আজই শুধু আপনার

আপনি যখন প্রভাতের সূর্য্য দেখবেন, দেখবেন ভোরের কুয়াশায় সেই পবিত্র শিশিরে স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করবেন না। অপেক্ষা করবেন না গোধূলি লগ্নের পড়ন্ত বিকেলে মাঠের ঐ শেষপ্রান্তে মিশে যাওয়া নীলিমা নিলাঞ্জনার। যখন সুবহে সাদিক উকি দিবে, আপনি মুয়াজ্জিনের ঐ সুমধুর কণ্ঠে আযানের ধ্বনি শোনবেন, যখন আপনার কানে ভেসে আসবে ঐ সুমধুর তান, যখন ভোরের পাখীদের কিচিরমিচির গুঞ্জরনে বিমোহিত হবেন, নতুন ভোরের ফুরফুরে ঐ দখিনা বাতাস যখন আপনার তনুমনে প্রশান্তির দোলা দিবে, তখন আর আশা করবেন না বিকেলে গ্রামের লম্বা মেঠো পথ ধরে হেটে হেটে ঐ পশ্চিম আকাশে সূর্য্যের লালিমা মাখা অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের। কিংবা সমুদ্র তীরে সাগরের জলতরঙ্গের লহরীর শেষ দিগন্ত যখন পশ্চিম আকাশের নীলিমার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন নিবিড় ভাবে অপলক নয়নে অস্তমিত সূর্য্যের লালিমা অবলোকনের। কিংবা বাড়ীর বেলকনিতে বা ছাদের ঐ ছোট্ট বাগানটিতে বসে জীবন সায়াংহে সূর্য্যের রুপ লাবণ্য দেখার আকাঙ্ক্ষা করবেন না।

শুধু আজই আপনার জীবন। কেননা আপনি কেবল আজকের সূর্যই দেখেছেন। আজই আপনার। কেননা আজকের পৃথিবীর মুক্ত বাতাসই আপনি গ্রহণ করেছেন। তাই আগামীকালের জন্য কোনো চিন্তা করবেন না, অসাধ্যকে সাধনের বৃথা চেষ্টায় উদ্বিগ্ন হবেন না।

আর গতকাল! সেতো চলেই গেছে। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে আর লাভ কি বলুন? যে চলে গেছে সে আসলে আপনার কাছে থাকার জন্য আসেইনি, যে এসেছে সেও থাকবে না। একসময় আপনাকে ফাঁকি দিয়ে মনের অজান্তেই অচিন দেশে পাড়ি জমাবে। হারিয়ে যাবে দূর অজানার কোনো এক পথে।

ভবিষ্যতের কথা বলেবেন? সেতো এখনো আসেইনি। যে এখনো আসেইনি সে যে আসবে তার কি নিশ্চয়তা বলুন? সে যে আসবেই, আপনাকে ভালবাসবেই তার কি তার কি বিশ্বাস বলুন? যে আপনার কাছে এসেও আপনাকে ভালোবাসেনি, ছেড়ে চলে গেছে। আর যে এখনো আসেইনি, যার সঙ্গে এখনো আপনার কোনো সাক্ষাৎই হয়নি সে যে আসবেই, আপনাকে ভালোবাসবেই এই ভঙ্গুর বিশ্বাসের কি কোনো ভিত্তি আছে? নিঃশ্বাসের যেমন কোনো বিশ্বাস নেই, বিশ্বাস নেই অনিশ্চিত দূর কিংবা অদূর কোনো ভবিষ্যতেরও।

জগতে কাল বলতে কোনোকিছু নেই, আগামী বলতে কোনো বস্তু নেই, ভবিষ্যৎ বলতে কোনো বিষয় নেই। কারণ এগুলোর এখনো কোনো অস্তিত্ব নেই। অতএব শুধু আজই আপনার। বেঁচে থাকলে আগামীকাল বোনাস। নিতান্তই রবের একান্ত করুণা।

অর্থাৎ আজকের দিনকেই আপনার জীবনের শেষদিন মনে করুন। ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনা করবেন না। অতীত নিয়ে আফসোস করবেন না। কাল কী খাবেন তা নিয়ে আজই পেরেশান হবেন না। অস্থির হবেন না কোথায় থাকবেন তা নিয়ে। দুঃখ করবেন না জীবনের না পাওয়া আর অনাকাঙ্ক্ষিত সৃতিগুলো ভেবে।

কেন আপনাকে এসব বলেছি তা কি জানেন? মহান আল্লাহ্‌র সেই ঐশী বাণী কি আপনার মনে আছে যা তিনি আপনার জন্যই প্রেরণ করেছেন? তাহলে একটু দেখে নিন। আপনার অশান্ত আত্মাকে প্রশান্ত করে নিন।
আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,

وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌ مَّاذَا تَکۡسِبُ غَدًا ؕ وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌۢ بِاَیِّ اَرۡضٍ تَمُوۡتُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡر

“আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত”। (সূরা লোকমান, আয়াত: ৩৪)

আপনার কি মানবতার মুক্তির কাণ্ডারি, আরবের সেই রাসূলের কথা মনে আছে যিনি আপনার জন্য কেঁদেছেন? স্মরণ আছে কি তাঁর সেই বিখ্যাত বাণীটি? যেখানে তিনি আপনাকে লক্ষ্য করেই বলেছেন,

كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّك غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ”. وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا يَقُولُ: إذَا أَمْسَيْتَ فَلَا تَنْتَظِرْ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلَا تَنْتَظِرْ الْمَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِك لِمَرَضِك، وَمِنْ حَيَاتِك لِمَوْتِك.

“দুনিয়াতে অপরিচিত অথবা ভ্রমণকারী মুসাফিরের মতো হয়ে যাও। ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেন, সন্ধ্যা বেলায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না। আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। অসুস্থতার জন্য সুস্থতাকে কাজে লাগাও, আর মৃত্যুর জন্য জীবিত অবস্থা থেকে (পাথেয়) সংগ্রহ করে নাও”। (সহীহ বুখারী: ৬৪১৬)

তাই আজকের দিকেই মনোযোগ দিন। গতকালের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। আগামীকাল তো আসেইনি। অতীতকে ভুলে যান। জীবনের ডায়রি থেকে চিরতরে মুছে ফেলুন। বলুন হে অতীত! আমি তোমাকে ভুলে গেলাম। তুমি চলে যাও, ডুবে যাও, আমাকে ভুলে যাও, আমি তোমাকে আর স্মরণ করতে চাই না, তোমার কোনো সৃতি আর বহন করতে চাই না। আগামীকালকে বলুন, হে ভবিষ্যৎ! হে অচেনা! হে অজানা! আমি তোমাকে জানতে চাই না, তোমাকে চিনতে চাই না। আমি চাই না তোমাকে নিয়ে অলীক কল্পনার ডানায় ভেসে বেড়াই, আমি চাই না তোমাকে নিয়ে অসত্য স্বপ্ন লালন করি, কল্পনাবিলাসে মেতে উঠি। বলুন, আমি পজেটিভ, আমি বাস্তবতায় বিশ্বাসী। অসম্ভব জয়ের স্থুল বিশ্বাসে আমি একজন চরম অবিশ্বাসী।

লেখক: মুফতি যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
বি. এ. অনার্স, এম. এ, এমফিল: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব ও
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ইফতা ও দাওরায়ে হাদীস: যাত্রাবাড়ী ও লালবাগ জামেয়া, ঢাকা।
প্রিন্সিপাল, মানাহিল মডেল মাদরাসা, মিরপুর-১, ঢাকা।
পরিচালক, ভয়েস অব ইসলাম।
[email protected]

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button