, দাঁড়ি টুপি নিয়ে মুসলিম পরিচয়ে মানুষ রাস্তায় চলে, এগুলো তাদেরই অবদান। এই যে আমরা ইসলাম পেয়েছি, আলেম হচ্ছি, দেশ-বিদেশে কুরআন হাদীস নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করছি, এসবকিছুই রয়েছে তাদের অসামান্য খেদমত ও অবদান। আমাদের ভেবে দেখা দরকার, এসব আলেম-ওলামারা যদি না থাকতেন আমাদের আজ কী হতো? কোথায় থাকতাম আমরা? কী পরিচয় হতো আমাদের?
আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সম্মানিত আলেম-ওলামাদের খেদমতগুলোকে কবুল করুন। তাদের মাফ করে দিন। দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন। আমীন।
এই আলোচনা, পর্যালোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, উপরোক্ত সনদে হাদীসটি জঈফ ও মুনকার বা পরিত্যাজ্য। তবে এর বিপরীতে রমাদনের ফযিলত বিষয়ক অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। তাই সামগ্রিক হাদিসের বিবেচনায় রমাদনকে ৩ ভাগে ভাগ করা উচিৎ নয়। বরং পুরো রমাদন-ই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস।
লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ও
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম
ইফতা ও দাওরায়ে হাদীস-টাইটেল: ঢাকা
প্রিন্সিপাল, মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম।