পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ

দিনের শেষে পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যেমন তার সবপাঠ চুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। দিবাকরের অস্তপথ যেমন কেউ রুখতে পারে না, ঠিক তেমনই মৃত্যুও, সময় যখন তার আসন্ন হয়, এ নশ্বর পৃথিবীর বিদায়ঘণ্টা যখন কারো বেজে ওঠে তখন কেউ আর তাকে ঠেকাতে পারে না। পারে না তা তরান্বিত করতে, পারে না তা বিলম্বিতি বা প্রলম্বিত করতে। মৃত্যুর সে মিছিলে আমাদের সবাইকে যাত্রী হতেই হবে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা স্রষ্টার সুন্দর বিচিত্র এই অপরূপ বসুন্ধরার শেষ নিশ্বাস বিয়োগের অনিবার্য স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সবাইকে মৃত্যুর পেয়ালা পান করতেই হবে। যে জন্মেছে সে মরবেই। যে এসেছে সে যাবেই। এটাই মহাবিশ্বের চিরিকালিন চিরন্তন মহা বিস্ময়। এটাই মহান আল্লাহ্র চিরন্তন অমোঘ অজেয় অবধারিত বিধান। কবির ভাষায়-

‘জন্মিলে মরিতে হবে,
চিরদিন কে কোথায় রবে?’
মানুষ মরিবে সবে,
নহে সে অমর ভবে’।

জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য সাদা ও কালোর মধ্যকার পার্থক্যের মতো সরল নয়। কিছু মৃত্যুর কষ্ট মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। যদি সে মৃত্যু হয় পিতার জীবদ্দশায় তার কলিজার টুকরা প্রিয় শিশু সন্তানের তবে সে মৃত্যু আরোও বহুগুণ কষ্টের, অব্যক্ত বেদনা আর সীমাহীন বিষাদের। আর যদি সে সন্তান হয় জীবনের পড়ন্ত প্রহরের কিনারে ভাসমান এক হতভাগ্য অসহায় পিতার একমাত্র শিশু ছেলের তবে সে মৃত্যু সে পিতার জন্য হয়ে দাড়ায় তার জগতন্ধকারাচ্ছন্ন বিভীষিকাময় বিনাশী ভারী কেয়ামতসম। যদি সে সন্তান হয় অসহায় ব্যাকুল পাগলপারা মায়ের রবের দরবারে দীর্ঘ প্রার্থিত আদরের দুলাল নাড়িছেঁড়া ধন, তবে সে মৃত্যু কীভাবে বুঝিবে সহিবে অবুঝ সে মায়ের মন!

মোগল সম্রাট শাহজাহানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দুনিয়ায় সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ।

পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ কতটা ভারী- একজন হতভাগ্য পিতাই কেবল তা বোঝতে পারে। দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম তো হল, সন্তান একদিন বড় হবে। পিতার সেবা করবে। তার কোলে পিতার মৃত্যু হবে। সে পিতার লাশ বহন করবে। জানাযা দিবে। নিজ হাতে মাটি দিবে।

কিন্তু এ অধম পিতার সে সৌভাগ্য হলো না। আমি বহন করলাম আমারই শিশুপুত্রের লাশ। যে ছেলের আমার জানাযা পড়ানোর কথা ছিলো সে ছেলের জানাযাই পড়ালাম আমি। কথা ছিলো ও আমার কবরে মাটি দিবে, কিন্তু না হলো না, আমি পাষাণ পোড়াকপালই নিজ হাতে মাটি দিলাম ওর কবরে। আমি এক পাষণ্ড পিতা নিজ হাতে কবর দিলাম আদরের সন্তানকে। কথা ছিলো ও আমার লাশ দেখবে, আমার জন্য দুহাত তূলে মহান আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করবে, কিন্তু না, আমি হতভাগাই দেখলাম ওর লাশ দেখলাম। ওর জন্য দুহাত তুলে মহান রবের দরবারে ফরিয়াদ করলাম।

কেউ কি জানে সন্তানের মৃতদেহ দেখতে একজন বাবার কাছে কেমন লাগে? একজন বাবার জন্য তা কতোটা কঠিন তা কি আপনি অনুভব করতে পারেন? যে সন্তানকে পরম মমতায়, প্রবল ও পরম আদর যত্নে কোলে পিঠে করে মা-বাবা লালন-পালন করেন, প্রতিটা মুহূর্ত যে শিশুকে পরমানন্দে, আদরে যতনে সোহাগে বুকে চেপে রাখেন সেই সন্তানের মরামুখ যখন একজন পিতাকে দেখতে হয়, সেটা কতটা বেদনার হতে পারে, তা এই হতভাগা পিতা ছাড়া অন্য কেউ বোঝবে না। পিতার দিলের সে ব্যথা কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।

আল্লাহ্ তাআলা আমাকে অত্যন্ত অনুগ্রহ করে সাড়ে ৬ মাস আগে, ৬ জুলাই, ২০২১ এ একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছিলেন, গত ২১/১/২০২২, শুক্রবার, ভোরে সাড়ে ছয়টায় তিনি তাঁর সে উপহার ফেরত নিয়েছেন।

إنا لله وإنا إليه راجعون.
اللهم آجرني في مصيبتي، وأخلف لي خيرًا منها.

