ফাসাদ শব্দের ব্যবহার ও তার উদ্দেশ্য

ফ্যাসাদ (فساد) শব্দটি আরবি। এর অর্থ নৈরাজ্য, উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, অশান্তি,  উত্তরাধিকার, পাপ্রস্পরিক বন্ধুত্ব, প্রভৃতি। ফাসাদ শব্দটি কুরআনের বহু জায়গায় ব্যবহার হয়েছে।

যেমন সূরা আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

وَ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بَعۡدَ اِصۡلَاحِہَا وَ ادۡعُوۡہُ خَوۡفًا وَّ طَمَعًا ؕ اِنَّ رَحۡمَتَ اللّٰہِ قَرِیۡبٌ مِّنَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

দুনিয়ায় শান্তি শৃংখলা স্থাপনের পর বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করনা, আল্লাহকে ভয়-ভীতি ও আশা আকাংখার সাথে ডাক, নিঃসন্দেহে আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের অতি সন্নিকটে।[1]

ইবনে কাসীর (র.) বলেন: শান্তি স্থাপনের পর ভূ-পৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি করা এবং যেসকল কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা থেকে আল্লাহ্‌ তাআলা নিষেধ করেছেন। কারণ যখন সবকিছু স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়, তা হলে তা মানুষের জন্য বেশী ক্ষতিকর। এ জন্য আল্লাহ্‌ এরুপ করতে নিষেধ করেছেন।[2]

সূরা কাসাসে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

وَ ابۡتَغِ فِیۡمَاۤ اٰتٰىکَ اللّٰہُ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ وَ لَا تَنۡسَ نَصِیۡبَکَ مِنَ الدُّنۡیَا وَ اَحۡسِنۡ کَمَاۤ اَحۡسَنَ اللّٰہُ اِلَیۡکَ وَ لَا تَبۡغِ الۡفَسَادَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ الۡمُفۡسِدِیۡنَ

আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান কর। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ কর। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না’।[3]

এ আয়াতে ফাসাদ অর্থ উগ্রতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। কুরআনে এগুলোকে আল্লাহ্‌ তাআলা মহাপাপ ও শক্তগুনাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সূরা বাকারায় আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ الۡفَسَادَ.

এবং আল্লাহ্‌ অশান্তি ভালবাসেন না।[4]

সূরা মাইদায় আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ الۡمُفۡسِدِیۡنَ

আর আল্লাহ্‌ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না।[5]

সূরা মাইদায় আল্লাহ্‌ তাআলা আরোও বলেন:

مِنْ اَجْلِ ذٰلِكَ  كَتَبْنَا عَلٰی بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا وَ مَنْ اَحْیَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْیَا النَّاسَ جَمِیْعًا

এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে, যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন তামাম মানুষকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচালো।[6]

এ আয়াতে ফাসাদ দ্বারা বুঝানো হয়েছে সকল ধরণের সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ ও অশান্তিকে।

সূরা আনফালে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:

وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ اِلَّا تَفۡعَلُوۡہُ تَکُنۡ فِتۡنَۃٌ فِی الۡاَرۡضِ وَ فَسَادٌ کَبِیۡرٌ

আর যারা কুফরী করে তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর (অর্থাৎ তোমরা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস) তাহলে দুনিয়াতে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে।[7]

এ আয়াতে ফাসাদের উদ্দেশ্য গোলযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও চরম অশান্তি।[8]

ظَہَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِی النَّاسِ لِیُذِیۡقَہُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ

মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোন কোন কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।[9]

আয়াতে ‘স্থল’ বলতে মানুষের বাসভূমি এবং জল বলতে সমুদ্র, সামুদ্রিক পথ এবং সমুদ্র-উপকূলে বসবাসের স্থান বুঝানো হয়েছে। ‘ফাসাদ’ (বিপর্যয়) বলতে ঐ সকল আপদ-বিপদকে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা মনুষ্য-সমাজে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয় এবং মানুষের শান্তিময় জীবন-যাত্রা ব্যাহত হয়। এই জন্য এর অর্থ গুনাহ ও পাপাচরণ করাও সঠিক। অর্থাৎ, মানুষ এক অপরের উপর অত্যাচার করছে, আল্লাহর সীমা লংঘন করছে এবং নৈতিকতার বিনাশ সাধন করছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অবশ্য ‘ফাসাদ’-এর অর্থ আকাশ-পৃথিবীর ঐ সকল বিপর্যয় নেওয়াও সঠিক, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতা স্বরূপ প্রেরণ করা হয়। যেমন দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনিরাপত্তা, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি। উদ্দেশ্য এই যে, যখন মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিফল স্বরূপ তাদের কর্মপ্রবণতা মন্দের দিকে ফিরে যায় এবং তার ফলে পৃথিবী নানা বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুখ-শান্তি বিলীন হয় এবং তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ছিন্তাই-ডাকাতি, লড়াই ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে। তার সাথে সাথে কখনো আকাশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন আপদ-বিপদ (প্রাকৃতিক দুর্যোগ)ও প্রেরিত হয়। আর তাতে উদ্দেশ্য এই থাকে যে, ঐ সর্বনাশী বিপর্যয় ও আপদ-বিপদ দেখে সম্ভবত মানুষ পাপকর্ম থেকে বিরত হবে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে পুনরায় তাঁর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসবে।[10]

