ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস

আধুনিক আরবিতে সন্ত্রাসবাদকে বলা হয় ইরহাব إرهاب/إرهابية)) কুরআন ও হাদীসে ইরহাব শব্দটি ব্যবহৃত হলেও তদ্দ্বারা সন্ত্রাস সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদ বুঝানো হয়নি। বরং সন্ত্রাসীদেরকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য তাদের মধ্যে ভীতিসঞ্চার করার অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যাতে তাদের এহেন অপকর্ম থেকে মানুষ মুক্তি পায়। কুরআনুল কারীমে সন্ত্রাসবাদকে বোঝাতে ফেতনা ও ফাসাদ এ দুটো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এবং এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি ভয়াবহ শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। ইসলাম জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী নয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, ভয়ভীতি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, অস্থিরতা ও অরাজকতা, হত্যা, ধর্ষণ, বোমাবাজি, খুন, গুম, ছিনতাই ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে হারাম ও অবৈধ। এসব কর্মকাণ্ড যারা করে তাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা পথভ্রষ্ট গোমরাহ ও বিপথগামী। কিন্তু দুঃখজনক হল, বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ‘‘ইসলাম’’ কে সন্ত্রাসের জনক বলে চিত্রিত করা হচ্ছে। অথচ ইতিহাস ও বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সন্ত্রাস বলতে যা বুঝানো হয় তার শুরু হলো ইহূদী উগ্রবাদীদের দ্বারা।

প্রাচীন যুগ থেকে ইহূদী উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ‘ধর্মীয় আদর্শ’ ও ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের প্রথম প্রসিদ্ধ সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহূদী যীলটদের (Zealots) সন্ত্রাস। খৃস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রবাদী এ সকল ইহূদীরা নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপোসহীন ছিল। যে সকল ইহূদী রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহঅবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। এজন্য এরা সিকারী (the Sicarii: dagger men) বা ছুরি-মানব নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এরা প্রয়োজনে আত্মহত্যা করত কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দিত না। এদের হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণ ও প্রশাসনকে সন্ত্রস্ত করা। এজন্য তাদের টার্গেটকে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার, উপাসনালয়, উৎসবকেন্দ্র বা অনুরূপ জনসমাবেশের মধ্যে আক্রমন করে হত্যা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ সকল হত্যাকান্ডের মাধ্যমে জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা এবং রোমান প্রশাসন ও তাদের ‘দালালদেরকে’ তাদের কর্মকান্ডের সংবাদ জানানোর ব্যবস্থা করা।([1])

মধ্যযুগে খৃস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা আমরা দেখতে পাই। বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার, পাল্টা-সংস্কার (the Reformation and the Counter-Reformation)-এর যুগে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ছাড়াও যুদ্ধ বহির্ভুত সন্ত্রাসের অনেক ঘটনা দেখা যায়।([2])

পক্ষান্তরে ইসলামের ইতিহাসে আমরা যুদ্ধ দেখতে পেলেও সন্ত্রাস খুবই কম দেখতে পাই। ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন প্রকারের যুদ্ধ হয়েছে। যেমন মুসলিম রাষ্টের সাথে অমুসলিম রাষ্ট্রের, মুসলিম রাষ্টের সাথে মুসলিম রাষ্ট্রের, মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম সমাজে মুসলমানদের মধ্যে, অথবা অমুসলিমদের মধ্যে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের উদাহরণ খুবই কম। তবে বর্তমানে নামধারী কিছু মুসলিম বিভিন্ন দেশে অযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ হত্যা করছে বা সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে এই অভিযোগ রয়েছে। এগুলোর কিছু প্রমাণিত সত্য, বাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রমাণিত তা নয়। সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ঘটনা আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস। ওসামা বিন লাদেন বা তার বাহিনী আল কায়দা তা করেছে বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। এ দাবির ভিত্তিতে আফগানিস্তানের ও ইরাকের লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র অযোদ্ধা নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছে আমেরিকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেনি। উপরন্তু এ অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের গুয়ান্তামো বে-তে সকল মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে বর্বর অত্যাচারের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি গ্রহণের চেষ্টা করা হচ্ছে।

বাহ্যত এদের বিরুদ্ধে মার্কিন জনগণ ও বিচারকদের সামনে পেশ করার মত গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই বলেই এরূপ করা হচ্ছে। যে কোনো এনসাইক্লোপীডিয়া বা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে সন্ত্রাসের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, সন্ত্রাসের উৎপত্তি ও বিকাশে মুসলমানদের অবদান খুবই কম। বরং সন্ত্রাসের উৎপত্তি ইহূদী যীলটদের (Zealots) হাতে। আধুনিক ইতিহাসে ভারতে, ইউরোপে ও অন্যান্য দেশে অগণিত সন্ত্রাসী দল ও সন্ত্রাসী ঘটনা পাওয়া যায়। এদের প্রায় সকলেই ইহূদী, খৃস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। ভারতে, আমেরিকায় বা অন্যত্র কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা হলেই প্রথমে মুসলিমদেরকে দায়ী করা হয় এবং প্রচার মাধ্যমে তা ফলাও করা হয়। পরবর্তী তদন্তে অনেক সময় এদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যায় না, অথবা প্রমাণিত হয় যে, অন্যরা তা করেছে। কিন্তু সাধারণত প্রচার মাধ্যমে তা ফলাও করা হয় না। এরপরও যদি মুসলিমদের নামে কথিত সন্ত্রাসী ঘটনাগুলিকে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয় তবে তা বিশ্বের সকল সন্ত্রাসী ঘটনার কত পারসেন্ট? ১ বা ২ পার্সেন্টও নয়।

এভাবে আমরা দেখবো যে, ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ’, ‘ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও হত্যা’র বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার। এরূপ মিথ্যা প্রচারণার পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, কিছু মুসলিম ইসলামের নামে, ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে বা অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে হত্যা বা ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এরা মূলত ইসলাম না বুঝা কুরআন হাদীসে সঠিক ব্যাখ্যা না জানার কারণেই এসব করছে বা কেউ তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করছে

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম
প্রিন্সিপাল মাদরাসাতুল মাদীনাহ লিল বানাত, মিরপুর-১, ঢাকা
প্রধান গবেষক: আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন
সম্পাদক ও প্রকাশক: ডেইলি মাই নিউজ।

———————————————————————

(1) দেখুন: Encyclopaedia Britannica, Articles: Terrorism & article: Zealot Microsoft Encarta 2007. 1993-2006, terrorism.

(2) দেখুন: Encyclopaedia Britannica, Articles: Terrorism & Idelogy.

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button