বস্তুত এ ছিলো মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে একটি আমানত। তিনি তার রক্ষিত সে আমানত ফিরিয়ে নিয়েছেন। এতে আমরা অসন্তুষ্ট নই। আমাদের মনে এ জন্য কোনো কষ্ট নেই। আল্লাহ্‌র প্রতি ক্ষোভ নেই। যা আআছে তা শুধুমাত্র এক নিষ্পাপ মাসুম শিশু সন্তানের প্রতি তার অসহায় পিতা-মাতার দয়ার পরশে আবদ্ধ আল্লাহ্‌ প্রদত্ত পবিত্র নিষ্কলুষ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর অন্তর নিংড়ানো পরম মমতার বহিঃপ্রকাশ।

বুকে বহু আশা নিয়ে ছেলেটির নাম রেখেছিলাম হামদান মাহমূদ। অর্থ হলো, রবের প্রশংসিত প্রশংসাকারী। হাদিসে আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রহমানকে উত্তম নাম বলা হয়েছে। তাই হাদিসের উপর আমলের জন্য ডাকনাম হিসেবে আব্দুল্লাহও রেখেছিলাম। হামদান মাহমূদ আব্দুল্লাহ। আমার মেয়েরা এ নামটিকে অসম্ভব পছন্দ করতো। ভাইকে কে কত আদর করবে, কোলে নিবে এ নিয়ে ঝগড়া করতো, মান-অভিমান করতো। আজ তাদের আদরের সে ছোট ভাইয়া নেই! ওদের ভীষণ মন খারাপ। সোয়া সাত বছরের ছোট মেয়েটি মাঝ রাতে আমার ভাই কৈ বলে চিৎকার করে ওঠে। ওকে এনে দাও। বড় মেয়েটি হু হু করে ঢুকরে ঢুকরে চোখের পানি ফেলে। কিচ্ছুক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

আমি তাদেরকে বলি- তোমরা কি জানো আল্লাহ্‌র নবী আমাদের জন্য কী বলেছেন? ওরা বলে- না আব্বু। বলো তিনি আমাদের জন্য কী বলেছেন? আমি তাদের বলি- চলো আমরা নবী (সা.) এর দুটি হাদিস শুনি। নবী (সা.) আমাদের জন্য বলেছেন:

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ -رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ- عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «يَقُولُ اللَّهُ سُبْحَانَه وتعالى: ابْنَ آدَمَ إِنْ صَبَرْتَ وَاحْتَسَبْتَ عِنْدَ الصَّدْمَةِ الْأُولَى لَمْ أَرْضَ لَكَ ثَوَابًا دُونَ الْجَنَّةِ». (جه) حسن.

“আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে বনি আদম, যদি তুমি ধৈর্যধারণ কর ও প্রথম দুঃখের সময় অধৈর্য না হয়ে তাতে সওয়াবের আশা কর, তাহলে আমি তোমার জন্য জান্নাত ব্যতীত কোন প্রতিদানে সন্তুষ্ট হব না”। [ইব্‌ন মাজাহ, হাদিসের মান: হাসান]

নবী (সা.) আরোও বলেছেন:

عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ -رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ- أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: « إِذَا مَاتَ وَلَدُ الْعَبْدِ قَالَ اللَّهُ لِمَلَائِكَتِهِ: قَبَضْتُمْ وَلَدَ عَبْدِي؟ فَيَقُولُونَ: نَعَمْ, فَيَقُولُ: قَبَضْتُمْ ثَمَرَةَ فُؤَادِهِ؟ فَيَقُولُون:َ نَعَمْ, فَيَقُولُ: مَاذَا قَالَ عَبْدِي؟ فَيَقُولُونَ: حَمِدَكَ وَاسْتَرْجَعَ، فَيَقُولُ اللَّهُ: ابْنُوا لِعَبْدِي بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَسَمُّوهُ بَيْتَ الْحَمْدِ». ( ت, حب ) حسنه الشيخ الألباني.

“বান্দার যখন সন্তান মারা যায় আল্লাহ তার ফেরেশতাদের বলেন: তোমরা আমার বান্দার সন্তান কব্জা করেছ? তারা বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: তোমরা আমার বান্দার অন্তরের নির্যাস গ্রহণ করেছ? তারা বলেঃ হ্যাঁ। তিনি বলেন: আমার বান্দা কি বলেছে? তারা বলে: আপনার প্রশংসা করেছে ও ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন পড়েছে। (অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা তার কাছেই ফেরৎ যাব এটা বলেছে।) অতঃপর আল্লাহ বলেন: তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর, তার নাম রাখ বায়তুল হামদ”। [তিরমিযি ও ইব্‌ন হিব্বান] হাদীসটি শায়খ আলবানি হাসান বলেছেন।

আমার মেয়েরা হাদিস শুনে চুপ হয়ে যায়। খুশি হয়। মনে শান্তনা খুঁজে পায়। মাকেও শোনায়। মা বিচলিত হয়ে ওঠেন। কলিজার মানিকের জন্য অস্রুসজল নয়নে কায়মনোবাক্যে রবের দরবারে দুহাত তুলে ফরিয়াদ করেন। আমরা বলি:

ইয়া আল্লাহ্! আমরা তোমার ফয়সালায় শতভাগ সন্তুষ্ট। তুমি আমাদের সবরে জামীলের তাওফিক দাও। আমাদের জন্য জান্নাতে তোমার কাছে একটি ঘর বানিয়ে দাও। আর আমাদেরকে তোমার প্রতিশ্রুত (জান্নাতে) বাইতুল হামদ দান করো।

যাকারিয়্যা মাহমূদ মাদানী
২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ঈ.
মিরপুর-১, ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button