এভাবে বিভিন্ন অর্থে ফাসাদ শব্দটি সূরা মাইদার ৩৩ ও ৬৪, সূরা হূদের ১১৬, সূরা কাসাসের ৮৩ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এসব আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, নাযিলের প্রেক্ষাপট ও অবস্থাভেদে ফাসাদের বিভিন্ন অর্থ হয়।

হাদীসশাস্ত্রেও ফাসাদ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। হাদীসগুলো থেকে বোঝা যায়, একটা সময় পৃথিবীতে ব্যাপক নৈরাজ্য, অরাজকতা, অস্থিরতা, উগ্রতা, সন্ত্রস, জঙ্গিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনখারাপি ছড়িয়ে পড়বে। যুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন বেড়ে যাবে। মানুষ মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করবে। নিম্মোক্ত হাদীসটি এটি স্পষ্ট বোঝা যায়।

 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ تَذْهَبُ الدُّنْيَا حَتَّى يَأْتِيَ عَلَى النَّاسِ يَوْمٌ لاَ يَدْرِي الْقَاتِلُ فِيمَ قَتَلَ وَلاَ الْمَقْتُولُ فِيمَ قُتِلَ ‏”‏ ‏.‏ فَقِيلَ كَيْفَ يَكُونُ ذَلِكَ قَالَ ‏”‏ الْهَرْجُ ‏.‏ الْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِي النَّارِ.

আবূ হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, দুনিয়া ধ্বংস হবে না যে পর্যন্ত না মানুষের কাছে এমন এক যুগ আসে, যখন হত্যাকারী জানবে না যে, কি দোষে যে অন্যকে হত্যা করেছে এবং নিহত লোকও জানবে না যে, কি দোষে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কিভাবে এমন অত্যাচার হবে? তিনি জবাবে বললেন, সে যুগটা হবে হত্যার যুগ। এরূপ যুগের হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই জাহান্নামী হবে। বর্ণনাকার আবান হলো, ইয়াযীদ ইবনু কাইসান। তিনি ইসমাঈল (রহ.) হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি ইসমাঈলের বংশ-পরিচয়মূলক الأَسْلَمِيَّ  শব্দটি তিনি বর্ণনা করেননি।[11]

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
পরিচালক: ভয়েস অব ইসলাম
প্রিন্সিপাল মাদরাসাতুল মাদীনাহ লিল বানাত, মিরপুর-১, ঢাকা
প্রধান গবেষক: আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন
সম্পাদক ও প্রকাশক: ডেইলি মাই নিউজ।
———————————————————–
(1) দেখুন: সূরা আল আরাফ (৭), আয়াত: ৫৬।

(2) দেখুন: তাফসীর ইবনে কাসীর, দার তইবাহ, রিয়াদ, ৩/৪২৯।

(3) দেখুন: সূরা কাসাস (২৮), আয়াত: ৭৭।

(4) দেখুন: সূরা বাকারা (২), আয়াত: ২০৫।

(5) দেখুন: সূরা মাইদা (৫), আয়াত: ৩২।

(6) দেখুন: সূরা মাইদা (৫), আয়াত: ৩২।

(7) দেখুন: সূরা আনফাল (৮), আয়াত: ৭৩।

(8) দেখুন: তাফসীর আহসানুল বায়ান, পৃ: ৩২৫।

(9) দেখুন: সূরা রুম (৩০), আয়াত: ৪১।

(10) দেখুন: তাফসীর আহসানুল বায়ান, পৃ: ৭১০।

(11) দেখুন: সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৯০৮, দার ইহয়াআত তুরাস আল আরাবি, বৈরুত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button