সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ইসলামের ভূমিকা

সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম অনেক কঠোরতা আরোপ করেছে। ইসলাম কখনোই কোনো সন্ত্রাসীকে ছাড় দেয়নি। সবসময় অংকুরেই তার বিনাশ করেছে। কেননা সন্ত্রাস যদি অংকুরেই বিনাশ করা না হয় তাহলে তা ক্রমেই বাড়তে থাকবে। তখন ইচ্ছে করলেই সহজে তা নির্মূল করা যাবে না। মহানবী (সা.) আজ থেকে প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে কঠিন হস্তে সন্ত্রাসকে দমন করেছিলেন। নিম্মোক্ত এই হাদীসটি থেকে এর জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।

উকল গোত্রের একদল লোক মদীনায় এলো, তখন নবী (সা.) তাদেরকে দুগ্নবতী উটের কাছে যাওয়ার নির্দেশ করলেন। তাদেরকে আরো নির্দেশ করলেন যেন তারা সে সব উটের কাছে গিয়ে সেগুলোর দুধ ও পেশাব পান করে। তারা তা পান করল। অবশেষে যখন তারা সুস্থ হয়ে গেল, তখন রাখালকে হত্যা করে উটগুলো হাকিয়ে নিয়ে চলল। ভোরে নবী (সা.) এর কাছে এ সংবাদ পৌছল। তিনি তাদের খোঁজে লোক পাঠালেন। রৌদ্র চড়ার আগেই তাদেরকে নিয়ে আসা হল। তাদের সম্পর্কে তিনি নির্দেশ করলেন, তাদের হাত-পা কাটা হল। লৌহশলাকা দিয়ে তাদের চোখগুলো ফুড়ে দেয়া হল। এরপর প্রখর রৌদ্র তাপে ফেলে রাখা হল। তারা পানি পান করতে চাইল। কিন্তু পান করানো হল না।

আবূ কিলাবা (রহ.) বলেন, ঐ লোকগুলো এমন একটি দল যারা চুরি করেছিল, হত্যাও করেছিল, ঈমান আনার পর কুফরী করেছিল আর আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।( )

প্রয়োজনে সন্ত্রাসীদের দেশান্তর করতে হবে:

দেশ থেকে সন্ত্রাসীদের চিরতরে উৎখাত করার নিমিত্তে রাসূল (সা.) কখনো সন্ত্রাসীদেরকে গোষ্ঠীসহ উৎখাত করেছিলেন। ইহুদী গোত্র বনূ নাযীর রাসূল সা কে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। ঘটনা সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর রাসূল (সা.) তাদেরকে তাদের এলাকা থেকে উৎখাত করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। এভাবে তিনি মদীনাকে সন্ত্রাসমুক্ত করেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনা পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্বপ্রথম মদীনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইয়াহূদী গোত্রসমূহের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইয়াহূদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না এবং কনো আক্রমণকারীকে সাহায্য করবে না। তারা আক্রান্ত হলে মুসলিমরা তাদেরকে সাহায্য করবে। শান্তিচুক্তিতে আরও অনেক ধারা ছিল। এমনিভাবে বনু নাযীরসহ ইয়াহূদীদের সকল গোত্র এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। মদীনা থেকে দুই মেইল দূরে বনু নাদীরের বসতি, দূর্বেদ্য দূর্গ্য এবং বাগ-বাগিচা ছিল। ওহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত বাহ্যতঃ তাদেরকে এই শান্তিচুক্তির অনুসারী দেখা যায়। কিন্তু ওহুদ যুদ্ধের পরে বিশ্বাসঘাতকতা ও গোপন দুরভিসন্ধি শুরু করে দেয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার সূচনা এভাবে হয় যে, বনু নাযীরের জনৈক সর্দার কা’ব ইবনে আশরাফ ওহুদ যুদ্ধের পর আরও চল্লিশজন ইয়াহূদীদের সাথে নিয়ে মক্কা পৌঁছে এবং ওহুদ যুদ্ধ ফেরত কুরাইশী কাফেরদের সাথে সাক্ষাৎ করে।

দীর্ঘ আলোচনার পর উভয় পক্ষের মধ্যের রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চুক্তি চুড়ান্ত হয়। চুক্তি সম্পাদনের পর কা’ব ইবনে আশরাফ মদীনায় ফিরে এলে জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আদ্যোপান্ত ঘটনা এবং চুক্তির বিবরণ বলে দেন। এরপর বনু নাযীর আরও অনেক চক্রান্ত করতে থাকে। তন্মধ্যে একটি আলোচ্য আয়াতের সাথে সম্পর্কিত যার কারণে তাদেরকে মদীনা থেকে চলে যেতে হয়। ঘটনাটি হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমন করার পর ইয়াহুদীদের সাথে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির একটি শর্ত এই ছিল যে, কারো দ্বারা ভুলবশত: হত্যা হয়ে গেলে মুসলিম ও ইয়াহুদী সবাই এর রক্তের বিনিময় পরিশোধ করবে।

একবার আমর ইবনে উমাইয়া দুমাইরীর হাতে দুটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এর রক্ত বিনিময় আদায় করা মুসলিম-ইয়াহুদী সকলেরই কর্তব্য ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য মুসলিমদের কাছ থেকে চাঁদা তুললেন। অতঃপর চুক্তি অনুযায়ী ইয়াহুদীদের কাছ থেকেও রক্ত বিনিময়ের অর্থ গ্রহণ করার ইচ্ছা করলেন। সে মতে তিনি বনু নাযীর গোত্রের কাছে গমন করলেন। তারা দেখল যে, রাসূলকে হত্যা করার এটাই প্রকৃষ্ট সুযোগ। তাই তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে বলল, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমরা রক্ত বিনিময়ের অর্থ সংগ্ৰহ করার ব্যবস্থা করছি।

এরপর এরা গোপনে পরামর্শ করে স্থির করল যে, তিনি যে প্রাচীরের নীচে উপবিষ্ট আছেন, এক ব্যক্তি সেই প্রাচীরের উপরে উঠে একটি বিরাট ও ভারী পাথর তার উপর ছেড়ে দিবে, যাতে তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) তৎক্ষণাৎ ওহীর মাধ্যমে এই চক্রান্তের বিষয় অবগত হয়ে গেলেন। তিনি সে স্থান ত্যাগ করে চলে এলেন এবং ইয়াহুদীদেরকে বলে পাঠালেনঃ তোমরা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে চুক্তি লঙ্ঘন করেছ। অতএব, তোমাদেরকে দশ দিনের সময় দেয়া হলো। এই সময়ের মধ্যে তোমরা যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। এই সময়ের পর কেউ এ স্থানে দৃষ্টিগোচর হলে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে।

বনু নাযীর মদীনা ত্যাগ করে চলে যেতে সম্মত হলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মুনাফিক তাদেরকে বাধা দিয়ে বলল: তোমরা এখানেই থাক। অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার অধীনে দুই হাজার যোদ্ধার একটি বাহিনী আছে। তারা প্ৰাণ দিবে, কিন্তু তোমাদের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগতে দিবে না। বনু নাযীর তাদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সদৰ্পে বলে পাঠালঃ আমরা কোথাও যাব না। আপনি যা করতে পারেন, করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে বনু নাযীর গোত্রকে আক্রমণ করলেন। বনু নাযীর দুর্গের ফটক বন্ধ করে বসে রইল এবং মুনাফিকরাও আত্মগোপন করল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে চতুর্দিক থেকে অবরোধ করলেন এবং তাদের খজুর বৃক্ষে আগুন ধরিয়ে দিলেন এবং কিছু কর্তন করিয়ে দিলেন। অবশেষে নিরূপায় হয়ে তারা নির্বাসনদণ্ড মেনে নিল।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এই অবস্থায়ও তাদের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের আদেশ দিলেন। আসবাবপত্র যে পরিমাণ সঙ্গে নিয়ে যেতে পার, নিয়ে যাও। তবে কোনো অস্ত্ৰ-শস্ত্র সঙ্গে নিতে পারবে না। এগুলো বাজেয়াপ্ত করা হবে। সে মতে বনু নাযীরের কিছু লোক সিরিয়ায় এবং কিছু লোক খাইবারে চলে গেল। সংসারের প্রতি অসাধারণ মোহের কারণে তারা গৃহের কড়ি-কাঠ, তক্তা ও কপাট পর্যন্ত উপড়িয়ে নিয়ে গেল। ওহুদ যুদ্ধের পর চতুর্থ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই ঘটনা সংঘটিত হয়। এরপর উমর (রা.) তার খেলাফতকালে তাদেরকে পুনরায় অন্যান্য ইয়াহুদীদের সাথে খাইবার থেকে সিরিয়ায় নির্বাসিত করেন।( )
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব বিনির্মাণে মুসলমানদের ব্যাপক অবদান এবং দুনিয়া জুড়ে ইসলামের ব্যাপক আবেদন থাকা সত্ত্বেও অমুসলিম সভ্যতা বিশেষ করে ইহুদী ও খ্রিস্টান সভ্যতা ধারাবাহিকভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের নামে নানা কুৎসা রটাচ্ছে এবং বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্র তাদের অতীত ঐতিহাসিক গাদ্দারিরই নিকৃষ্ট ধারাবাহিক অংশ। একদিকে ইহুদী খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের হীন চক্রান্ত ও গভীর ষড়যন্ত্র, অপরদিকে মসুলিম নামধারী কিছু অপরিপক্ক, বিভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট মানুষ, আরেকদিকে জন্মগতভাবে ইসলাম সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা, এর বাইরে সঠিক ইসলাম পরিপালনে সমাজের অধিকাংশ মুসলমানদের অনীহা, এ চারে মিলে ইসলাম পৃথিবীতে আজ মিসআন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন বা ভুলবোঝা ধর্ম-এ পরিণত হয়েছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে দিনদিন নিত্য নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তবে সন্ত্রাসের সঙ্গে যে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো মুসলিম কখনো সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী ও জঙ্গিত হতে পারে না তা এই আলোচনা দ্বারা আমরা আশা করি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে।

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম
প্রিন্সিপাল মাদরাসাতুল মাদীনাহ লিল বানাত, মিরপুর-১, ঢাকা
প্রধান গবেষক: আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন
সম্পাদক ও প্রকাশক: ডেইলি মাই নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button